X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

নিজের কাছেই যখন হেরে যায় বাংলাদেশ

গোলাম কিবরিয়া
০২ নভেম্বর ২০১৬, ১৬:৩১আপডেট : ০২ নভেম্বর ২০১৬, ১৭:০৮

গোলাম কিবরিয়া ইংল্যান্ডের সঙ্গে জয়ের আনন্দ নিমিষেই ম্লান হয়ে যায়, যে মুহূর্তে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিজের কাছেই হেরে যায় বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশ, যার পরিচয় দিতে আমরা লজ্জিত হই। সেই বাংলাদেশ, যা ১৬ কোটি মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করে না। গুটিকয়েক অমানুষের দায় বয়ে বেড়াতে হয় আমাদের সবাইকে। বারবারই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে তারা। কখনও ধর্মীয় আগ্রাসন, কখনও শিশু ও নারী ধর্ষকের চেহারায়, কখনও ব্যাংকের হাজার কোটি টাকা লুটেরার বেশে। যেই রূপেই তারা হাজির হোক, এর দায় এড়াতে পারে না আমাদের হেফাজতের দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষ। হ্যাঁ, আমি সরকারের কথা বলছি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কথা বলছি। বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে এগুলোকে ধামাচাপা দেওয়ার নামে প্রশ্রয় দেওয়ার দিন অনেক আগেই আমরা পার হয়ে এসেছি। উট পাখির  মতো বালিতে মুখ গুঁজে থাকার সুযোগ নেই। এ সব ঘটনায় লজ্জায়-আপমানে কুঁকড়ে যাই আমরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম; যা এখন বিশ্বে বিকল্প গণমাধ্যম হিসেবে পরিচিত, সেখানে প্রতিবাদমুখর মানুষ। লাখো মানুষের এই সম্মিলিত কণ্ঠ নিশ্চই তাদের কর্ণকূহরে প্রবেশ করছে।
রবিবারের ঘটনাটির দিকে একটু নজর ফেরানো যাক।
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ফেসবুকে ইসলামবিদ্বেষী ছবি পোস্ট করার জের ধরে হিন্দুদের অন্তত ৫টি মন্দির ও বহু বাড়িঘর ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ বলছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরবর্তী নাসিরনগর উপজেলা সদরে রবিবার দুপুরে এই ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাদের বিবিসিকে বলেন, দুর্বৃত্তরা অন্তত কুড়িটি ঘর ও ৫টি মন্দিরে ভাঙচুর চালিয়েছে।
কিন্তু ঘটনাস্থলে সরেজমিন প্রত্যক্ষ করে এসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্থানীয় সাংবাদিক মাসুক হৃদয় বলেছেন, তিনি ভাঙচুরের শিকার প্রতিটি বাড়িঘরে গেছেন। তার হিসাবে আটটি হিন্দু পাড়ায় অন্তত তিনশটি বসত ঘর ও দশটি মন্দিরে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে। দুপুর বারোটা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত এই ঘটনাপ্রবাহ চলেছে। এ সময় বহু হিন্দু অধিবাসীকে মারধর করারও ঘটনা ঘটেছে।
ঘটনার সূত্রপাত হয় গত শুক্রবার।

পুলিশ বলছে, এদিন নাসিরনগর সদর থেকে বারো কিলোমিটার দূরবর্তী হরিপুর গ্রামের রসরাজ দাস নামে এক হিন্দু যুবক ফেসবুকে একটি ছবি পোস্ট করেন, যেখানে তিনি ফটো এডিটরের মাধ্যমে মুসলমানদের পবিত্র কাবা ঘরের সঙ্গে হিন্দুদের দেবতা শিবের একটি ছবি জুড়ে দেন।

এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে গ্রামবাসী রসরাজ দাসকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করে। পরদিনই তার বিরুদ্ধে একটি মামলা করে তাকে আদালতে চালান করা হয়।

বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করে তাকে আদালতে চালানও করে দেওয়া হয়েছে। সেখানেই ঘটনার ইতি ঘটতে পারতো। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি, বরং ঘটনার দুই দিন পর, রবিবার হিন্দু বাড়িতে হামলা ও লুটপাট চালানো হয়।

ধর্মীয় যেকোনও ইস্যুতে উত্তেজনা ছড়ালে তার জের কতদূর গড়াতে পারে, তার ভুরি-ভুরি উদাহরণ আমাদের সামনেই আছে। রামুর বৌদ্ধ পল্লির ঘটনার ক্ষত এখনও শুকায়নি। সেখানেও একইভাবে ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করেই ম্যাসাকার ঘটে। এতসব কিছুর পরও কেন আমাদের প্রশাসন ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পারলো না? ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসন এর কী জাবাব দেবে? শুক্রবার ঘটনার পর পরই নাসিরনগর এলাকায় কেন পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন হলো না? নাকি তারা ভেবেছিলেন অভিযুক্তকে জেলে পুরলেই ঘটনা শেষ?

মনে রাখতে হবে, এই ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই গত জানুয়ারি মাসে একজন মাদ্রাসা ছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনার জের ধরে সংঘর্ষ হয়। ওই সময় বিশেষ করে সাংস্কৃতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর চালানো হয়। সেই ভাঙচুর ও লুটপাটের শিকার হয় শহরে থাকা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতি বিজড়িত একটি সঙ্গীত স্কুলও।

সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে আরও জানতে পারি, শুক্রবারের ওই ঘটনার পরদিন শনিবার পুরো নাসিরনগর এ ঘটনা নিয়ে উত্তপ্ত থাকে। আহলে সুন্নাতে ওয়াল জামায়াত নামে একটি সংগঠন রবিবার একটি বিক্ষোভ সমাবেশও আহ্বান করে। যখন হিন্দু পাড়াগুলোতে ভাঙচুর চলছিল, তখন আধা কিলোমিটার দূরে ওই সংগঠনটির বিক্ষোভ সমাবেশও চলছিল।

এমন একটি স্পর্শকাতর ঘটনার পর যেখানে জেলা প্রশাসনের বাড়তি সতর্কতার প্রয়োজন ছিলো, সেখানে একটি সংগঠন এই ঘটনার প্রতিবাদে সমাবেশে আহ্বান করে এবং সমাবেশটি অনুষ্ঠিতও হয়?

সম্প্রতি আমরা দেখেছি, নিরাপত্তার অজুহাতে রাজনৈতিক দলগুলোকে অনেক ক্ষেত্রেই প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশ-মিছিলের অনুমতি দেওয়া হয় না। সেখানে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত  কিভাবে সমাবেশ করার অনুমতি পেল?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কার কাছে চাইব? 

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রিয়াজ ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেছেন, ‘জাত্যাভিমানের কারণে, ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বাংলাদেশের সংবিধান থেকে শুরু করে সাধারণ কথোপকথন পর্যন্ত সর্বত্র যে উগ্র জাতীয়তাবাদী ঔদ্ধত্য, যে মেজরিটারিয়ানিজমের (সংখ্যাগুরুবাদ) দাপট, তার পরিণতি হলো বাংলাদেশে বারবার সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা। তাদের নিরাপত্তাহীনতা। একই কারণে ভাষাগত, ধর্মীয়, কিংবা রাজনৈতিক সংখ্যালঘুরা হচ্ছে নির্যাতনের শিকার।’ এই পরিস্থিতি বুঝতে গিয়ে অর্জুন আপ্পাদুরাইয়ের কথা মনে পড়ছে; ‘ফিয়ার অব স্মল নাম্বারস’ যারা পড়েছেন, তাদের কাছে এসব কথা সম্ভবত নতুন শোনাবে না। আত্মপরিচয় নিয়ে আমিন মালুফের বই ‘ইন দ্য নেইম অব আইডেন্টিটি’-এর পাঠকেরা জানেন আমরা আইডেন্টিটির নামে কি ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করি। মনে করা দরকার ‘আমরা’ এবং ‘তাহারা’-র আড়ালে আমরা কিভাবে তৈরি করি শত্রু, ঘরের ভেতরে ও বাইরে। বাংলাদেশের একজন নির্বোধ রাজনীতিবিদ-মন্ত্রী যে বলেছিলেন, ‘লুকিং ফর শত্রুজ’ তার চেয়ে বড় সত্য আর হয় না। আমরা ক্রমাগতভাবে শত্রুর খোঁজে নিয়োজিত। আজ না পেলে কাল অবশ্যই পাব। কেননা তাদের শত্রু হতে হবে না। আমরা তাদের শত্রু হিসেবে ‘নির্মাণ’ করব।

ফলে (রবিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়) যা ঘটেছে, তার দায়িত্ব নামহীন গোত্রহীন মানুষদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে যারা আত্মপ্রসাদ পেতে চাইছেন, তারা একবার আয়নার সামনে দাঁড়ালে সম্ভবত এ কথা বলতে দ্বিতীয় বার ভাববেন। যারা আগুন লাগিয়েছেন, ধ্বংসলীলায় অংশ নিয়েছেন, তাদের অপরাধ আইনি কিন্তু আমরা যারা এই পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক ও বৈধ করে তুলেছি দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, তারা কেন এই অপরাধের দায় মুক্ত হব? তারা কি এর কোনও দায় নেব না?

অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এ ধরনের কাজগুলো কখনও একটি বা দুটি ঘটনায় থেমে যায় না। নিন্দনীয় ঘটনাগুলো যেন একটা ধারাবাহিকতা মেনে চলে। যৌন নির্যাতন, শিশু হত্যা, শিশু ধর্ষণের মতো একটি ঘটনা যখন সারাদেশের মানুষের বিবেককে নাড়া দেয়, তার রেশ কাটতে না কাটতেই এ ধরনের একাধিক ঘটনার খবর আসতে থাকে দেশের নানা প্রান্ত থেকে। এটি যেন সেই দুষ্কৃতকারী, লম্পটদের একই রকম ঘটনা ঘটাতে উৎসাহ যোগায়! ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে নিদারুণভাবে। যা ঘটে গেছে, সেটি ফেরানোর পথ নেই। তবে, সতর্ক থাকা প্রয়োজন, এই সুযোগে দেশের অন্য কোনও স্থানে এই দুর্বৃত্তদের সহযোগীরা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে না পারে।

আমরা বিশ্বাস করি, প্রশাসন চাইলে এবং তাদের সদিচ্ছা থাকলে এসব ঘটনা অনেকাংশেই ঠেকানো সম্ভব। অন্তত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনাতো ঠেকানো যেতই; যেখানে ঘটনার সূত্রপাতের পর সেটি তাণ্ডবে পরিণত হওয়ার আগে প্রশাসন ৪৮ ঘণ্টারও বেশি সময় পেয়েছিল। কোন বিবেচনায়, কী কারণে মূল্যবান ৪৮ ঘণ্টাকে কাজে লাগাননি—প্রশাসনের কেউ কি এই প্রশ্নের জবাব দেবেন?

লেখক: সাংবাদিক

[email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ