X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

৬৭ বছরের আওয়ামী লীগ

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
২০ অক্টোবর ২০১৬, ১১:৪৭আপডেট : ২০ অক্টোবর ২০১৬, ১২:০৪

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন রোজ গার্ডেনের আঙিনায় আওয়ামী লীগের জন্ম। এখন আওয়ামী লীগের বয়স ৬৭ বছর। এর মাঝে দলটার ১৯টা সম্মেলন হয়েছে। আগামী ২২ ও ২৩ অক্টোবর ২০১৬ হবে ২০তম সম্মেলন। এ সম্মেলন উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে মনোরমভাবে সাজানো হয়েছে। এমন সাজগোজের মাঝে আওয়ামী লীগ কখনও সম্মেলন করেনি।
আওয়ামী লীগ ছিল সদা-সর্বদা মধ্যবিত্তের দল। শিক্ষক, ছোট ডাক্তার, কৃষক এরাই ছিল আওয়ামী লীগের লোক। তালেব আলী মাস্টার, কফিল উদ্দিন মাস্টার, আহসানুল্লাহ্ মাস্টার, কামরুজ্জামান মাস্টার এরা বারবার সংসদেরও সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ পরিপূর্ণভাবে মধ্যবিত্তের প্রতিনিধিত্ব করা দল।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে ২৯৮ জন এবং পাকিস্তান পরিষদে ১৬০ জন সর্বমোট ৪৫৮ জন উভয় পরিষদে আওয়ামী লীগের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাদের মাঝে একশতাংশ সদস্যও উচ্চবিত্তের লোক ছিলেন না। আমার নিজ এলাকার সংসদ সদস্য ছিলেন মরহুম আব্দুল ওহাব। তিনি পরিপূর্ণভাবে একজন কৃষকের ঘরের সন্তান এবং তাকে আমি নিজে মাঠে কৃষিকাজ করতে দেখেছি।
মরহুম আব্দুল ওহাব সাহেব ১৯৭০ সালের এবং ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে সংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ১৯৫৬ সালে জেলা পরিষদের নির্বাচনে মরহুম ফজলুল কাদের চৌধুরীকে পরাজিত করে জেলা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রত্যেক বারই তার নির্বাচনি খরচ সামাল দেওয়ার জন্য কর্মীরা বাজারে বাজারে বক্স কালেকশন করত। পরবর্তী সময়ে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিও হয়েছিলেন তখন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বর্তমান গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররাফ হোসেন।
আমাদের উত্তর পাশের কেন্দ্রে ১৯৭৩ সালে সংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন বাদশা আলম। তিনিও কৃষিকাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। আমাদের পূর্বপাশের কেন্দ্রে ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন আব্দুল্লাহ আল হারুন। তিনি ছিলেন একজন ছোট খাট ব্যবসায়ী। পাবলিক হেলথ এ ঠিকাদারী করতেন। উচ্চস্তরের কোনও ঠিকাদার নন। তার পরের কেন্দ্রের ১৯৭০ ও ৭৩ সালের এমপি ছিলেন ডা. আবুল কাসেম। তিনি ছিলেন একজন এলএমএফ ডাক্তার।
আমি কয়েকজন সংসদ সদস্যের কথা লিখলাম- এটা বুঝাতে যে আওয়ামী লীগ ছিল মধ্যবিত্তের সংগঠন। এরা সবাই ছিলেন আত্মত্যাগী রাজনৈতিক কর্মী। মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গকারী লোক। কোনও দুর্নীতি তাদেরকে কখনও স্পর্শ করেনি।
রাজনীতিতে মধ্যবিত্তের আধিপত্য ধ্বংস হয়ে যায় ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর। দুই মিলিটারি একনায়ক জিয়াউর রহমান আর এরশাদ মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক কর্মীদের হাতে থেকে রাজনীতি ছিনিয়ে নেয় এবং রাজনীতিকে ব্যবসায়ী, টাউট, বাটপার এর হাতে তুলে দেয়। ধীরে ধীরে রাজনীতিতে দুর্নীতি প্রবেশ করে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে রাজনীতি আর দুর্নীতি একাকার হয়ে যায়। নির্বাচনে জেতার জন্য শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগও এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে আপোষ করে। বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত রাজনীতিকে আর পরিচ্ছন্ন করার আশা কেউ করতে পারেন না।

বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে ১৮/১৯ জন নেতা রয়েছেন। তারা সবাই প্রায় কোটি কোটি টাকার মালিক। বাংলাদেশে বামপন্থী যে সব সংগঠন রয়েছে তারা এখনও রাজনীতি স্বচ্ছ পথে করার চেষ্টা করে। কমিউনিস্ট পার্টি এ ধারার একটি দল। কমিউনিস্ট পার্টিও প্রাচীন দল। ১৯২৫ সালের কমিউনিস্ট পার্টির এ উপমহাদেশে যাত্রা শুরু। বহুত্যাগী কর্মীর সমাবেশ ছিল এ দলটিতে। দলটি প্রথমে বিভক্ত হলো সোভিয়েতপন্থী আর চীনাপন্থী হিসাবে। চীনপন্থীরা আরও বহুধারা উপধারায় বিভক্ত হয়ে মাইক্রোসকপিক অবজারভেশনে চলে গেছে।

সোভিয়েতের পতনের পর সোভিয়েতপন্থীরাও অবলুপ্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কিন্তু বর্তমান সভাপতি মোজাহিদুল ইসলাম সেলিমের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ দলটিকে বাঁচিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কমরেড সেলিমের সাহসিক সিদ্ধান্তের কারণে দলটি এখনও জীবিত রয়েছে এবং নিজেদেরকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু ২০১৩ ও ২০১৪ সালের বিএনপি জামায়াতের আন্দোলনের সময় এ দলটির অস্পষ্ট অবস্থান তার প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। সম্ভবতো ১৯৬৫ সালে তারা ইন্দোনেশিয়ায় নাহদাতুল উলামার ভূমিকা বিস্মৃত হয়েছিলেন।

মুসলিম লীগ ১৯০৬ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত। এ দলটিও এখন প্রায় অবলুপ্ত। মুসলিম লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির পরই এদেশে আওয়ামী লীগ তৃতীয় প্রাচীনতম দল। যাত্রালগ্নে আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন মওলানা আব্দুল হামিদ খাঁন ভাসানী। মাওলানা ভাসানী ছিলেন কংগ্রেস নেতা মওলানা হাসরত মোহানীর মতো। বামপন্থীদের প্রতি তার দুর্বলতা ছিল। তাই দেখা যায় কমিউনিস্টরা দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল। অবশ্য তখন কমিউনিস্ট পার্টিও ব্যান ছিল। ১৯৫৬ সালেই কাগমারী সম্মেলনে আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রত্যক্ষভাবে অনুভূত হয় এবং মওলানার নেতৃত্বে কমিউনিস্টরা ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ থেকে পৃথক হয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন। জাতীয়তাবাদীরা পরিপূর্ণভাবে আওয়ামী লীগ থেকে যায়।

ভাসানীর নেতৃত্বে কমিউনিস্টদের পৃথক হয়ে যাওয়া ছিল শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের জাতীয়তাবাদী অংশের জন্য আশীর্বাদ। নতুবা তারা আওয়ামী লীগকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করতে পারতেন না। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুও শেখ মুজিবের জন্য আশীর্বাদের মতো ছিল। কারণ সোহরাওয়ার্দী জীবিত থাকলে এনডিএফ-এর কাঠামো থেকে আওয়ামী লীগকে বের করে আনা সম্ভব ছিল না। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর ৪০ দিন পর ঘোড়দৌড়ের মাঠে চালিশার পার্বনটি সম্পন্ন করেই শেখ মুজিব ৪৩ দিনের মাথায় আওয়ামী লীগ পুনজীবিত না করলে এনডিএফ-এর কাঠামোয় সংগঠন করা সম্ভব ছিল না।

১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিব সংগঠন গড়ে তুলেন এবং ১৯৬৬ সালের ইডেনের কাউন্সিলে ৬ দফা পেশ করেন। ইডেন কাউন্সিল ৬ দফাকে ম্যাগনাকাটা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ইডেন কাউন্সিল ছিল ঐতিহাসিক কাউন্সিল কারণ এ কাউন্সিল ছিল আওয়ামী লীগ ও বাঙালি জাতির জীবনের টার্নিং পয়েন্ট সৃষ্টির কাউন্সিল। এই কাউন্সিলে যারা কর্মকর্তা নির্বাচিত হয়েছিলেন দু’চারজন ব্যতিত শেষ পর্যন্ত তারাই হয়েছিলেন স্বাধীনতার স্থপতি।

১৯৬৬ সালের ৬ দফা গৃহীত হওয়ার পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান এতই বিচলিত হয়েছিলেন যে তিনি প্রকাশ্যে বলাবলি আরম্ভ করেছিলেন শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ যদি ৬ দফা নিয়ে বাড়াবাড়ি করেন তবে অস্ত্রের ভাষায় তার জবাব দেওয়া হবে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যরাত থেকে পাকিস্তানিরা অস্ত্রের ভাষায় জবাব দিয়েছিলেন।

বাঙালিরাও পাল্টা জবাব দিয়েছিল অস্ত্রের ভাষায়। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। আর সে স্বাধীনতা আওয়ামী লীগ সাধারণ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এনে দিয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বঙ্গবন্ধু আর আওয়ামী লীগ কথা দিলে কথা রাখে জীবনের বিনিময়ে হলেও। বর্তমান প্রজন্মের আওয়ামী লীগের কর্মীদের উচিৎ হবে পূর্ববর্তী নেতৃত্বের সে দৃঢ়তার ওপর কায়েম থাকা।

২০তম কাউন্সিলের শপথ হোক এটাই।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ