X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চড় মেরে পুলিশের কানের পর্দা ফাটানো 'কীর্তিমানদের' কথা

চিররঞ্জন সরকার
০৫ নভেম্বর ২০১৬, ১৫:৪৪আপডেট : ০৫ নভেম্বর ২০১৬, ১৯:০৬

চিররঞ্জন সরকার বাঙালি যুবরা ক্রমেই বাঘের বাচ্চায় পরিণত হচ্ছে। নিত্যনতুন রেকর্ড গড়ছে। মাত্র ১৯ বছর বয়সী এক যুবার অনন্যসাধারণ কৃতিত্বে সম্প্রতি বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটে ইংল্যান্ডকে পরাস্ত করেছে। তরুণ অলরাউন্ডার মিরাজ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টেই অভিষিক্ত হন। দুই টেস্টে ১৯টি উইকেট নিয়ে এই অফ স্পিনার হয়েছেন ম্যান অব দ্য সিরিজ। তার কৃতিত্বেই দ্বিতীয় টেস্ট জয় পায় বাংলাদেশ, ১-১ সমতায় শেষ হয় টেস্ট সিরিজ। এ জন্য খুশি হয়ে মিরাজের পরিবারের জন্য বাড়ি তৈরি করে দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ওদিকে শরীয়তপুরে চড় মেরে এক পুলিশের কানের পর্দা ফাটিয়ে নতুন এক রেকর্ড গড়েছে আরেক যুবা। প্রকাশিত খবর মতে, গত ১ নভেম্বর  সকালে শরীয়তপুর সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন হাওলাদারের ভাগ্নে সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি আকতার হোসেন ঢালি ও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ খলিলুর রহমান জাগরণ সদর হাসপাতালে আসে। এ সময় হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার দেবাশীষ সাহার কাছে জনৈক রোগী হোসেন খন্দকারের নামে মাথায় আঘাতের কারণে আহত দেখিয়ে একটি ভুয়া সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। ডাক্তার মিথ্যা সার্টিফিকেট দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। এতে ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিতে আসা আরেক রোগী পুলিশের নায়েক সেলিমুজ্জামান মাতুব্বর প্রতিবাদ করলে তাকে মারধর ও চড় মেরে কানের পর্দা ফাটিয়ে দেন।
চড় মেরে পুলিশের কানের পর্দা ফাটিয়ে ক্ষমতাসীন দলের দুই যুবা ঢালি ও জাগরণ উচিত কাজটিই করেছে। কেন বাবা, তুমি অন্যায়ভাবে ‘সরকারি কাজে’ (ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা যা কিছু করে তাই তো সরকারি কাজ; অন্তত তাই হওয়া উচিত) বাধা দিতে গেছ কেন? হাসপাতালে কেন তোমাকে পুলিশগিরি করতে হবে? তাছাড়া ওরা তো আর তোমার কাছে কোনো অন্যায় দাবি করেনি। যার সঙ্গে বিবাদ, ঠ্যালা সামলানোর দায়িত্বও তারই। তুমি কেন এখানে তোমার নোংরা নাকটা গলাতে গেলে? শুধু কানের পর্দা নয়, উচিত ছিল ওই পুলিশের প্রাণের পর্দাটাই ফাটিয়ে দেওয়া!
অবশ্য সবার আগে উচিত ছিল ওই ডাক্তার ব্যাটাকে পেটানো। সামান্য একটা সার্টিফিকেট দিতে তার এত আপত্তি কেন? ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের কত কী সামলাতে হয়, কত কিছু ম্যানেজ করতে হয়। একটা মিথ্যে সার্টিফিকেটের দরকার হতেই পারে। দিয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যেত। খামোখা কেন যে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির সাজতে গেল!
পিটিয়ে পুলিশের কানের পর্দা ফাটিয়ে ক্ষমতাসীন দলের যুবারা খারাপ কিছু করেছে—এটা আমাদের দেশে কেউ-ই মনে করেন না। পুলিশ পেটানো, শিক্ষক পেটানো, সাংবাদিক পেটানো, প্রতিপক্ষকে পিটিয়ে ঠাণ্ডা করা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ, সম্মেলন, মিছিল, বিক্ষোভ, ঘেরাওসহ যে কোনও ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি শক্তি দিয়ে দমন করা—এগুলো তো আমাদের দেশে অত্যন্ত স্বীকৃত ও কার্যকর পন্থা। এ কাজটি ক্ষমতাবানরা, রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী, পুলিশ, মস্তানরা অত্যন্ত দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গেই করে আসছে।
অপছন্দের ব্যক্তি কিংবা প্রতিপক্ষকে পিটিয়ে ঠাণ্ডা করার নীতি আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে। 'মাইরের ওপর কোনও ওষুধ নাই'—এটা আমাদের দেশে স্বীকৃত একটা সামাজিক নীতি। শক্তিমানেরা দুর্বল-অশিষ্ট-অবাধ্যদের শায়েস্তা করতে, নিরীহদের বশে রাখতে যুগ যুগ ধরে ডাণ্ডার ওপরই ভরসা করেছে।
আমাদের রাজনীতিতে সমালোচনা, প্রতিবাদ, আন্দোলন যে কোনও ধরনের বিরোধিতা দমন ও প্রতিপক্ষকে ঠাণ্ডা করতে মাইর বা শক্তি প্রয়োগের নীতি কার্যকর হয়ে আসছে। আইয়ুব, ইয়াহিয়া থেকে শুরু করে জিয়া-এরশাদ-খালেদা-হাসিনা পর্যন্ত সবাই কম-বেশি শক্তি বা 'ডাণ্ডা'র ওপর নির্ভরশীল হয়েই ক্ষমতার স্বাদ উপভোগ করেছেন এবং করছেন। ডাণ্ডা যে কোনও 'শক্তিমান' শাসকের জন্যই প্রধানতম অবলম্বন। বল ও ভরসা।

‘দুর্বল’রা সাধারণত ডাণ্ডা ব্যবহার করতে ভয় পায়। পাছে এসব ডাণ্ডা দ্বিগুণ প্রতিশোধ হয়ে ফিরে আসে—এই আশঙ্কাই সম্ভবত এ শ্রেণিকে ডাণ্ডাবিমুখ করে তোলে। তাতে অবশ্য সব সময় তেমন লাভ হয় না। সাধারণ মানুষ তাদের ভীরু-দুর্বল ভেবে পরিত্যাগ করে। পক্ষান্তরে ডাণ্ডাবাজদেরই জনগণ সমীহ এবং সম্মান করে। চড়, থাপ্পর, ডাণ্ডা, লাঠি, মাইর—মোটের ওপর শক্তি প্রয়োগের নীতি আমাদের দেশে বেশ জনপ্রিয়। সমাজে এসবের আলাদা গুরুত্ব ও তাৎপর্য আছে। শুধু 'শক্তিমান' সরকারের জন্যই এ দাওয়াই নয়, আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনেও এর উপযোগিতা ও কার্যকারিতা দেখা যায়।
সমাজে অশিষ্ট, বেয়াদব, ঘাড়ত্যাড়া, উদ্ধতদের বাগে আনতে, ঘাড় সোজা করতে যুগে যুগে চড়-থাপ্পড় বা মাইর মহৌষধ হিসেবে কাজ করেছে। গ্রামেগঞ্জে একেবারে শিশু অবস্থা থেকেই মাইরের চর্চা শুরু হয়। মাইরের ভয়েই শিশুরা বাবা-মায়ের অবাধ্য হয় না। সনাতন রীতির শিক্ষা ব্যবস্থায় স্কুলে শিক্ষকরা বেতিয়ে তথা মাইরের সাহায্যেই 'গাধা' ছাত্রকে 'মানুষ' করার দায়িত্ব পালন করতেন!
কুকুর-বেড়াল থেকে শুরু করে যে কোনও অবাধ্যকেই চড়-থাপ্পর বা মাইরের সাহায্যে উচিত শিক্ষা দেওয়ার কাজটি করা হয়। কী পারিবারিক জীবনে, কী সামাজিক জীবনে যে কোনও অপরাধের শাস্তি দেওয়া হয় চড়, কিল বা লাঠিপেটার মাধ্যমে। মাইরের ওপরে সত্যিই কোনও ওষুধ নেই। মাইরের চোটে ঠাণ্ডা বা সোজা হয়নি, এমন উদাহরণ বড় বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না। মাইর একাধারে অপরাধী, অশিষ্ট, পাগল, ভূত—সবাইকেই শান্ত বানিয়ে ফেলে। আমাদের সমাজে যতটুকু যা শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা তা সম্ভবত ওই ডাণ্ডা বা মাইরেরই অবদান! অপরাধীদের কথাই ধরা যাক। রিমান্ডে না নিলে অর্থাৎ না প্যাঁদালে কারও পেট থেকে কোনও তথ্য বের হয় না।

কোনও গুরুতর অভিযোগে কাউকে আটক করুন, এরপর বাবা-সোনা বলে, গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করুন, ওই কর্মটি করেছে কিনা, নিশ্চিতভাবেই সে তা অস্বীকার করবে। অথচ তাকে আচ্ছামতো ‘পেঁদিয়ে’ তারপর জেরা করুন, সে যা করেছে তা তো স্বীকার করবেই; এমনকি যা করেনি তাও সুবোধ বালকের মতো কবুল করবে। এই 'ডাণ্ডা-অস্ত্র' প্রয়োগ করে আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কত না অসাধ্য সাধন করছে।
আসলে মাইরের একটি আলাদা শক্তি আছে। এর মাধ্যমে অবশ্যম্ভাবী ঘটনাকে যেমন ভেস্তে দেওয়া যায়, ঠিক তেমনি অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়। তবে ডাণ্ডাতন্ত্র নিয়ে একটাই শুধু ভয়, বিজ্ঞানী নিউটন সাহেবের পদার্থ বিজ্ঞানের সেই যুগান্তকারী সূত্র: 'প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।' এ সূত্রের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য নিয়েই যতটুকু যা শঙ্কা। এখনকার এই চড়, থাপ্পর, মাইর, লাঠিপেটা যদি কখনও দ্বিগুণ হয়ে ফিরে আসে তখন কী হবে? মাইর, শক্তি এবং ডাণ্ডা যারা ব্যবহার করেন, তাদের জন্য এটাই শুধু ভাবনার ব্যাপার!
পুনশ্চ: চড়-থাপ্পড় বা শক্তিপ্রয়োগ নয়, ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের আরও কিছু দুর্লভ কৃতিত্বের খবর পাওয়া গেছে। সম্প্রতি রাজধানীর খিলগাঁও মডেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্র লীগের নেতারা মাত্র ৪০০/৫০০ টাকার বিনিময়ে পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর অর্থাৎ নকল সাপ্লাইয়ের দায়িত্ব পালন করছেন বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট ছাত্রলীগ নেতাদের টাকা দিয়ে তালিকাভুক্ত হলে পরীক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে প্রশ্নের উত্তর, বইয়ের কপি। সেটাও শিক্ষকদের সামনেই। একটি সহযোগী দৈনিক জানিয়েছে যে, পরীক্ষা চলাকালে এই নকল বাণিজ্যে ছাত্রলীগ নেতাদের দৈনিক আয় ৯০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। একাধারে আত্মকর্মসংস্থান এবং রামমোহন-বিদ্যাসাগরের পর শিক্ষা বিস্তারে অপরিসীম অবদানের জন্য সংশ্লিষ্ট ছাত্রলীগ নেতাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতা পদক দিতে পারেন!
ওদিকে ভিক্ষুক পুনর্বাসন কর্মসূচির অর্থ আত্মসাতের লক্ষ্যে যশোরের মণিরামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অত্যন্ত ‘সৃজনশীল’ একটি উদ্যোগ নিয়েছে। তারা নিজেরাই ভিক্ষুকের তালিকায় নাম লিখিয়েছে! সম্প্রতি খুলনা বিভাগের ১০ জেলাকে ভিক্ষুকমুক্ত করার কথা জানান বিভাগীয় কমিশনার আব্দুস সাত্তার। এ জন্য জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে প্রকৃত ভিক্ষুকের তালিকা তৈরির জন্য বলা হয়। তারই অংশ হিসেবে মণিরামপুর উপজেলা প্রশাসন একটি তালিকা প্রস্তুত করে ওয়েবসাইটে দিয়েছে। তাতে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতা, সচ্ছল ব্যক্তি এবং একই পরিবারের একাধিক সদস্যকে ভিক্ষুক হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে (কালের কণ্ঠ, ২৫ অক্টোবর, ২০১৬)।
বড় হতে চাইলে আগে নাকি ছোট হতে হয়। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ভিক্ষুকের তালিকায় নাম লিখিয়ে প্রমাণ করেছে কত ছোট হওয়া যায়! এই দলের নেতাকর্মীরা একদিন সত্যিই বড় হবে, অনেক বড়!

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ