X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনৈতিক দলের কাউন্সিলে কী হয়?

আমীন আল রশীদ
১৮ অক্টোবর ২০১৬, ১৪:৪৭আপডেট : ১৮ অক্টোবর ২০১৬, ১৫:০১

আমীন আল রশীদ ‘আওয়ামী লীগের পরবর্তী সভানেত্রী শেখ হাসিনা’-এই বাক্যটি লিখে কোনও টেলিভিশন চ্যানেল কি ব্রেকিং নিউজ চালাবে? অবশ্যই না। কারণ আওয়ামী লীগের পরবর্তী সভানেত্রী যে শেখ হাসিনা, তা অনেকটা নিশ্চিত হয়েই বলা যায়। এর অন্যথা হওয়ার কোনও সুযোগ খুব কম। কারণ এই পদে শেখ হাসিনার কোনও বিকল্প নেই বলেই আমার মনে হয়।
গত ১৯ মার্চ যখন বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল হয়, সেখানেও দলীয় চেয়ারপারসন হিসেবে খালেদা জিয়ার কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী এবং বিকল্পও ছিলেন না। তবে মহাসচিব হিসেবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভারপ্রাপ্ত থেকে ভারমুক্ত হচ্ছেন কী না, দলের স্থায়ী কমিটিতে নতুন কোনও মুখ আসছেন কী না-এসব আলোচনায় ছিল এবং এসব নিয়ে গণমাধ্যমে খবরও হয়েছে।
এবারও এই আলোচনা রয়েছে যে, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামে নতুন কোনও মুখ যুক্ত হচ্ছেন কী না বা কেউ মাইনাস হচ্ছেন কী না। তবে দলের শীর্ষ দুটি পদ, অর্থাৎ সভানেত্রী এবং সাধারণ সম্পাদক পদে যে কোনও পরিবর্তন আসছে না, সে বিষয়ে সন্দেহ কম।
১৯৮১ সালের মার্চে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান শেখ হাসিনা। ওই বছরের ১৭ মে দেশে ফিরে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে তিনি এই পদে আসীন। একইভাবে খালেদা জিয়াও ১৯৮৪ সাল থেকে দলের চেয়ারপারসন পদে রয়েছেন। বাস্তবতা হলো, বড় দুই দলীয় প্রধান পদে এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার বাইরে দ্বিতীয় কারও নাম সম্ভবত চিন্তাও করতে পারেন না দলের নেতাকর্মীরা। এর কারণ প্রথমত আস্থা, দ্বিতীয়ত ভয়।

আস্থা এ কারণে যে, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে শেখ পরিবার এবং বিএনপির রাজনীতিতে জিয়া পরিবার বহু বছরের পরীক্ষিত। ফলে দেশের মানুষ মনেই করে যে, এ দুটি দলের সাধারণ সম্পাদক, মহাসচিব, প্রেসিডিয়াম বা স্থায়ী কমিটিতে যারাই থাকুন না কেন, দলীয় প্রধান হবেন এ দুটি পরিবার থেকেই। অনেকে রাজনীতির এই পরিবারতন্ত্রের সমালোচনা করলেও এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, দলে শৃঙ্খলা রক্ষা তথা দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা এবং কোনও ধরনের ভাঙনের হাত থেকে বাঁচাতে দলীয় প্রধান হিসেবে আপাতত শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার বিকল্প নেই। এমনকি তাদের পরেও দলীয় প্রধান হিসেবে তাদের সন্তান বা নিকটাত্মীয়রাই আসবেন, এটাই মোটামুটি নিশ্চিত।

তবে ব্যক্তি বা পরিবারের প্রতি এই আস্থা ও বিশ্বাস যেমন আছে, তেমনি এখানে ভয়ও আছে। ভয়টা হলো দলের কোনও নেতাকর্মী যদি দলীয় প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া কিংবা তাদের কোনও উত্তরসূরির বাইরে অন্য কারও নাম প্রস্তাব করেন বা নিজেই এই পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে রাজনীতি থেকেই যে তিনি কেবল মাইনাস হয়ে যাবেন ব্যাপারটা তা নয়, বরং তাকে এর চেয়েও ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে।

রাজনীতিতে বিশেষ ব্যক্তি বা পরিবারের প্রতি এই আস্থা কেবল বাংলাদেশ বা এই উপমহাদেশেই নয়, ইউরোপ-আমেরিকায়ও রয়েছে। কোনও একজন তার ক্যারিশমায় সে দেশের জনগণের কাছে নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেলে তার উত্তরাধিকার দেশের রাজনীতিতে আবির্ভূত হন। তবে সেই উত্তরাধিকার প্রকৃত অর্থেই যোগ্য হলে এ নিয়ে সমালোচনার অবকাশ থাকে না। কিন্তু যোগ্যতা না থাকার পরও যখন কেবল এই পারিবারিক পরিচয় সম্বল করে রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেন, তখনই পরিবারতন্ত্রের সমালোচনা হয়। ফলে পরিবারতন্ত্রের ভালোমন্দ নির্ভর করে ব্যক্তির ওপর।

আবার দলগুলোর ভেতর যখন গণতন্ত্র থাকে এবং যদি দলের সদস্যদের গোপন ভোটে রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়, তখন পরিবারতন্ত্র নিয়ে কোনও সমালোচনা হয় না। ফলে আমাদের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র শব্দটি খারাপ অর্থে ব্যবহৃত হওয়ার প্রধান কারণ দলের ভেতরে গণতন্ত্র না থাকা।

২.

আগামী ২২ ও ২৩ অক্টোবর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হবে আওয়ামী লীগের ২০ তম ত্রিবার্ষিক কাউন্সিল। ৬৭ বছরের পুরনো এবং দেশের বৃহত্তম এই রাজনৈতিক দলের কাউন্সিল নিয়ে রাজনীতি সচেতন মানুষের আগ্রহ নানা কারণে। একটা বড় কারণ সম্ভবত এই যে, শেখ হাসিনার পরে আওয়ামী লীগের কাণ্ডারি কে হবেন, সেটির কিছুটা ইঙ্গিত মিলবে যদি তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বা তার বোন শেখ রেহানা অথবা তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ অথবা পরিবারের অন্য কাউকে দলের কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়।

আগ্রহের আরেকটি কারণ এই যে, দলের গঠনতন্ত্র ও নেতৃত্বে বড় কোনও পরিবর্তন আসবে কি না, সেটিওর ইঙ্গিত মিলতে পারে। ২০১৯ সালের শুরুতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। অর্থাৎ ধরে নেওয়া যায় যে সেই নির্বাচনের আগে এটিই ক্ষমতাসীনদের শেষ কাউন্সিল। সুতরাং কারা এবার প্রেসিডিয়ামে আসছেন, থাকছেন কী বাদ পড়ছেন; উপদেষ্টা এবং সম্পাদকমণ্ডলীতে কোনও পরিবর্তন আসছে কিনা, ইত্যাদি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা নতুন এই কমিটির ওপরেই নির্ভর করবে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কোন কৌশলে এগোবে, তার অনেকটা।

প্রশ্ন হলো, এই যে নিয়মিত বিরতিতে রাজনৈতিক দলের কাউন্সিল হয়, তার আসলে গুরুত্ব কতটা, যেখানে দলীয় প্রধান কে হবেন, তা আগে থেকেই নির্ধারিত? সাধারণ সম্পাদক বা মহাসচিব কে হবেন, সেই সিদ্ধান্ত যেখানে দলীয় প্রধানের; যেখানে সাধারণ নেতকার্মীদের মতামত দেওয়ার কোনও সুযোগ বা সাহস কোনোটাই নেই; প্রেসিডিয়াম বা স্থায়ী কমিটিতে কারা জায়গা পাবেন আর কারা মাইনাস হবেন, সেই সিদ্ধান্তও যেখানে দলীয় প্রধানের, সেখানে এই কাউন্সিল কি শুধুই নিয়ম রক্ষার?

দলীয় কাউন্সিলের একটা বড় লক্ষ্য হয়তো এই যে, একসঙ্গে সারা দেশের নেতাকর্মীরা জমায়েত হন। এবার আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে নেতাকর্মী আর অতিথি মিলিয়ে প্রায় ৫০ হাজার লোক উপস্থিত হবেন বলে দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। এটি একটি বিশাল জমায়েত এবং বিশাল শোডাউন। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর সামনে নেতারা ভাষণ দেবেন। কী কী করেছেন তার ফিরিস্তি দেবেন। বিরোধী রাজনৈতিক দলের বিষোদ্গার করবেন। আর আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলবেন। এই ফাঁকে ফাঁকে কাউন্সিলরা অবশ্য ভোটও দেবেন। কিন্তু সাধারণ নেতাকর্মীদের সেই ভোটের ফলাফলে দলের প্রধান, সাধারণ সম্পাদক, প্রেসিডিয়াম সদস্যদের ভাগ্য নির্ধারিত হবে, ব্যাপারটা এমন নয়। ফলে এসব কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র আসলে কতটা বিকশিত হয় সেটিও একটি বড় প্রশ্ন।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে যেসব অঙ্গীকার করা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম 'সংসদীয় গণতন্ত্রের সুস্থ বিকাশ ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান। জনগণের পছন্দমতো ভোটাধিকার প্রয়োগের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।’ যদি তাই হয়, তাহলে প্রশ্ন ওঠে, সীমিত গণতন্ত্রের ভেতরে গত কয়েক বছর ধরে দেশে যে ধরনের রাজনৈতিক চর্চা চলছে, সেখানে সংসদীয় গণতন্ত্র আসলেই কতটা বিকশিত হচ্ছে এবং জনগণের পছন্দমতো ভোটাধিকার প্রয়োগের যে স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে, সেই স্বাধীনতাই বা জাতীয় কাউন্সিলের নেতাকর্মীরা কতটা প্রয়োগ করতে পারবেন?

বলা হয়, এসব কাউন্সিলে আগামীর নেতাদের হাতে দায়িত্ব তুলে দেয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, স্থানীয় পর্যায়ে কারা রাজনীতিতে আসছেন এবং কারা নেতা হচ্ছেন? আপনি আপনার জেলা শহরে খোঁজ নিয়ে দেখুন, বড় দুটি দলের নেতৃত্বে কারা আছেন? বড় দুটি দলের ছাত্র ও যুব সংগঠনে কারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন? কী তাদের যোগ্যতা, শিক্ষা, পারিবারিক মূল্যবোধ, মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, কী তাদের সততা? খোঁজ নিলে দেখবেন, এদের অধিকাংশই মানুষ হিসেবে আপ টু দ্য মার্ক নন।

ভালো মানুষ, শিক্ষিক, নীতিবান লোকেরা প্রথমত রাজনীতিতে আসছেন না; আবার অল্পবিস্তর যারা আছেন, তারা কোনও বড় পদ পান না। কারণ পদ পাওয়ার জন্য যোগ্যতাই শেষ কথা নয়। পয়সার বিনিময়ে যেমন নির্বাচনের মনোনয়ন পাওয়া যায়, তেমনি এখন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় পর্যায়ের পদ পেতেও মোটা অংকের লেনদেন চলে। তার সাথে লাগে নিঃশর্ত আনুগত্য।

এই যখন সামগ্রিক রাজনীতির চিত্র, সেখানে ৫০ হাজার কিংবা এক লাখ মানুষের জমায়েত করে জাতীয় কাউন্সিল গণমাধ্যমের বড় শিরোনাম হয়তো হয়, কিন্তু আখেরে রাজনীতি কতটা লাভবান হয়, গণতন্ত্র কতটা উপকৃত হয়, এই রাজনীতি দেশের মানুষের ভাগ্যের আসলে কী পরিবর্তন আনে- সেই প্রশ্ন ২০ বছর আগে যেমন ছিল, এখনও আছে।

লেখক: যুগ্মবার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
লাগাতার তাপদাহে যশোরে জনজীবন দুর্ভোগে
লাগাতার তাপদাহে যশোরে জনজীবন দুর্ভোগে
জেলেনস্কিকে হত্যার পরিকল্পনায় জড়িত অভিযোগে পোলিশ নাগরিক গ্রেফতার
জেলেনস্কিকে হত্যার পরিকল্পনায় জড়িত অভিযোগে পোলিশ নাগরিক গ্রেফতার
বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিলেন মিয়ানমারের আরও ১৩ সীমান্তরক্ষী
বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিলেন মিয়ানমারের আরও ১৩ সীমান্তরক্ষী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ