X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভারত পাকিস্তান লড়াই

তসলিমা নাসরিন
২৩ অক্টোবর ২০১৬, ১১:২৮আপডেট : ২৩ অক্টোবর ২০১৬, ১১:৩০

তসলিমা নাসরিন ভারত আর পাকিস্তানের সম্পর্কটা  ইদানীং বড্ড তিক্ত হয়েছে। তিক্ততার শুরু পাকিস্তানি জঙ্গিরা ভারতের সেনা ছাউনিতে হামলা চালানোর পর থেকে। আক্রমণ দু’দিক থেকেই হচ্ছে।  দু’দেশেরই সেনা মারা পড়ছে।
এরমধ্যে পাকিস্তান নিষিদ্ধ করে দিয়েছে তাদের টেলিভিশনে ভারতীয় যত শো ছিল সব। এদিকে বলিউডের পরিচালক করন জহর জনতার সামনে হাত জোড় করে বলে দিলেন তিনি আর পাকিস্তানি শিল্পীদের নিয়ে সিনেমা বানাবেন না। এই নিয়ে তুমুল হট্টগোল।
কেউ কেউ বলছে পাকিস্তানের সব কিছু ব্যান করো, বয়কট করো। পাকিস্তানি শিল্পীদের নিয়ে সিনেমা বানানোর দরকার নেই। ভারতে শিল্পীর এমন কোনও অভাব পড়েনি যে পাকিস্তান থেকে শিল্পী আনতে হবে। ভারতে যেসব পাকিস্তানি শিল্পী আছে, তারা পাকিস্তানি জঙ্গি হামলার বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদ করছে না, মুশকিলটি এখানেই। শিল্পী হলে কী হবে, তারাও হয়ত মনে মনে জঙ্গিদের সমর্থন করে। কেউ কেউ বলছে, ওরা শিল্পী, ওরা তো সন্ত্রাসী নয়, ওদের ব্যান করা কেন? এই কেন’র কোনও ভালো উত্তর আপাতত শুনছি না। তুই দোষ করিস নি, কিন্তু তোর দেশি লোক করেছে--- এরকম একটি উত্তর ভাসা ভাসা শুনেছি।
আমি যদি পাকিস্তানি শিল্পী হতাম, আমি নিশ্চই ভারতে পাকিস্তানি সন্ত্রাসী হামলার নিন্দে করতাম। কিন্তু পাকিস্তানি শিল্পীরা কেন হামলার নিন্দে করছে না সেটা আমার জানা নেই। কেউ যদি সন্ত্রাসের প্রতিবাদ না করে, তাহলে তার সন্ত্রাসী হওয়ার বা সন্ত্রাসের সমর্থক হওয়ার সম্ভাবনা কতটা সেটাও আমার জানা নেই। ধরা যাক, পাকিস্তানি শিল্পীরা সন্ত্রাসী অথবা সন্ত্রাসের সমর্থক, তবে সে ক্ষেত্রে তাদের বয়কট করা তো বটেই, ব্যান করা, বিদেয় করা – সবই করা উচিত। কিন্তু যদি তারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মুখ না খুলে থাকে প্রাণের ভয়ে, তবে?
কোনও দোষ না করেও আমি জীবনভর ব্যান বয়কটের শিকার। নিরপরাধ কাউকে নিষিদ্ধ করা মানতে পারি না। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যে রাজনৈতিক সমস্যা আছে, তা রাজনৈতিক ভাবেই মীমাংসা করতে হবে। সাংস্কৃতিক আদান প্রদানটা বন্ধ করে দেওয়ার আমি কোনও কারণ দেখি না। অনেকে বলছে, দক্ষিণ আফ্রিকার এপারথেইড নিয়মের বিরুদ্ধে যেমন সারা পৃথিবী দাঁড়িয়েছিল, বয়কট করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকার সব কিছুকে, তেমনি করতে হবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। সব ব্যবসা বাণিজ্য, সব নাটক সিনেমা, সব গান বাজনা, সব আদান প্রদান বন্ধ করতে হবে। লড়াইটা বেশ জমে উঠেছে বটে। আমার  বড় ভয় হয় এসব দেখতে। দু’দেশের হাতেই আছে পারমাণবিক বোমা। কে না কে হঠাৎ টিপে দেয় বোতাম!

পাকিস্তানি  শিল্পীদের নিয়ে যেসব ছবি নির্মাণ করা হয়েছে, সেসব কারও দেখতে ইচ্ছে না হলে দেখবে না, কারো বা আবার ইচ্ছে হলে দেখবে। এই স্বাধীনতা সবারই থাকা উচিত। শিল্পীদের নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মত প্রকাশ করেছিলাম। এ কারণে ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের কাছ থেকে প্রচুর গালাগালি খেতে হয়েছে। চরম ডানপন্থীরা এমনই আগুন হয়েছে ক্ষেপে যে আমাকে ভারত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আদেশ দিয়েছে। নিজেকে প্রশ্ন করেছি ওরা কি আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসে ভারতকে? আমার এক যুগের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, অনেকে নিজেকে দেশপ্রেমিক বলছে, অথচ দেশের গরিবদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছে, টাকা পয়সার জন্য দুর্নীতির আশ্রয় নিচ্ছে, মেয়েদের যৌন হেনস্থা করছে, যেসব আমি কখনও করিনি।

এখন ভারতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে একটিই মত--- ‘পাকিস্তান সন্ত্রাসী রাষ্ট্র, ভারতীয়দের হত্যা করছে। পাকিস্তানের সঙ্গে অসযোগিতাই এখন একমাত্র কাজ ভারতের। পাকিস্তানি অভিনেতাদের ভারতে এসে সিনেমা করা বন্ধ করা হোক। ভালোয় ভালোয় তারা ভারত থেকে বিদেয় হোক।’

ভারত সরকার কোনও পাকিস্তানি শিল্পীকে নিষিদ্ধ করেনি, কাউকে ভারত ছাড়তেও বলেনি। যারা নিজেদের দেশপ্রেমিক বলে মনে করে, তারা বলছে পাকিস্তানি শিল্পীদের নিষিদ্ধ করতে। দেশপ্রেম দেখাতে হলে চোখের বদলে চোখ নেব ধরনের জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করতে হবে, এবং ঘৃণা ছুড়ে দিতে হবে শত্রুদেশের সকলের দিকে, এমনই যেন নিয়ম হয়ে গেছে। কেউ কেউ বলছে, উত্তরপ্রদেশে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, এই সময় ‘পাকিস্তান-কে  শায়েস্তা করে ছাড়বো’ এরকম একটি প্রতিশ্রুতি মানুষকে স্বস্তি দেবে – অর্থনৈতিক  উন্নতির চেয়ে বড় হয়ে উঠবে জাতীয়তাবাদ। সরকারি দলের জন্য সম্ভবত এটি নির্বাচনে জেতার কায়দা।

পাকিস্তানে ভারতবিদ্বেষী লোক যেমন আছে, ভারতের পক্ষের লোকও আছে। পাকিস্তানের ইসলামি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেও লোক আছে, বেলুচিস্তানের নিরীহ মানুষের ওপর পাকিস্তানের সরকার বর্বরতা চালাচ্ছে, এর বিরুদ্ধেও পাকিস্তানিরা প্রতিবাদ করে। আমার প্রশ্ন, পাকিস্তানের এই শিক্ষিত, সচেতন, উদার, মানববাদি মানুষগুলোকে শত্রু ভাববো কেন? পাকিস্তানের ভারতবিদ্বেষী সন্ত্রাসী আর প্রতিপক্ষকে শত্রু ভাবলেই কি যথেষ্ট নয়? নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে নওয়াজ শরিফের মধুর সম্পর্কের অবনতি বড় তাড়াতাড়ি ঘটে গেল। কেউ কেউ অবশ্য বলছে, সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে পাকিস্তানি জঙ্গি মেরে ভারত বরং পাকিস্তান সরকারকে সুযোগ করে দিয়েছে তাদের সেনাবাহিনীকে প্রশ্ন করার, কেন তারা সন্ত্রাস দমন করছে না? আমার কিন্তু মনে হয় যেসব দেশে সেনাশাসন চলেছে দীর্ঘকাল, সেসব দেশে সেনা প্রধানের আদেশ নিষেধ সরকার মেনে চলে বা মেনে চলতে বাধ্য হয়।

সাহিত্য  সংস্কৃতির জগতে ছড়ি ঘোরানো পলিটিশিয়ানদের স্বভাব। ওরা জানে, মানুষকে সচেতন করে তুলতে পারে সাহিত্যের এবং সংস্কৃতির জগতের লোকেরা। ওরা জানে, সচেতন মানুষেরা ওদের মুখোশ খুলে দিতে পারে। গণতান্ত্রিক সংবিধানে বাক স্বাধীনতার কথা থাকলেও একের পর এক ওরা বই নিষিদ্ধ করে, সিনেমা থিয়েটার নিষিদ্ধ করে। ভারতবর্ষেও দেখছি বড় দুই চিত্র পরিচালক এক পলিটিশিয়ানের কাছে গিয়ে প্রতিজ্ঞা করে এসেছেন পাকিস্তানি শিল্পীদের তারা আর নেবেন না সিনেমায়। পলিটিশিয়ানকে খুশি করতে পারলে সিনেমা মুক্তি পাবে,পলিটিশিয়ানদের পছন্দ হলে তবেই শিল্প সাহিত্য প্রচারিত বা প্রদর্শিত হবে, নয়তো নয়। এই চিত্রটি কোনও গণতান্ত্রিক পরিবেশের চিত্র নয়। গণতন্ত্র –এই শব্দটি আমরা দেশের মাথায় পতাকার মতো ঝুলিয়ে রাখতে পছন্দ করি, কিন্তু এর চর্চা করতে পছন্দ করি না। ভারতে সাত দশকের গণতন্ত্র। তারপরও মনে হয় গণতন্ত্র এখনও এখানে নিতান্তই শিশু। তবে প্রতিবেশি পাকিস্তান আর বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করলে দেখি, ভারতের গণতন্ত্র খুব মজবুত, শক্তিশালি। ভারতের কাছেই আশা করি সভ্যতা। আধুনিকতা। উদারতা। চোখের বদলে চোখ নেব, দাঁতের বদলে দাত, এই চিৎকার ভারতকে মানায় না।   

ভুল তো হয়েছিল সাতচল্লিশেই। ধর্মকে আঁকড়ে ধরে যে শিশুটি জন্ম নিয়েছিল সেদিন, সে শিশু যে একদিন ভয়ঙ্কর মনস্টার হয়ে উঠবে, তা বোঝা উচিত ছিল তখনকার তুখোড় রাজনীতিবিদদের। ধর্মকে যদি রাষ্ট্রের মূলমন্ত্র করো, পরিণতি কী হয় তা পাকিস্তানকে দেখেই অনুমান করা যায়। ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় মৌলবাদ, ধর্মীয় সন্ত্রাস – কী নেই পাকিস্তানে আজ!

ভারত-পাকিস্তানের লড়াই নতুন কিছু নয়। তিনটি যুদ্ধ হয়ে গেছে এই দুই দেশে। আর কোনও যুদ্ধ যেন না হয়। উপমহাদেশের দুই পারমাণবিক শক্তি যদি পরস্পরকে ঘৃণা করতে থাকে, তাহলে ভয় হয়। আমি জানি না, তারা জানে কী না, পাকিস্তানে বোমা ফেললে শুধু পাকিস্তানিরা মরবে না, সব ভারতীয়ও মরবে। আর ভারতে বোমা ফেললে শুধু ভারতীয় মরবে না, সব পাকিস্তানিও মরবে।

পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তি  চুক্তি করার জন্য ভারতকেই এগিয়ে আসতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকাকে একঘরে করে ফল পাওয়া গিয়েছিল, পাকিস্তানকে একঘরে করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। পাকিস্তানের বন্ধু দেশের অভাব নেই, জিহাদিদেরও অভাব নেই। পারমাণবিক অস্ত্র যার কাছে আছে, তাকে একঘরে করা ঝুঁকিপূর্ণ। তার চেয়ে বরং দুই দেশের জনতার সরকার  লড়াই মিটিয়ে ফেলুক। শো সিনেমা নিষিদ্ধ করে শত্রুতা বাড়িয়ে সত্যিকারের লাভ কিছু  হবে না। সন্ত্রাস বন্ধ করার জন্য আরও নতুন উপায় বের করতে হবে। সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বাড়লে দুই দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক ভালো ছাড়া মন্দ হবে না। এই সম্পর্কটিই দুই দেশের বন্ধুত্ব বাড়াবে, বন্ধুত্ব বাড়লে শত্রুতা কমে যায়। রাজনীতিকরা যুক্তিবুদ্ধি খাটিয়ে পরস্পরের সহযোগিতায় সুস্থ সভ্য রাজনীতির মাধ্যমে সন্ত্রাসের সমস্যা ঘোচানোর চেষ্টা করুন। দুই দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকেই ঠাণ্ডা মাথায় সমাধান করতে হবে সব সমস্যার। আগে সম্ভব হয়নি বলে আর কখনও সম্ভব হবে না তা তো নয়। এরকম তো হওয়ার উপায় নেই যে ভারতের ইচ্ছে করছে বলে পাকিস্তান নামের দেশটিকে বোমা মেরে  মানচিত্র থেকে উড়িয়ে দেবে, দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। এ সম্ভব নয়। সন্ত্রাস সারা বিশ্বে। মধ্যপ্রাচ্য ছাড়খাড় হয়ে গেছে।

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ