X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনীতির বাইরে

হারুন উর রশীদ
২২ অক্টোবর ২০১৬, ১৫:১৬আপডেট : ২২ অক্টোবর ২০১৬, ১৫:৪৮

হারুন উর রশীদ গত কয়েক রাত যারা ঢাকার রাস্তায় ঘোরাঘুরি করেছেন বা সন্ধ্যার পর বাইরে ছিলেন তারা অবাক হয়েছেন কিনা জানি না। তবে আমি অবাক হয়েছি। হয়েছি বিস্মিত। ইতিবাচকভাবে বললে বলতে হয় যেন ‘ঈদ উৎসব’। আর যদি একটু ক্রিটিক্যালি যাই তাহলে প্রশ্ন করতে পারি এই আলোকোজ্জ্বল রাজধানীর বাড়তি বিদ্যুৎ বিল কে দেবে? এই সাজসজ্জার অর্থ কোথা থেকে আসলো? আওয়ামী লীগের সম্মেলনের যা বাজেট শুনেছি তা দিয়েতো বিদ্যুৎ বিলই দেওয়া সম্ভব নয়। বাকি খরচ মিটছে কিভাবে?
১. প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সম্মেলনের প্রস্তুতি পর্যায়ে নাকি মঞ্চ ও সাজসজ্জা উপ-কমিটিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘সাজসজ্জার এতো টাকা কোথায় পাও, কোথা থেকে আসবে’। তিনি বলেছিলেন বাজেটের মধ্যে থেকেই সম্মেলন আয়োজন করতে। আর হুশিয়ার করে দিয়েছিলেন সম্মেলনের নামে যেন কোনও চাঁদাবাজি না হয়। কিন্তু বিদ্যুৎতো রাষ্ট্রের। সরকারের বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো কার নির্দেশে ঢাকায় সপ্তাহব্যাপী নজীরবিহীন এই আলোক সজ্জার অনুমতি এবং সংযোগ দিলো। এই আলোকসজ্জার কোটি কোটি টাকা বিদ্যুৎ বিল কে দেবে? আওয়ামী লীগ না সরকারের কোষাগার থেকে দেওয়া হবে? না বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হবে, বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়। আর এই আলোক সজ্জায় বিদ্যুৎ বিভাগের যে শত শত কর্মচারী সপ্তাহ ধরে রাত দিন কাজ করছেন তারা কি আওয়ামী লীগের কর্মচারী না সরকারের? যদি সরকারের হয়ে থাকে তাহলে তাদের জরুরি সেবা বা ওভার টাইমের যে বিপুল পরিমাণ অর্থ তা কে দেবে? আর দলীয় কাজে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা কেন যুক্ত হবেন?
২. রাজধানীর অলিগলি থেকে শুরু করে প্রধান সড়ক, বেসরকারি-সরকারি ভবন, গাছপালা সবখানেই সম্মেলনের পোস্টার, ব্যানার, বিলবোর্ড, ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ড। এর খরচের হিসাব করার চেষ্টা না হয় নাই করলাম। তারচেয়ে দুই সিটি মেয়রের কাছে একটি কমন প্রশ্ন করি। উত্তরের মেয়র আনিসুল হক বলেছিলেন তার এলাকায় পোস্টার ব্যানার লাগতেই দেবেন না। মেয়র সাহেব এখন কি কিছু বলছেন! আপনার প্রতিশ্রুতি কি আওয়ামী লীগের সম্মেলনের পরে বাস্তবায়ন শুরু করবেন?  আর দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনও কোনও কথা বলছেন না। তারা যে মেয়র তা হয়তো আপাতত তাদের মাথায় নেই। সাঈদ খোকন বলেছেন, এসবের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছে। মাননীয় মেয়র আবেদনটা করলো কে? সাধারণ নাগরিক দেয়ালে পোস্টার বা সড়কে ব্যানার লাগালে আইন বাধা দেবে। কিন্তু আওয়ামী লীগের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা! নির্বাচন কমিশনতো বেঁচে গেল। কারণ এটার সঙ্গে নির্বাচনের বিষয় নেই! আর সম্মেলনের পর এই ব্যানার-পোস্টার অপসারণে আমি নিশ্চিত দুই মেয়র পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু করবেন। তখন তারা সংবাদ মাধ্যমে কাভারেজ নেবেন। আমার প্রশ্ন পরিচ্ছন্নতা অভিযানের সেই খরচ কে দেবে? সিটি কর্পারেশনের পয়সায় এই পরিচ্ছন্নতা কেন হবে? এরজন্য কি দুই মেয়র আওয়ামী লীগের কাছ থেকে পরিচ্ছন্নতা খরচ দাবি করবেন?

৩. ঢাকাকে অন্যরকম লাগছে। প্রধান প্রধান সড়ক বন্ধ। সম্মেলন কেন্দ্র সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সাধারণের প্রবেশ বন্ধ করা হয় দু’দিন আগে থেকেই। সম্মেলনের আশপাশের খোলা রাস্তায় শনিবার সম্মেলন শুরুর অনেক আগে থেকেই ভোগান্তিতে পড়েন সংলগ্ন এলাকার রাস্তা ব্যবহারকারী নগরবাসী। আর রাজধানীর অন্য অংশে বিপরীত চিত্র। রাস্তাঘাট ফাঁকা। কোনও যানবাহন নাই। যারা বাইরে বের হয়েছেন তারা ঠায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও কোনও যানবাহন পাননি। আর কেন যেন প্রাইভেট কার তেমন বের হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম বাস- মিনিবাস মালিকদের আগেই বলে রাখা হয়েছে তারা যেন পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বের না করেন। খালি সম্মেলনের কাজে লাগলে আলাদা কথা। আর প্রাইভেট কার নাকি বের হয়নি ভয়ে। সব মিলিয়ে সম্মেলনের কারণে যানজট- ভোগান্তি এটা যাতে খবর না হয় সেজন্যই এই ব্যবস্থা বোধ করি। কিন্তু সম্মেলন ভোগান্তি থেকে রেহাই পায়নি নগরবাসী। 

৪. খবরে জানলাম আওয়ামী লীগের সম্মেলনের স্থলের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আছেন ১০ হাজার পুলিশ সদস্য। এর বাইরে র‌্যাব, সাদা পোশাকে পুলিশ। আছে সিসি ক্যামেরা ও টিভির নিরাপত্তা জাল। পুলিশের আইজি এবং ডিএমপি কমিশনার স্বয়ং এই সম্মেলনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে ব্রিফ করেছেন। সম্মেলনের আগের দিন বিকেল থেকেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নিয়ন্ত্রণ নেয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। আর কয়েকদিন ধরে পুলিশ যেন সম্মেলন নিয়ে ব্যস্ত। একটি রাজনৈতিক দলের সম্মেলন নিয়ে পুলিশের এই বিপুল আগ্রহ ভালো। তারা তো দেশের মানুষের নিরাপত্তার জন্যই আছেন। তবে সবখানে সব রাজনৈতিক দলের জন্য তাদের এই নিরাপত্তা আগ্রহ অতীতে দেখিনি। ভবিষ্যতে কি সবার জন্য তারা এভাবে আন্তরিক হবেন?

৫. আওয়ামী লীগের দু’দিনের এই সম্মেলনের প্রথমদিন ৩৫ হাজার এবং সমাপনী দিনে ১৫ হাজার প্যাকেট খাবারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে অফিসিয়ালি। আন অফিসিয়ালি আরও কত প্যাকেট তা আমার জানা নাই। তবে সেটা সমপরিমাণ হলেও হতে পারে। কারণ সম্মেলনের নিরাপত্তা বেষ্টনীর বাইরেও অনেক নেতাকর্মী রয়েছেন। জানা গেছে তাদের জন্যও ব্যবস্থা আছে। সে যাই হোক প্রতি প্যাকেট খাবারের দাম ধরা হয়েছে ৪৫০ টাকা। সেই হিসেবে অফিসিয়াল ৫০ হাজার প্যাকেট খাবারের দাম দুই কোটি ২৫ লাখ টাকা। এটা প্যাকেটের দাম পরিবহন খরচ আলাদা। আর সম্মেলনের ঘোষিত বাজেট দুই কোটি ৬৫ লাখ টাকা মাত্র। তাহলে সম্মেলনের অন্যান্য আয়োজনের খরচের টাকা আসছে কোথা থেকে। খাবার বাদে বাকি রাজসিক আয়োজনের খরচ মাত্র ৪০ লাখ টাকা!

৬. ঢাকায় আওয়ামী লীগের সম্মেলন উপলক্ষে এলইডি ডিসপ্লে বোর্ডই বসানো হয়েছে ২৫ টা। নৌকা প্রতীকের থিমে স্মরণকালের সুদৃশ্য মঞ্চ আর তোরণ বানানো হয়েছে। আছে অফসেট পেপারে আধুনিক প্রেসে ছাপা একাধিক প্রকাশনা। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায় শুধু সুদৃশ্য মঞ্চ তৈরিতেই ব্যয় হয়েছে এক কোটি টাকা। আর প্রকাশনা, ডিসপ্লে বোর্ড, তোরণ মিলিয়ে এই খাতে মোট খরচ সাকুল্যে ঘোষিত বাজেটের চারগুণেরও বেশি, ছয় সাত কোটি টাকা।

৭. এই সম্মেলনে বিদেশি মেহমানরা এসেছেন। তাদের সংখ্যা কম করে হলেও ৫০ জন। তারা মেহমান। তাদের আসা যাওয়া থাকা খাওয়া সবই পাঁচতারা মানের। তারাতো এটা নিজেদের পকেট থেকে খরচ করছেন না। আর মেহমানদের কাছ থেকে সেটাতো নেওয়াও যায় না। তারা সবাই উঠেছেন সোনারগাঁ হোটেলে। এই খাতে ঘোষিত বরাদ্দ ৪০ লাখ টাকা। কিন্তু বাস্তবে খরচ হচ্ছে আড়াই কোটি টাকা। তবে শোনা যাচ্ছে ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের নাকি মেহমানদারির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা যদি স্বেচ্ছায় এই দায়িত্ব নেন তাহলেতো আর আমরা একে চাঁদাবাজি বলতে পারবো না। আর আমাদেরতো অতিথি পরায়ণতার খ্যাতি আছে।

৮. আমরা এখনও সংবাদ মাধ্যমে এমন কোনও খবর দেখিনি যে আওয়ামী লীগের সম্মেলনের নামে চাঁদাবাজি হচ্ছে বা হয়েছে। তবে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে সম্মেলনের যে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে তা জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের কাছে নস্যি। এখানে সরকারের ব্যাপক সুবিধা দলীয় কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে রাষ্ট্রের সম্পদ এবং জনশক্তি। তাই আমার জানতে ইচ্ছে হয় দুই কোটি ৬৫ লাখ টাকায় আসলে কত টাকা হয়! সম্মেলনের পর এটা অডিট করলে জানা যাবে। জানা যাবে প্রকৃত কত খরচ হয়েছে আর কী পরিমাণ রাষ্ট্রের সম্পদ ব্যবহার করা হয়েছে। রাষ্ট্রের সম্পদ ব্যবহারের অনুমতি কারা দিয়েছেন। এর দামইবা কারা দেবেন? 

৯. সম্মেলনের বাজেট পরে রিভাইজ করা হয়েছে বলে আমরা শুনিনি বা সংবাদ মাধ্যমে কোনও খবরও দেখিনি। তাই বলা যায় শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনের বাজেট দুই কোটি ৬৫ লাখ টাকাই নির্ধারিত ছিল। তাই আশা করি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী সম্মেলনের পর বাজেট এবং আয়-ব্যয়ের অডিট বা নিরীক্ষার আদেশ দেবেন। কারণ তিনিই সম্মেলনের খরচের বহর নিয়ে প্রশ্ন তুলে দলীয় বাজেটের মধ্যে থেকে সম্মেলন আয়োজন করতে বলেছিলেন। আর হুশিয়ার করে দিয়েছিলেন সম্মেলনের নামে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে।

লেখক: সাংবাদিক

ইমেইল: [email protected]

আরও খবর: ‘দরিদ্রদের তালিকা পাঠান, ঘর করে দেবো’

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
উত্তর গাজায় আবারও হামলা জোরদার করলো ইসরায়েল
উত্তর গাজায় আবারও হামলা জোরদার করলো ইসরায়েল
ফরিদপুরে দুই নির্মাণ শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় বিএনপির তদন্ত কমিটি
ফরিদপুরে দুই নির্মাণ শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় বিএনপির তদন্ত কমিটি
বৃষ্টির জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়লেন মুসল্লিরা
বৃষ্টির জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়লেন মুসল্লিরা
সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিতে চাকরি, ৫ ক্যাটাগরির পদে নিয়োগ
সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিতে চাকরি, ৫ ক্যাটাগরির পদে নিয়োগ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ