X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

কলিম শরাফী শুধু সঙ্গীতে নয়, রাজনীতিরও একজন কিংবদন্তি

আমিনা আহমেদ
০৪ নভেম্বর ২০১৬, ১৫:৪২আপডেট : ২৪ নভেম্বর ২০১৬, ২১:২৪

আমিনা আহমেদ `আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু বিরহ দহন লাগে, তবুও শান্তি, তবুও আনন্দ জাগে…' যখনই এই রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনি বা মনে মনে গেয়ে ওঠি,  তখনই মনে পড়ে কলিম শরাফীকে। কিংবদন্তি এই শিল্পীর জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার শিউড়ী মহকুমার খয়রাডিহি গ্রামে ১৯২৪ সালের ৮ মে। জন্মের পর খুব অল্পবয়সেই মাকে হারান কলিম শরাফী। মা হারানো এই শিল্পীর শৈশব কেটেছে নানাবাড়িতে বিভিন্ন উৎসবে লেটোর গান, ঝুমুর গান শুনে শুনে। শৈশবে গানের সঙ্গে এক আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। কলিম শরাফীর পুরো নাম মাখদুমজাদা শাহ সৈয়দ কলিম আহমেদ শরাফী।
কলিম শরাফী কেবল কিংবদন্তি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীই নন, যৌবনে রাজনৈতিক আন্দোলনেও ছিলেন সোচ্চার। বিশেষ করে কলিম শরাফী যখন দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী, তখন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর ‘হলওয়েল মনুমেন্ট’ অপসারণ আন্দোলন শুরু হয়। নেতাজীর ডাকে শত শত তরুণ-কিশোর দলের একজন ছিলেন কলিম শরাফী। খুব স্বাভাবিকভাবেই এ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন তিনি। এভাবেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একজন সোচ্চার কর্মী হিসেবে নাম লেখান কলিম শরাফী। তখন থেকেই তিনি ছিলেন নির্যাতিত জনতার পক্ষের লোক। এ জন্যই আমরা কলিম শরাফীকে বলতে পারি- একাধারে তিনি ছিলেন বিশুদ্ধ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী এবং একই সঙ্গে দেশ ও বাঙালি জাতির সংস্কৃতির একজন সোচ্চার কর্মী। তখন থেকেই তিনি সংস্কৃতি বিকাশে এবং অসাম্প্রদায়িক সমাজ নির্মাণে ভূমিকা রাখতে শুরু করেন।
এমন উত্তাল সময়ের মধ্যেই তিনি ১৯৪২ সালে মেট্রিক পাস করেন। পরীক্ষা শেষ করেই তিনি গন্ধির ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে মানুষের সমর্থন আদায়ে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। এ আন্দোলনের একজন সোচ্চার কর্মী হিসেবে গ্রেফতার হন। এরপর তার পক্ষে শত শত জনতা স্লোগানে মত্ত হয়ে ওঠে। এমন পরিস্থিতে তরুণ কলিম শরাফীর মনে এক চেতনার রেখা টেনে দেয়। এক নতুন শক্তি যেন বাসা বাঁধে তার হৃদয়ে। তিনি আরও এগিয়ে যান দুরন্ত গতিতে।
এবার অবশ্য গানের সঙ্গে তার এগিয়ে যাওয়ার গল্পটাও কিছু বলা যেতে পারে। কলিম শরাফী যখন গানের অনুশীলনে ব্যস্ত, তখন তার সঙ্গে পরিচয় হয় এক মেয়ের। সেই মেয়েটি কলিম শরাফীর হাতে একটি চিঠি দিয়ে বলে, তার এক বন্ধুর কাছে পৌঁছে দিতে।  সেই সূত্র ধরেই তার সঙ্গে পরিচয় হয় সুচিত্রা মিত্র, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীদের। তাদের সঙ্গে শুরু করেন নতুন এক যাত্রা। এই দলের একজন প্রধান কণ্ঠ শিল্পী হয়েই তিনি গেয়েছেন দুর্ভিক্ষের গান, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী এবং স্বাধীনতার সঙ্গীত। ১৯৪৬ সালে তার প্রথম গণসঙ্গীতের একটি রেকর্ড প্রকাশিত হয়। এ সময় তিনি কলকাতার রেডিওতেও নিয়মিত একজন শিল্পী হয়ে ওঠেন।

কলিম শরাফী ১৯৫০-এর দিকে ঢাকায় আসেন। ওই সময় ঢাকায় ক্যাজুয়াল আর্টিস্ট হিসেবে যোগ দেন রেডিওতে। ১৯৫১ সালে তিনি ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রামে চলে যান। সেখানে গড়ে তোলেন ‘প্রান্তিক’ নামে একটি সংগঠন। মূলত পূর্ববাংলায় তিনি নবনাট্য আন্দোলনের প্রথম প্রতিনিধি। নানান চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে কলিম শরাফী ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর ঢাকার ডিআইটি ভবনে টেলিভিশন কেন্দ্র চালু হলে সেখানে অনুষ্ঠান পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। এই টেলিভিশন কেন্দ্রটির নাম ছিল পাকিস্তান টেলিভিশন, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন হয় বাংলাদেশ টেলিভিশন। তবে এখানে বেশিদিন চাকরি করতে পারেননি তিনি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত বেশি প্রচার করেন। বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলনেই সোচ্চার ছিলেন তিনি। সবসময় সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন যেমন সঙ্গীতে, তেমনি রাজনৈতিক আন্দোলনেও।

এত কিছুর মধ্যেও ১৯৬৯ সালে শিল্পী কলিম শরাফী সম্পৃক্ত হন উদীচীর সঙ্গে। দীর্ঘদিন তিনি ছিলেন উপদেষ্টা ও সভাপতি।

১৯৮৩ সালের এপ্রিলে 'সঙ্গীত ভবন' নামে একটি সঙ্গীত বিদ্যালয় গড়ে তোলেন কলিম শরাফী। এটি শান্তিনিকেতনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিল্পীদের প্রতিষ্ঠান। 'সঙ্গীত ভবন'-এর প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই শিল্পী কলিম শরাফী এ প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৯১ সালের ২৫ মার্চ একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির গণসমাবেশে অংশগ্রহণ করায় দেশের ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে তাকেও আসামি করা হয়। এতসব কিছু কখনোই তাকে দমাতে পারেনি। সবসময় ছিলেন তিনি ছিলেন যেকোনও আন্দোলনের নির্ভিক সৈনিক।

সবশেষে বলতে হয় সুকণ্ঠের একজন সঙ্গীতশিল্পী কলিম শরাফী। তিনি একজন অ্যাক্টিভিস্টও। শরাফীর শুরুটা হয়েছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তান বিরোধিতা ও জামায়াত বিরোধিতায়ও জীবনভর লড়েছেন তিনি। যুদ্ধাপরাধীদেরর বিচার দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা গণআদালতেও তার সম্পৃক্ততা ছিল। লেখনির মধ্য দিয়ে নিরন্তর বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সমৃদ্ধ করেছেন শরাফী। সাদামাটা জীবনযাপন করতেন শরাফী, যা ছিল দৃষ্টান্তমূলক। জীবনের  প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বিনয়ী।

আমি সৌভাগ্যবান যে, আমি সামগ্রিক সঙ্গীত জগতের এবং বাংলাদেশ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংস্থার এই কান্ডারির সান্নিধ্যে আসতে পেরেছিলাম।

‘বড় আশা করে এসেছি গো’ কিংবা ‘সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান’-এর মতো রবীন্দ্রসঙ্গীতে তার সঙ্গে দ্বৈতসঙ্গীত পরিবেশনার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।  এতে আমি সম্মানিত বোধ করেছি।

শিল্পী কলিম শরাফী এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে ৮৬ বছর বয়সে ২০১০ সালের ২ নভেম্বর চলে যান।  ২ নভেম্বর, ২০১০-এর দুপুরে ঢাকার বারিধারার বাড়িতে মারা যান। তার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জীবনের নানা স্মৃতি প্রকাশিত হয় ‘স্মৃতি অমৃত’ গ্রন্থে। বইটি ঢাকার আগামী প্রকাশনী ১৯৯৩ সালে প্রকাশ করেছিল। ৮৬ পৃষ্ঠার এই বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে ১৯৪২ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের স্মৃতির উদ্দেশে।

লেখক: রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মেঘলা আকাশ থেকে ঝরতে পারে বৃষ্টি, বাড়বে গরম
মেঘলা আকাশ থেকে ঝরতে পারে বৃষ্টি, বাড়বে গরম
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
কানে ডিভাইস নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে বোন, বাইরে থেকে উত্তর বলার অপেক্ষায় ভাই
কানে ডিভাইস নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে বোন, বাইরে থেকে উত্তর বলার অপেক্ষায় ভাই
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ