X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

নেতৃত্বে তারুণ্য : আমরা প্রত্যেকেই একজন নেতা

রাশেদা রওনক খান
২১ অক্টোবর ২০১৬, ১২:৫০আপডেট : ১৩ জুন ২০১৭, ১৬:৫৩

রাশেদা রওনক খান

বাঙালিদের নিয়ে একটা কথা প্রচলিত আছে: দুজন বাঙালি এক জায়গায় থাকলে দুই দলে বিভক্ত হয়ে দুজনই নেতা হতে চায়! আমাদের সবার কেন যেন সাংগঠনিক পদের প্রতি সব দুর্বলতা! যারা নেতা হতে চায়, তারা এই একটা জায়গায় আটকে থাকেন, তা হলো- দলে বড় পদ পাওয়া! আমাদের দেশের বিভিন্ন দলের বিশেষ করে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির জাতীয় সম্মেলনে দলের তৃণমূল হতে কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত নেতৃত্ব নির্বাচনে চলে দলাবাজি, পারস্পরিক কোন্দল, কাঁদা ছোড়াছুড়ি। এতকাল ধরে যে এইধরনের দলাবাজি, দলীয় কোন্দল ছিল না তা নয়। কিন্তু তা অনেকটাই জনসাধারণের কাছে দৃশ্যমান ছিল না।

হয়তো বড়জোর পত্রিকার পাতায় সম্মেলনে চেয়ার ছোড়াছুড়ির খবর পড়তাম। কিন্তু বর্তমানে ফেসবুকের কল্যাণে পারস্পরিক দ্বন্দ্বের ধরন আমাদের কাছে অনেকটাই উন্মোচিত। অনেক নেতাকর্মীকেই পারস্পরিক নিন্দামূলক স্ট্যাটাস দিতে দেখছি। তারুণ্যের কাছে এটা আশা করি না কোনোভাবেই। তারুণ্য যদি তার আগের প্রজন্মকেই অনুসরণ করে চলে, তবে তারুণ্যের আর নতুনত্ব কি রইলো? তাছাড়া, একটা দলের পক্ষে তো সবাইকে নেতা বানানো সম্ভব না। কিন্তু এই বাস্তবতাকে ভুলে সবাই নেতাই হতে চায়। ফলে শুরু হয় দলাবাজি, দলীয় কোন্দল, পারস্পরিক রেষারেষি।

নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া-না পাওয়ার ক্ষেত্রেও চিত্রটি একইরকম। নিজেদের ভেতরেই শুরু হয় শত্রুতা। সেই শত্রুতা শেষ পর্যন্ত ফেসবুকের পাতা হতে খুনা-খুনিতে গিয়ে পর্যন্ত পৌঁছে। তা আমরা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনেই দেখেছি। 

আমার মতে, এই ধরনের ঘটনাগুলো থেকে মুক্তি লাভের জন্য তারুণ্যের সামনে দুটো পথ খোলা। প্রথমত, যে যার জায়গায় নেতা হয়ে ওঠা। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, নেতৃত্বের জন্য নিজেকে সঠিকভাবে তৈরি করে নেওয়া। তারুণ্য চাইলে দুটোকে একসাথে নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে, কিংবা যেকোনও একটি বেছে নিতে পারে।

প্রথম পথটি একটু ভিন্ন এবং তার জন্য সাহসী হতে হবে নিজেকে। এই যে তৃণমূল হতে কেন্দ্রে জায়গা পাওয়া, ক্ষমতাবান হওয়া, প্রতিনিধি হওয়া, দলের মনোনয়ন পাওয়া- এই নিয়েই চলে জোর তদবির, পারস্পরিক হানা-হানি। এসব ক্ষেত্রে ‘জনপ্রিয়তা’কে প্রাধান্য না দিয়ে 'নির্বাচন' এর চেয়ে 'বাছাই' কে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে অনেকেই মনে করেন। বিশেষ করে এই মুহূর্তের রাজনীতি যেভাবে বাণিজ্যিক রূপ ধারণ করেছে, সেখানে ‘জনপ্রিয়তা’, ‘সততা’, কিংবা ‘নির্বাচিত’ নেতার চেয়ে ‘হাইব্রিড’ নেতাদের চাহিদা বেশি হওয়া নিয়েও অনেকে ফেসবুকে আক্ষেপ করছেন। কিন্তু আমি তারুণ্যের এই আক্ষেপকে শক্তিতে পরিণত করতেই বেশি আগ্রহী। 

মনে রাখতে হবে, তারুণ্যের একটা নিজস্ব অহংকার আছে, সেই অহংকার এবং আত্মমর্যাদাকে বিকিয়ে দেওয়ার মাঝে কোনও প্রাপ্তি থাকলেও তা সাময়িক এবং তাতে কোনও মর্যাদা নেই। যে প্রাপ্তিতে নিজের আত্মমর্যাদা থাকে না, সেই প্রাপ্তির কোনও মূল্যও নেই। আর এই ধরনের প্রাপ্তিতে সাময়িক আনন্দ থাকলেও নিজের আলোয় উদ্ভাসিত হওয়ার মতো কোনও শক্তি নেই। আর নিজের জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত না হতে পারলে অন্যের আলো ধার করে 'হাইব্রিড' নেতা হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু 'নেতা' হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। 

'যোগ্যতার' ভিত্তিতে হওয়ার চেয়ে অন্যের তদবিরে নেতৃত্বে আসা কতটা সম্মানের এবং সন্তুষ্টির, তা ভাবার সময় এখন তারুণ্যের। ফলে  কোন্দলের মধ্যদিয়ে যে নেতৃত্ব পাওয়া যায়, তার জন্য অনেকের তল্পিবাহক হয়ে থাকতে হয়। তারুণ্য কখনোই তল্পিবাহক হতে পারেনা। অন্যের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার চেয়ে 'নিজে'র ওপর নির্ভরশীল হওয়াটা অনেক জরুরি। যদি আমরা প্রত্যেকে আমাদের নিজেদের কাজটা ভালোভাবে করি, তাহলে একজন ব্যক্তিকে সারাক্ষণ অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হচ্ছে না। এটা কেবল রাজনীতির ক্ষেত্রে নয়, জীবনের সকল ক্ষেত্রেই। যদি আমরা প্রত্যেকে যার যার কাজকে সম্মানের চোখে দেখি, নিজের কাজে ফাঁকি না দেই, নিজের কাজটিকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে, হৃদয় দিয়ে করার চেষ্টা করি, তাহলে দিন শেষে তার সন্মান ব্যক্তির কাছে আসবেই। কেননা, তার সেই জায়গায় তিনিই নেতা, আর কেউ নন।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমাদের সবার লক্ষ্য একটা জায়গায় স্থির হয়ে আছে তা হলো 'ক্ষমতার কাছাকাছি যাওয়া'। প্রত্যেকেই যার যার জায়গায় নেতা হয়ে উঠতে পারি, কিন্তু তা না করে এক জায়গায় গিয়ে নেতা হতে চাই। কেন আমরা ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় যেতে চাইনা? কেন আমাদের ভেতরে ভিন্নভাবে চিন্তা করার, ভিন্ন পথে হেঁটে যাওয়ার মতো বিকল্প রাস্তা খুঁজে পেতে মন চায় না, সেই প্রশ্ন তারুণ্যের কাছে রইলো ।

যে পথে সবাই হাঁটছে, তা থেকে ভিন্ন অপরিচিত পথে হাঁটার সাহস এবং উদ্ভাবনী শক্তিতো কেবল তারুণ্যেরই থাকার কথা। পুরাতনের জীর্ণতায় আটকে না থেকে নিজের মতো করে নতুনের হাওয়ায় উড়ে যাওয়ার দিন তো আমাদেরই। দেশকে নিয়ে কাজ করার অনেক পন্থা আছে, এমন কী ভালোবাসার দলকে নিয়েও কাজ করা যায়! কিন্তু তার জন্য আমাদেরকে দলের ভেতরে থেকে মারামারি, খুনা-খুনি করেই জায়গা পেতে হবে, এই ভাবনা হতে আমরা কবে বের হতে পারবো?

যে দলকে সত্যিই ভালোবাসে, সে দলের বাইরে থেকেও দলের জন্য কাজ করতে পারে। আর যে দলকে ভালোবাসে না, কিন্তু দল হতে সকল সুযোগ-সুবিধা নেয়, সে দলের বড় পদ দখল করেও দলের জন্য কিছুই করতে পারে না, বরং কেউ কেউ দলের ইমেজও নষ্ট করতে পারে! কেননা, এখন দলের নেতারা কিছুটা যুক্ত থাকলেও কর্মীরা কেবল বিভিন্ন দিবস উদযাপন ও নির্বাচনের সময় প্রচারাভিযানের মতো কর্মকাণ্ডেই নিজেদের সম্পৃক্ত করেন । নেতা কর্মীদের মাঝে অনেককেই পাওয়া যাবে যারা কেবল তাদের পদ-পদবি ব্যবহার করে চাঁদাবাজি, তদবির বাণিজ্য কিংবা সুবিধা আদায়ে জড়িত থাকে। এ ধরনের কাজ একদিকে যেমন সরকারি দলকে জনগণ হতে বিযুক্ত করে, অন্যদিকে দলের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হয়। এই নেতা কর্মীরা আবার যখন দল ক্ষমতায় না থাকে, তখন অনেকেই নিজেদের আড়ালে নিয়ে যায় কিংবা দল থেকে সরে পড়ে অথবা নতুন নির্বাচিত দলে যোগ দেয়। তাই নেতা নির্বাচনে দলেরও অনেক দায়িত্ব রয়েছে, সেই দায়িত্ব দলগুলো কতটা পালন করছে, তা এখন দলকেই ভাবতে হবে। যেসব তরুণেরা দলকে প্রকৃত অর্থেই ভালোবাসে, তারা দলে জায়গা পাওয়া না পাওয়া নিয়ে চিন্তা না করে কাজ করে যাক- এই হোক তারুণ্যের রাজনীতির মূলমন্ত্র। একদিন না একদিন দলই তাকে তার নিজ যোগ্যতার কারণে নেতৃত্ব এর জন্য ডাকবে, অন্তত স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ একজন প্রকৃত নেতাকে মূল্যায়ন করবে না, এটা মেনে নেওয়া যায় না। 

 এবার দ্বিতীয় পথ প্রসঙ্গে আসি- ‘নিজেকে নেতা তৈরি করা’। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা একটি স্কুলে ভাষণ দিতে গিয়ে বলছেন, ‘আমি খুব বেশি ভালো ছাত্র ছিলাম না, আমার সামনে কোনও লক্ষ্য ছিল না। আমার মা একজন নৃবিজ্ঞানী! তিনি একদিন আমায় ডেকে বললেন, তোমার ভালো ফলাফল করতে হবে, তা আমি বলছিনা, কিন্তু তোমাকে অবশ্যই একটা 'লক্ষ্য' স্থির করতে হবে!  তা না হলে তুমি ভুল পথে যাবে! কথাটা আমার খুব মনে ধরলো! আমি সেদিন হতে আমার 'লক্ষ্য' স্থির করলাম, হয়তো এই জন্যই আজ আমি এখানে!’

তার সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত হয়ে বলছি,  আমরা বাবা-মায়েরা এবং শিক্ষক সমাজ বাচ্চাদের এ প্লাস পাওয়ার জন্য চাপ না দিয়ে যদি সঠিক 'জ্ঞান লাভ' এবং 'লক্ষ্য' স্থির করতে উৎসাহিত করি, তাহলে আজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলের  এতটা হত না! রাজনীতিতেও এতটা অসুস্থ পরিবেশ দেখতে হত না! সমাজের সকল ক্ষেত্রেই যেন 'লক্ষ্যহীন' এক তরুণ সমাজ তৈরির পাঁয়তারা চলছে। এ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে আমাদের এখনই সজাগ হতে হবে। প্রত্যেকটি তরুণের মাঝে একটি 'লক্ষ্য' থাকতে হবে, আর সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য নিজেকে তৈরি করতে হবে নিজস্ব জ্ঞান-গরিমায়, মেধায়-প্রজ্ঞায়, চিন্তায়-চেতনায়, সৃজনশীলতায়-ব্যক্তিতে-সকল ক্ষেত্রে চাই অনন্যতা। 

তাই 'নেতা' হতে হলে সেইভাবেই নিজেকে তৈরি করতে হবে 'নেতৃত্ব' প্রদানের জন্য।  কারণ আমরা যোগ্য, জ্ঞানী, সৃজনশীল, মেধাবী এবং বিশুদ্ধ নেতৃত্ব চাই আমাদের আগামীর বাংলাদেশের জন্য। 

লেখক: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসবে, আশা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসবে, আশা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন উপাচার্য
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন উপাচার্য
স্লিপিং ট্যাবলেট খেলেও ভূতের ভয়ে সরকারের ঘুম আসে না: গয়েশ্বর
স্লিপিং ট্যাবলেট খেলেও ভূতের ভয়ে সরকারের ঘুম আসে না: গয়েশ্বর
অবন্তিকার আত্মহত্যা: প্রশাসনকে লালকার্ড দেখালেন শিক্ষার্থীরা
অবন্তিকার আত্মহত্যা: প্রশাসনকে লালকার্ড দেখালেন শিক্ষার্থীরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ