X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনীতির উদ্দেশ্য সাধনে ধর্ম

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
০২ নভেম্বর ২০১৬, ১২:৩১আপডেট : ০২ নভেম্বর ২০১৬, ১২:৩৫

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ব্রাহ্মণবাড়িয়া আমার জেলা। ছোট বেলায় ঢাকায় চলে আসা। কিন্তু আত্মিক যোগাযোগতো আছেই। কিন্তু এই জেলা থেকে মাঝে মাঝেই এমনসব খবর আসে যা আমাকে লজ্জিত করে। কোনও এক মোবাইল দোকানে ঘটে যাওয়া হাঙ্গামায় শহরে কেন্দ্রস্থলে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সঙ্গিত একাডেমি মাটির সঙ্গে গুড়িয়ে দেওয়ার খবর মন থেকে মুছে যাওয়ার আগেই খবর এলো জেলার নাসিরনগর থেকে। স্থানীয় এক হিন্দু তরুণের ফেসবুকে কোন একটি ছবিকে কেন্দ্র করে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়েছে, লুট করা হয়েছে, মন্দির আর প্রতিমা ধ্বংস করা হয়েছে। 
এখন পুলিশ নানা ব্যবস্থার কথা বলছে, সরকারি দলও এলাকায় কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছে। তবে এই জেলায় অনেকদিন ধরেই একটা সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী তার ভীত শক্ত করে একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর সারা দেশের মতো এরা এখানেও ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করে। দীর্ঘ সময় আলী আজম খান, লুৎফুল হাই সাচ্চু, হুমায়ুন কবীরসহ কিছু প্রথিতযশা আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রভাব, বাম দলগুলো, জেলার সাহিত্য একাডেমি ও সংস্কৃতিক কর্মীদের সক্রিয়তায় এক ধরনের প্রগতিশীল আবহ থাকলেও বিএনপি, জাতীয় পার্টির আমলে শক্তি সঞ্চয় করে প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শক্তি। আশির দশক থেকে খতমে নব্যুয়ত নামের এক সংগঠন বানিয়ে মাদ্রাসা ছাত্রদের জঙ্গি কায়দায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষজনের ওপর আক্রমণ শুরু করে মাওলানা সিরাজুল ইসলাম নামের এক তথাকথিত ‘বড় হুজুর’। যারা ১৯৭৫-এর পর থেকে দেশে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারের রাজনীতি শুরু করে তারা ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো এই বড় হুজুরের বড় পৃষ্ঠপোষক হয়ে দাঁড়ায়। এরাই পরবর্তীতে প্রশিকার সমাবেশে হামলা করে আরও বীরত্ব অর্জন করে। ২০০১ সালে জামাত বিএনপি জোট ক্ষমতায় আসার পর ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান ফজলুল হক আমিনীর নেতৃত্বে এই জঙ্গি সংস্কৃতি আরও পল্লবিত হয়। সত্যি বলতে কী এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর পরিবর্তে বড় হুজুরের সঙ্গে আপোষ করেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগও। কারণ এখন আলী আজম খান বা লুৎফুল হাই সাচ্চুর মতো বড় মনের নেতা নেই। সেই বড় হুজুরের মৃত্যুর পরও মাদ্রাসা কেন্দ্রিক প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শক্তি সক্রিয় কারণ তাদের মতাদর্শের রাজনৈতিক গোষ্ঠী তাদের সঙ্গে আছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে যে ঘটনা ঘটেছে তার জন্য ফেসবুক স্ট্যাটাস একটি উছিলা মাত্র। সেই ছেলে আটক হয়েছে, দুঃখ প্রকাশ করে বলেছে তার আইডি হ্যাক হয়ে এটি হয়েছে। কিন্তু তবুও সাম্প্রদায়িক সহিংস চক্র  সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে।    

সামাজিক মাধ্যমে যারা এর প্রতিবাদ করছে প্রায় প্রতিটিতে নিচের মন্তব্যগুলো পড়লে আরও বেশি ঘৃণা জন্মে। শিক্ষিত, গুরুত্বপূর্ণ পদের মানুষজন মন্তব্য করে চলেছে এই আক্রমণের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে। প্রোফাইলে গিয়ে দেখি এদের কেউ কোনও টিভি চ্যানেলের বার্তা সম্পাদক, কেউ অধ্যাপনা করেন, কেউ গবেষণা কাজে নিয়োজিত, কেউবা সরকারি কর্মকর্তা। আর একটি বড় অংশই ডানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির সমর্থক বা কর্মী।

এই যে, আমরা বলি দেশ আধুনিক হচ্ছে, তার নমুনা কি এই? বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, অধিকাংশ শিক্ষিত বাঙালি আসলে সাম্প্রদায়িক। এসব শিক্ষিত পেশাজীবীরা একথাই বারবার পদে পদে মনে করিয়ে দেয় যে হিন্দুরা শত্রু। এদেশেরই মানুষ, এদেশে জন্ম নেওয়া বেড়ে ওঠা একটি সম্প্রদায়ের প্রতি এমন মনোভাব আমাদের বুঝিয়ে দেয় এ সমাজ আজ বিপন্ন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতির বিস্তারে রাজনৈতিক সচেতনতা এখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ফলে সাম্প্রদায়িকতা আজ দেশকে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে। নাসিরনগরে যা ঘটেছে তারপরও কি আমরা গর্ব করে বলবো এদেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ?

সাম্প্রদায়িকতা তো বরাবরই বাংলাদেশের সমাজের ক্যানসার হয়ে রয়েছে। এদেশে বড় একটি অংশ কথায় কথায় অপ্রাসঙ্গিকভাবে অজুহাত হিসেবে ভারতে মুসলমানদের কথা টেনে আনে। এরা পাকিস্তানি দর্শনে বিশ্বাসী যেদেশে কোনও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটি দিনও কাটেনা আক্রমণের শিকার হওয়া ছাড়া। হিন্দুদের মুসলমানদের অধীনে থাকতে হবে, এ রকমটাই এই গোষ্ঠীর দর্শন। নাসিরনগরে লুটতরাজ  যারা করেছে, যারা প্রতিমা ভেঙেছে, যারা মন্দির গুড়িয়েছে, তারা সেই শক্তির আদর্শে অনুপ্রাণিত যারা আরেকটি ১৯৭৫ চায়, যারা পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার প্রকল্প নিয়ে মাঠে সরব সব ধরনের সহিংসতা পুঁজি করে।

ফেসবুকে, অনলাইনে শিক্ষিত মানুষের যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখছি, তাতে বলতেই হয় ‘শিক্ষিত বাঙালি অসাম্প্রদায়িক, হিন্দু-মুসলিম ভেদে বিশ্বাস করে না... একথা এখন আর সত্য নয়’।     

সাধারণ মুসলমানের ফেসবুক নিয়ে আগ্রহ নেই, আর ধর্মের প্রশ্নে এমন জঙ্গি হয়ে রাস্তায় নামার কথা তারা ভাবেন না। সাংবাদিকদের এসব কথাই বলছিলেন স্থানীয়রা। সাধারণ মানুষ সবখানেই এমন। কিন্তু তাই বলে অবশ্য তাদের ভাবানোর কিংবা উস্কানোর লোকের অভাব নেই। কারা সেই প্ররোচক? অবশ্যই রাজনীতিক এবং ধর্মীয় উগ্রগোষ্ঠীর নেতারা। এদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা কি খুব কঠিন?

যারা ধর্ম নিয়ে গলা চড়ায় সেইসব ধর্মব্যবসায়ীদের কখনও কেউ কোনও সামাজিক কল্যাণের কাজে উৎসাহ দিতে দেখেছেন? শিক্ষার প্রসারে, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ দূর করার আন্দোলনে এদের ক’জনকে দেখা যায়?  যায়না কারণ এসব করলে পূণ্য হলেও লুট করার মতো মজা পাওয়া যায় না।

যারা এসব চান না তাদের উদাসীনতা ক্রমেই পরিস্থিতিকে আয়ত্বের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। আধুনিক বাংলাদেশে দুর্ভাগ্যবশত উদারতা ও অন্তর্ভুক্তির ঐতিহ্য সংকীর্ণবুদ্ধি সাম্প্রদায়িকতার কারবারিদের দ্বারা বিকৃত হয়ে চলেছে। এই গোত্রের তাত্ত্বিকরা একটি বৃহৎ সমগ্রের অঙ্গীভূত করার বাঙালি ঐতিহ্যকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অপরিসর বৃত্তে সঙ্কুচিত করে ফেলছে। আর এর ফলেই সৃষ্টি হচ্ছে উগ্র, জঙ্গি, মারমুখী ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার। এই গোষ্ঠীর অনুগামী ‘স্বেচ্ছাসেবক’রা তাই সুযোগ পেলেই লাঠি আর রাম দা নিয়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের শায়েস্তা করতে পথে বের হয়ে আসে। সহিষ্ণুতা, উদারতা ও অন্তর্ভুক্তির জীবনচর্যা ক্রমে অন্য ধর্মের মানুষদের ওপর আক্রমণের, তাদের বিতাড়নের ধর্ম হয়ে উঠছে। জানা নেই ধর্মীয় আচার আচরণ এবং রাজনীতির উদ্দেশ্য সাধনে ধর্মকে ব্যবহার করবার এই প্রবণতা  কবে আলাদা করা যাবে।  

লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি

আরও খবর: ভেতরে আর্তচিৎকার, বাইরে মায়েদের প্রশ্ন: দেশটার হলো কী?

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ