X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

কারাবাসের অভিজ্ঞতা কি কেনা যায়!

হারুন উর রশীদ
০১ নভেম্বর ২০১৬, ১৪:২৬আপডেট : ০১ নভেম্বর ২০১৬, ১৬:৩২

হারুন উর রশীদ খবরটি তেমন গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করেনি কোনও সংবাদ মাধ্যম। হয়তো তাদের কাছে মনে হয়েছে এটা গুরুত্ব পাওয়ার কোনও বিষয় নয়।এর চেয়ে আরও অনেক বড় ঘটনা আছে সেটাই প্রধান খবরের জায়গা পায় না! তারপর আবার এই খবর গুরুত্ব দিয়ে ছাপা? তবে আমার কাছে খবরটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। আর যারা এই খবরটি তৈরি করেছেন তাদের মনে হয়েছে অনেক মানবিক এবং অগ্রসর। এতক্ষণে নিশ্চয়ই আপনারা কেউ কেউ বলে ফেলেছেন, হেঁয়ালি না রেখে খবরটি জানান।
খবরটি হলো ঢাকার পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে ‘ফিল দ্য প্রিজন’ করার কথা জানিয়েছেন মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন। উদ্দেশ্য হলো- কারাগারে থাকার অভিজ্ঞতা কেমন হয় তা জানতে ইচ্ছুক নাগরিকদের কিছুদিন কারাবাসের ব্যবস্থা করা। তবে এটা ফ্রি নয়, অভিজ্ঞতা নিতে হবে অর্থের বিনিময়। এটা কবে নাগাদ হবে এবং কয়টি সিট থাকবে। কনডেম সেল থাকবে কিনা , এসবের বিস্তারিত তিনি জানাননি। আর খরচইবা কেমন হবে তাও এখনও প্রকাশ করা হয়নি।
তবে সেসবের বিস্তারিত প্রকাশ না করা হলেও শুধু ‘ফিল দ্য প্রিজন’ হচ্ছে এটা শুনেই আমি আনন্দিত।
তেলেঙ্গানা মডেল
এবার আসি ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যের কথায়। সেখানকার মোডাক শহরের ২২০ বছরের পুরানো কারাগারটিও স্থানান্তর করা হয়েছে। হায়দ্রাবাদের নিজামদের তৈরি ওই কারাগারটি এখন জাদুঘরে রূপান্তরের কাজ চলছে। আর তারই একটি প্রজেক্ট-‘ফিল দ্য জেল’- জেলের অনুভূতি। তারাও পর্যটক ও নাগরিকদের টাকার বিনিময়ে কারাগারে থাকার অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ দিচ্ছেন। আর তা ২৪ ঘণ্টা বা একদিনের জন্য। এই অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য গুনতে হবে পাঁচশ’ ভারতীয় রূপি।
তেলেঙ্গানা কারা কর্তৃপক্ষ চাইছেন পুরোই কারাবাসের অনুভূতি দিতে। তাই যারা শখের কারাগারে থাকতে চাইবেন তারা কোনও বাড়তি সুবিধা পাবেন না। নিয়ম মেনে বিকেলে তাদের লকআপে ঢুকতে হবে কয়েদিদের পোষাক পরে। লকআপ খোলা হবে সকালে। খাবার জেলখানার মতোই।কম্বল বিছিয়ে ফ্লোরে ঘুমাতে হবে।

তেলেঙ্গানা কারা কর্তৃপক্ষ মনে করে, এর মাধ্যমে একটি রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা অর্জনের পাশাপাশি জেলে থাকার কষ্ট বুঝতে পেরে অনেকেই অপরাধ করা থেকে বিরত থাকবে।

গুয়ান্তানামো বে থেকে আবু গারাইব

পৃথিবীর সবচেয়ে কুখ্যাত কারাগার হিসেবে যে কারাগারের নাম সবার আগে আসে তা হলো গুয়ান্তানামো বে কারাগার। কারাগারটি দক্ষিণ কিউবায় হলেও এর মালিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।এটি আসলে ছিল একটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটি। ১৯০৩ সালে হাভানা চুক্তির আওতায় ওই ঘাঁটি করে যুক্তরাষ্ট্র। আর ৯/১১-র পর ২০০২ সালে সেখানে যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করে কারাগার। উদ্দেশ্য হলো ‘ শত্রু যোদ্ধাদের’ আটক রাখা। এই কারাগারে বন্দিদের ভয়াবহ নির্যাতনের ছবি ও ঘটনা প্রকাশ হয়েছে বিভিন্ন সময়। কারাগারটি পরিণত হয়েছে ঘৃণার প্রতীকে। ওবামা অবশ্য তার মেয়াদকালের মধ্যেই এই কারাগার বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। তবে এই কারাগারে এখনও ৭১ জন বন্দি আছেন।

আর ২০১৪ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া ইরাকের আবু গারাইব কারাগারও কুখ্যাতির শিখরে থাকা আরেকটি কারাগার। প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের সময়ই ইরাকের এই কেন্দ্রীয় কারাগারের কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। বিরোধীদের নির্মম নির্যাতনের জন্য ব্যবহার করা হত আবু গারাইব কারাগার। ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন হামলা ও সাদ্দাম যুগের পরও কারাগারটি’র কুখ্যাতি কমেনি। মার্কিন সেনারাও কারাগারটিকে বন্দি নির্যাতনের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে। আবু গারাইব হয়ে ওঠে আরেক গুয়ান্তানামো বে। ২০১৪ সালে কারাগারটি বন্ধের সময় সেখানে প্রায় আড়াই হাজার কয়েদি ছিলেন যাদের ইরাকের বিভিন্ন কারাগারে সরিয়ে নেওয়া হয়। ২০০৯ সালে অবশ্য আবু গারাইব কারাগারটি নাম বদলে বাগদাদ সেন্ট্রাল প্রিজন দিয়ে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু নাম পরিবর্তন করেও এর কুখ্যাতি কমানো যায়নি।

এই দু’টি কারাগারই সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়ার দাবি উঠছে। ইরাক সে দাবিতে এখনও কান দিচ্ছে না। আর ওবামা কংগ্রেসে গুয়ান্তানামো বে কারাগার বন্ধের যে পরিকল্পনা পেশ করেছেন তাতেও সেরকম কিছু নেই। কিন্তু খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই বন্ধ হওয়া কয়েকটি কারাগার এখন পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

কারাগার এখন পর্যটনকেন্দ্র

যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোতে কুখ্যাত অ্যালকাট্রাজ কারাগার ১৯৬৩ সালে বন্ধ করে দেওয়া হয়।  বিচ্ছিন্ন দ্বীপে মার্কিন সামরিক বাহিনীর কারাগার অ্যালকাট্রাজ ১৯৩৩ থেকে পরের তিন দশক হয়ে ওঠে ফেডারেল কারাগার। বন্ধের এক দশক পর ১৯৭৩ সালে দর্শনীয় স্থান হিসেবে খুলে দেওয়া হয় এ কারাগারকে। শুধু জনবিচ্ছিন্নই ছিল না এ কারাগার। এখানে দেওয়া হত সবচেয়ে নির্দয় শাস্তি। বন্দিদের রাখা হতো খুবই ছোট কক্ষে। এই কারাগারই এখন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম আকর্ষণীয় ট্যুরিস্ট স্পট। প্রতিবছর অ্যালকাট্রাজ দেখতে যান অন্তত ১৩ লাখ মানুষ। এরকম উদাহরণ বিশ্বে আরও অনেক আছে।

এই কারাগারে ছিলেন এমন একজন হলেন রবার্ট লিউক। পরে তিনি পর্যটক হিসেবে সেখানে গিয়ে জানান, ‘এটা ছিল বিশ্ব থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। সেখানে কোনও সংবাদপত্র, কোনও টেলিভিশন, রেডিও কিছুই ছিল না। ৫ বছর পর যখন মুক্তি পেলাম, মনে হলো আমি এক নতুন পৃথিবীতে এসেছি।’

অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের পেন্ট্রিজ কারাগার ১৮৫১ সালে নির্মাণ করা হয়। আর ১৯৯৭ সালের ১ মে কারাগারটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরকারি উদ্যোগে এখন সেখানে গড়ে উঠেছে বিনোদন কেন্দ্র আর বিলাসবহুল হোটেল।

বিশ্বখ্যাত লেখক অস্কার ওয়াইল্ড ইংল্যান্ডের রিডিং কারাগারে ১৮৯৫ সাল থেকে দু’বছর নির্জন কারাবাসে ছিলেন। ১৮৪৪ সালে এ কারাগারটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে এটিকে বন্ধ করে দিয়ে পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। কারাগারে যে কক্ষে অস্কার ওয়াইল্ড থাকতেন, তার দরজা সংরক্ষণ করা হয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য।

একইভাবে ফ্রান্সের লোভিয়ার্স কারাগার, তুরস্কের ক্যাপিটাল সিটি মার্ডার কারাগার, স্পেনের সেনট্রো সিভিকো কারাগার,  হংকংয়ের হালেট হাউজ কারাগার এখন পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্র।

কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যের চিন্তাটা একটু আলাদা। এখানে শুধু বিনোদন নয় আরও কিছু গভীর চিন্তা আছে বলে আমার মনে হয়। পুরনো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ‘ফিল দ্য প্রিজন’ প্রকল্পের ব্যাপারে আইজি প্রিজন বলেছেন, ‘কারাগারে থাকতে কেমন লাগে সেই অনুভূতি দিতেই এই প্রকল্প’।

কারাবাসের অনুভূতি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সেলিম রেজা নিউটন। ওয়ান ইলেভেনের সময় তাকে জেলে যেতে হয়েছিল। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি তার অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন ।‘বিড়ালের জেলখানা এবং অন্যান্য’- এই শিরোনামে তার লেখার কিছু অংশ আমি এখানে উদ্ধৃত করছি।

‘...বিশাল একেকটা ওয়ার্ড। চার দেয়ালের কোনোটাতেই দরজা-জানালার অভাব নাই। হু হু করে হিম ঢুকছে। এদিক দিয়ে ঢুকছে, ওদিক দিয়ে বেরুচ্ছে। জমে যাচ্ছে মানুষের বাচ্চারা। গায়ে শুধু একটা কম্বল-পাতলা, ছেঁড়াখোঁড়া, পুরনো, ধ্যাড়ধ্যাড়া। এসব বন্দীর অনেকে শিশু ও অনেকে বৃদ্ধ।... আছে পিঁপড়ার কামড়। প্রায় তিন-তলা দালানের সমান উঁচু এত বড়ো বকুলগাছের গোড়ার দিককার মূল কাণ্ডে লোহার কড়া পোঁতা আছে। তাতে হাত বেঁধে বিষ পিঁপড়ার কামড় খাওয়ানো হয় এক ঘণ্টা দুই ঘণ্টা তিন ঘণ্টা। গাছের গোড়ায় মাটিতে অনেক পিঁপড়ার বাসা। কয়েদীর গায়ে মেখে দেওয়া হয়েছে গুড়। খুঁচিয়ে দেওয়া হয়েছে বাসা। লাইন ধরে পিঁপড়া বেরুচ্ছে। শতো শতো পিঁপড়া। উঠে যাচ্ছে কয়েদীর গায়ে, কামড়াচ্ছে।… আছে দিনের পর দিন লোহার ডাণ্ডাবেড়ী পরিয়ে রাখা: নানান ভঙ্গিতে, যেন ঠিকমতো হাঁটতে না পারে, যেন দরকারেও নিচু হতে না পারে, যেন সারাক্ষণ পিঠ বাঁকা করে থাকতে হয়, সোজা হতে না পারে, ইয়ত্তা নাই।... আর, ‘কেইস টেবিলে’ লাঠিপেটা তো আছেই। একজন কয়েদীকে কয়েকজন 'দাঙ্গা' মিলে রীতিমতো লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে...’।

জেলে থাকার অভিজ্ঞতা নিয়ে এরকম অজস্র লেখা আছে সারা দুনিয়ায়। সাংবাদিকরাও কৌশলে জেলে ঢুকে জেলখানার ভেতরের অবস্থা নিয়ে লিখেছেন। জানিয়েছেন মুক্ত বিশ্বকে বন্দিদের কান্নার কথা। জানা গেছে জেলের ভেতরে আরেক জেলের কাহিনী। যেখানে আছে আরেক রাজত্ব। আছে প্রজা, আছে নির্যাতিত। আরও আছে জেলে বসে অবৈধ ব্যবসায় ফুলে ফেঁপে ওঠা কোনও কোনও ক্ষমতাধর কয়েদির কাহিনী। আর এই বাংলাদেশে জেলের মধ্যেই ঘটেছে হত্যাকাণ্ড। সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর বাংলাদেশের জাতীয় চার নেতাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরেই হত্যা করা হয় তখনকার সরকারের ইচ্ছায়।

রাজনীতিক, কবি ও সাধারণ মানুষ

নেলসন ম্যান্ডেলা থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ বিশ্বের অনেক বড় বড় নেতা জেল খেটেছেন। তাদের কেউ কেউ জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় জেলে কাটিয়েছেন। কেউ জেলখানায় বসেই বই লিখেছেন। কেউ আবার সেখান থেকে যে চিঠি লিখেছেন, তাই হয়ে উঠেছে বিশ্ব ইতিহাসের অবশ্য পাঠ্য। পন্ডিত জওহর লাল নেহেরেুর ‘Glimpses of The world History’ জেলখানা থেকে তার কন্যা প্রিয় ইন্দিরাকে লেখা চিঠির সংকলন।

আর তুর্কি কবি ও নাট্যকার নাজিম হিকমতের জীবনের অর্ধেক সময়ই কেটেছে কারাগারে। ১৯০২ সালে জন্ম নেওয়া ‘রোমান্টিক কমিউনিস্ট’ নাজিম হিকমতের জীবনের অর্ধেক সাহিত্য রাচনার সূতিকাগার কারা প্রকোষ্ঠ। এই কবি ১৯৬৩ সালে রাশিয়ায় মারা যান। তার কবিতা বহু ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। বাংলায় অনুদিত তার ‘জেলখানার চিঠি’ অনেকেই পড়েছেন। শুনেছেন আবৃত্তি। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ায়ের অনুবাদে তার আরেকটি কবিতা ‘আমি জেলে যাওয়ার পর’-এর কয়েকটি লাইন তুলে ধরছি -

‘জেলে এলাম সেই কবে

তার পর গুনে গুনে দশ-বার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করেছে পৃথিবী।

পৃথিবীকে যদি বলো, বলবে -

‘কিছুই নয়,

অণুমাত্র কাল।’

আমি বলব -

‘না , আমার জীবনের দশটা বছর।’

কবি নাজিম হিকমত তার জীবনের ১০টি বছর নিয়ে আক্ষেপ করেন। কবিতা হয়। আমাদের দেশেও বিনা বিচারের বছরের পর বছর কারাগারে আটক থাকার কান্না আমরা প্রায়ই শুনতে পাই। শুধু বিনা বিচারে কেন, অপরাধ না করেও নামের কারণে কেউ কেউ কারাগারে কাটিয়েছেন জীবনের বড় একটা সময়। মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মধ্যপাড়া করারবাগ এলাকার বাবুল শুধু নামের কারণে ১৭ বছর জেল খাটার পর আদালতের মাধ্যমে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পর চলতি মাসেই কারাগার থেকে মুক্তি পান। বাবুলকে পুলিশ যখন হত্যা মামলায় নামের কারণে ‘ভুল’ করে আটক করে তখন তিনি ছিলেন যুবক। আর এখন তিনি প্রৌঢ়। বাবুলেরও প্রশ্ন কে তাকে ফিরিয়ে দেবে তার যৌবন? মুক্তি পাওয়ার পর তিনি বলেন,‘জেলে যাওয়ার কিছুদিন পর স্ত্রীও ছেড়ে চলে গেছে। এখন আমি মুক্তি পেয়ে কী করব? ঠিকানাও ভুলে গেছি। বাড়ি যাওয়ার রাস্তাও মনে নেই। আমাকে খালাস দিয়ে কী হবে?’

বিনাদোষে কারাবাসের এই অভিজ্ঞতার যেন দেশ-কাল নাই। গুয়ানতানামো বে কারগারেও শুধু নামের  কারণে মুস্তাফা আল আজিজ আল শামিরি নামে এক ব্যক্তিকে ১৩ বছর আটক থাকতে হয় বিনা বিচারে । ইয়েমেনের এই নাগরিককে আল কায়েদার বড় নেতাদের বার্তাবাহক বলে আটক করা হয়।পরে জানা যায় সে নীচু পদের এক সামরিক সদস্য। ২০১৫ সালে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

কারা সংস্কার

আধুনিক কারাগারকে রাজনৈতিক দিক থেকে বিশ্লেষণ করেছেন বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো।  তিনি ইতিহাস ঘেঁটে দেখিয়েছেন, একসময় শাস্তি ছিল প্রকাশ্য নিপীড়নমূলক, জনসমক্ষে নিষ্ঠুর পদ্ধতি ব্যবহার করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো। এরপর আঠার শতকে রাজনৈতিক কারণেই ইউরোপে আধুনিক কারাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে সেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সংস্কার করা হয়েছে। তবে এর  মূল উদ্দেশ্য যে ক্ষমতা প্রয়োগ তার কোনও পরিবর্তন হয়নি।

'ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ: দ্য বার্থ অব দ্য প্রিজন' নামের বইতে তিনি দেখিয়ে দেন শাস্তিকে কিভাবে সরাসরি দৈহিক শাস্তি থেকে আলাদা করার চেষ্টা করা হয়েছে। শাস্তি এক সময় ছিল দৈহিক অত্যাচার। পরে মানুষকে শাস্তি দেওয়ার কৌশল বদলে তাকে বন্দি রাখার ব্যবস্থা করা হলো। এটাই ফুকোর মতে আধুনিক কারাগারের জন্মের ইতিহাস। ফুকো একে ডিসপ্লিনড শাস্তি হিসেবে দেখেন।

তিনি মনে করেন, আঠার শতকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হলেও আসলে মূল ব্যাপারটা ক্ষমতাপ্রয়োগ। প্রকাশ্যে দৈহিক শাস্তির বদলে কারাগারে রেখেও ক্ষমতারই প্রয়োগ করা হয়।

শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে দেহকে একসময় উপজীব্য করা হতো, এখন দৈহিক অত্যাচারের বাইরে এসে একে বন্দিত্ব দিয়ে তা  প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। ফুকোর কাছে কারাগার তাই শাস্তির কৌশলগত সংস্কার।

ফুকো মনে করেন, তারপরও দৈহিক অত্যাচার বন্ধ করা যায়নি। আর ফুকোর কাছেইবা যেতে হবে কেন, দৈহিক নির্যাতন ঠেকাতে কারাব্যবস্থার প্রচলন হলেও ওই নির্যাতন যে কারাব্যবস্থার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে তার উদাহরণের অভাব নেই।

তাই কারাব্যবস্থার সংস্কারের প্রশ্নটি খুব জরুরি প্রশ্ন হয়ে উঠেছে বহুদিন থেকেই।

কারাগারের  অমানকিতার কাহিনী ছড়িয়ে আছে দেশে দেশে। সভ্যতার পাদপীঠ থেকে শুরু করে তৃতীয় বিশ্বের দেশটিতেও। আর সেটা এখনো বিদ্যমান। তাই কারা সংস্কার সময়ের দাবি। সংস্কার হচ্ছে। আরও হবে। কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কারা নির্যাতন বন্ধে আপাতত কোনও সুলক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

কারা সংস্কারের অংশ হিসেবেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারকে কেরানীগঞ্জে স্থানান্তর করা হয়েছে। এর আগে নির্মাণ করা হয়েছে কাশিমপুর কারাগার। বাংলাদেশে এখন মোট কারাগার ৬৮টি। এরমধ্যে কেন্দ্রীয় কারাগার ১৩টি। সরকারি হিসাব মতে দেশের সব ক’টি কারাগারে বন্দির ধারণক্ষমতা ৩৪ হাজার ৭শ’।কিন্তু এসব কারাগারে গড়ে ৮০ হাজার বন্দি থাকেন। আর এইসব কারাগারে আছেন নারী ও শিশুরাও। ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণের বেশি বন্দি যেখানে সেখানে সংস্কারের ফল পেথে কতদিন লাগবে তা সহজেই বোঝা যায়।

কারগারে নারী বন্দিদের ভয়াবহ জীবনের কথা আমরা জানতে পারি সংবাদ মাধ্যমে। শিশুরা কারাগারে বড় হয় ভয়ংকর কোনো অপরাধীর সামনে। কারাবন্দি নারীর কারাগারেই নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা আছে।  আছে টেন্ডার ব্যবসার নামে কয়েদিদের খাবার চুরি। আছে খাবার কেড়ে নেওয়ার ঘটনাও। সেখানেই নাকি আবার কেউ কেউ গড়ে তোলে মাদক সাম্রাজ্য, অপরাধ জগত। কারাগারে বসেই বাইরের মাফিয়া জগতকে নিয়ন্ত্রণ করে কোনো ঝানু কয়েদি। কারাগারের ভিতরেই যেন আরেক কদর্য পৃথিবী। কার দায় সেটা বড় কথা নয়, কথা হলো সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন আছে, আছে ক্ষমতার দাপট। আবার আছে দুর্নীতি, খুন, ধর্ষন, অন্যায়, অবিচার। বাইরের দুনিয়ার চেয়ে আলাদা নয় কারাগার।

আমার সাংবাদিকতা জীবনে দু’বার কারাগারে ঢোকার সুযোগ পেয়েছিলাম ওয়ান ইলেভেনের সময়। একজন কারা ডিআইজির বদান্যতায়। পুরনো ঢাকায় সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারে ক্যামেরা নিয়ে আর কাশিমপুর কারাগারে ক্যামেরা ছাড়া।

পুরনো ঢাকার সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারে ক্যামেরা নিয়ে প্রবেশের পর এক পর্যায়ে ক্যামেরা রেখে আরও ভেতরে, বন্দিদের আরও কাছে যাওয়ার সুযোগ হয় আমার তখন। আমি তখন দেখেছি বন্দি মানুষের অবদমিত জীবন। দেখেছি এত ধূসর জগৎ। আবার সেখানেও দেখেছি শ্রেণি বিভাজন। টাকা থাকলে সব মেলে কারাগারে, টাকা না থাকলে কারাগার যেনে কারাগারের চেয়েও কঠিন হয়।

কাশিমপুর কারাগারে ঢুকে তখন আটক বেশ কিছু ভিআইপি বন্দির কাছে শুধু যাওয়া নয় তাদের আতিথেয়তা গ্রহণেরও সুযোগ হয় আমার। তাদের দেখেছি ফ্রিজের ব্যবস্থাও ছিলো। আর একই কারাগারে সাধারণ বন্দিদের আরও সাধারণ জীবনও আমি দেখেছি।

অপরাধ  আছে তাই কারাগার আছে। পৃথিবীতে কারাগার বাড়ার সঙ্গে অপরাধের বিপরীত সম্পর্ক নয়, সম্পর্ক  সমান্তরাল, ইতিবাচক। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অপরাধী বেড়ে যাওয়ায় এখন প্রাইভেট কারাগারের ব্যবসাও জমজমাট। বলা হয়ে থাকে আধুনিক বিচারের উদ্দেশ্য শাস্তি দেয়া নয় সংশোধন করা । তাই কারাদন্ডের নতুন নতুন পদ্ধতি আসছে। যদি আদালত মনে করেন তাহলে অপরাধীকে মুক্ত কারাদণ্ডও দিতে পারেন।

কারা বিধিতে জেল ভিজিটর বলতে একটা বিষয় আছে। যেখানে রাষ্ট্রের মানবাধিকার কর্মী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ আরো অনেকে একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর কারাগারের ভেতরে গিয়ে বন্দিদের অবস্থা দেখতে পারেন। তাদের অভিযোগ শুনতে পারেন। কিন্তু এই বিষয়টি কার্যকর করা হয় না নানা কারণে। প্রধান কারণ জেল ভিজিটের ব্যবস্থা কার্যকর করলে অনেক কিছু ফাঁস হয়ে যাবে।

পরিত্যক্ত কারাগারে কারা জীবনের অনুভূতি জানার যে উদ্যোগ ‘ফিল দ্য প্রিজন’, এর মধ্যে মহৎ উদ্দেশ্য আছে। আর তা হলো বন্দি জীবনের কষ্ট বোঝা। এটা ভালো উদ্যোগ। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা কী কোঝা যাবে? আমরা কি বুঝতে  পারবো ১৭ বছর বিনা অপরাধে জেলে থাকা মুন্সিগঞ্জের বাবুলের কষ্টের অনুভূতি । পারবো না। আমরা কখনোই বুঝতে পারবো না কারগারের মধ্যেই যাদের খুন হয়েছে তাদের স্বজনদের কষ্ট।

তাই ‘কারাবাস বিনোদন’ নয়। চাই সত্যিকারের মানবিক কারাগার। যার উদ্দেশ্য হবে একদিন কারাগারহীন পৃথিবী।

লেখক: সাংবাদিক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ