X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘পুরুষ হয়েছ ঢের, এবার মানুষ হও’

শারফুদ্দিন আনাম
০৫ নভেম্বর ২০১৬, ১৬:৩৬আপডেট : ০৫ নভেম্বর ২০১৬, ১৬:৩৯

শারফুদ্দিন আনাম বহুবছর আগে উপমহাদেশের বিখ্যাত গীতিকার জাভেদ আখতারের একটা সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম। সেখানে অনেক কথার মাঝে তিনি বলেছিলেন, কমবেশি সব পুরুষই ধর্ষকামী। হয়ত কারও ক্ষেত্রে তার প্রকাশ ঘটে, কেউবা সেটা দমিয়ে রেখে ধীরে-ধীরে সেই খারাপ বোধটাকে সামলে নেয়।
এরপরের বেশ কিছুদিন মাথায় ‘ধর্ষকামী’ শব্দটা ঘুরছিল। ভাবছিলাম, ‘ধর্ষণ’ শব্দটা শুনলেই পুরুষ হয়েও আমি পুলকিত হই না কেন? আমার আত্মমর্যাদায় লাগে? একটা অপরাধ হিসেবে তো নিশ্চয়ই, তবু সে অপরাধের অস্তিত্বকে ছাপিয়ে, বেশ ভারী রকমের একটা অপমানবোধও যেন তৈরি হয় ভেতরে—কিন্তু কেন? কারণ খুঁজতে গিয়ে অনেক কিছুর সঙ্গে এও মনে হয়, যা নিতে যাচ্ছি, তা পুরোটাই জোরপূর্বক। আর জোরের দান তো ভিক্ষাবৃত্তির চেয়েও অনেক নিম্নমানের।
তাই যদি হয়, তাহলে কিভাবে একজন পুরুষ তার ‘পৌরুষের’ দম্ভে জঘন্য এ ঘটনা ঘটিয়ে বীরের বেশে হাসে? তার ইন্দ্রিয়ের ভেতরে যে চেতনা, তাকে বীররসে সিক্ত করা দম্ভ এনে দেয়, তা তো বাহিত হচ্ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। আজও মনে আছে, স্কুল জীবনে ব্যাকরণ বোঝাতে কোনও এক শিক্ষকের মুখে শোনা সেই তথাকথিত পুরুষ-বাণী—পুরুষ হলো ‘ভার্ব’, মেয়েরা হলো ‘অক্সুলারি ভার্ব’। ছোট্ট সে মনটা এত হিসাব সেদিন কষেনি, বয়স তাকে ততটা বুঝতেও দেয়নি। কিন্তু বেশ মনে আছে, খুব করে অস্বস্তিতে ভুগেছিলাম। বাড়িতে ফিরে মা, বোন, ফুপু, পাশের বাড়ির চাচি সবাইকে নতুন করে দেখলাম। তাদের নিয়ে নতুন করে ভাবলাম। এই তালিকায় ছিলেন স্কুলেরই আরও দু’জন শিক্ষিকা। সবাইকেই যেন নতুন করে বোঝার চেষ্টা করলাম। অবশেষে যা থাকার থেকে গেলো, যা ঝরার ঝরে পড়লো, কিছুরই পরিবর্তন হলো না। ‘মেয়ে হচ্ছে মায়ের জাত, মায়ের সেই জাতকে যে সম্মান জানাতে পারে না, সে নিজেও কোনও দিন সম্মান পায় না’ —নিজের মায়ের কাছে অজস্রবার শোনা এই কথাটি সেদিন বেশ ভালোভাবেই ‘ভার্ব’ ও ‘অক্সুলারি ভার্ব’ আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল। বড় হলাম, আস্তে আস্তে বুঝলাম, মানুষের শরীর ও মনের মাঝখানে একটা অদৃশ্য ফিল্টার থাকে। তার নাম ‘শিক্ষা’। পুথিগত শিক্ষার কথা বলছি না, বলছি বিবেক ও মর্যাদাবোধ জাগরণের শিক্ষার কথা, যা পরিবার শেখায়। যে ছেলেটি পরিবারে নারীদের মর্যাদা সমুন্নত হতে দেখে ধাপে ধাপে বড় হয়, সে আর যা-ই হোক, কখনোই একজন ধর্ষক হতে পারে না।
তবে পুরুষের সবচেয়ে বড় শিক্ষালয় তার নিজের মন। পুরুষ নাম নিয়ে পরিবারের বা সমাজের নিয়ন্ত্রক হিসেবে নয়, মানুষ নাম নিয়ে ভালো-মন্দ মেলানো একজন হিসেবে নিজেকে দেখতে শেখাটাও একটা শিক্ষা। মানুষ হিসেবে প্রায় সবরকমের বোধ, আকাঙ্ক্ষা মনের উপলব্ধিতে আসে। কিন্তু প্রকাশ ভঙ্গিমায় তা কতটা থাকবে, থাকলেও তা কিভাবে সংযত করা যায়, শরীরে খাদ্য পরিপাকক্রিয়ার মতো কিভাবে ভালো নির্যাসটুকু রেখে উচ্ছ্বিষ্টটুকু পরিহার করা যায়, তা কেবল নিজেই নিজেকে শেখানো যায়। সেই শিক্ষার ছাকনিতেই প্রেমময় আলিঙ্গন আর খুবলে তুলে মুখে পুরবার তফাৎটা ধরা পড়ে। সেই শিক্ষার আয়নায় ভোগ আর উপভোগের বিভেদের প্রতিবিম্ব পরিষ্কার হয়।

চারপাশে হঠাৎ করেই যেন জোর করে জাহিরের সেই ‘পৌরুষ’ মেলা বসেছে। আসলেই কি তাই? নাকি আগে অভিজাতের বাইরে গণমানুষের সংবাদপত্র পাঠ ছিল কেবল চায়ের টেবিলে, তাই বড় ঘটনা ছাড়া বাকি সব রয়ে যেত লোকচক্ষুর অন্তরালে; আর এখন প্রতিমুহূর্তে মুঠোফোনে নোটিফিকেশন, অনেক বেশি সচেতন গণমাধ্যম, তাই চোখ এড়ায় না কারও? জানি না, এই  নিরীক্ষা হয়ত প্রাসঙ্গিক। তবে তার চেয়েও অনেক বড় আলোচ্য ‘ধর্ষণ’-এর মতো ঘৃণ্য শব্দের সঙ্গে জুড়ে যাওয়া ‘শিশু’ শব্দটি। ঘৃণায় মুখের ভেতর জট পাকানো থুথুর দলা এতে হয়ত আকারে আরও অনেক বড় হয়েছে, তাই বলে আমি কিন্তু অবাক হইনি। কারণ নিজের মনের ভেতরে এই ঘৃণ্য কাজ করার তাড়না যাকে চালিয়ে ফেরে, বয়স ভেদ করার মানবিকতা বা মানসিক সুস্থতাটুকু তার এখনও অবশিষ্ট আছে, আমি তা একদমই মানতে নারাজ। এ কারণেই আড়াই থেকে শুরু করে পাঁচ, দশ, বারো, তেরোসহ যেকোনও বয়সী শিশুই বাদ পড়ছে না। যেমনভাবে বাদ পড়ছেন না, মাসখানেক আগে সাভারে তিরিশ বছর বয়সী এক ধর্ষকের লালসার শিকার এক বৃদ্ধা। যার মেয়ের বয়স ৬৩ আর নিজের বয়স ৯০। বোঝাই যায়, আড়াই নাকি নব্বই, সমস্যাটা সেখানে আটকে নেই। ধর্ষকও কিন্তু আটকে নেই। আটকে আছি কেবল আমরা, সাধারণ মানুষগুলো, যারা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি একে অন্যের দিকে। যাদের মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য জীবনের অর্ধেকটা সময় বইয়ে দিতে হয় হাঁটে, মাঠে, পথে, ঘাটে, বাজারে, অফিসে। ১২/১৪ ঘণ্টা কাজ করা সাধারণ মানুষ, যাদের কাছে সাপ্তাহিক ছুটির দিনটা ‘নাগরিক ঈদ’ হয়ে ধরা দেয়, তারা এখন নিজের বোন, মেয়ে, কন্যাশিশু এমনকি ক্ষেত্রবিশেষ পুত্র কিংবা বালক শিশু নিয়ে ‘ধর্ষণভাবনা’ ভাবছেন নতুন করে।

দম বন্ধ লাগছে? একটু হাফ ছাড়ি চলুন। আচ্ছা কেউ বলতে পারেন, একেবারে বিলুপ্তপ্রায় জায়গা থেকে সবার প্রিয় ইলিশ কিভাবে প্রতুলতার বন্যায় ভেসে গেল? কিভাবে ক’বছর আগেও সোনার দামে বিকোনো এই জিনিস ‘সোনারমাছ’ না থেকে মনভোলানো গন্ধ নিয়ে আপনার মনের মতো দামেই ‘মাছ’ হয়ে ফিরে এলো আপনার পাতে—ভেবেছেন? তার ফিরে আসার কারণ, এর পেছনে কঠোরভাবে আইন ও বিধিনিষেধের প্রয়োগ। মাইলের পর মাইল অবৈধ জাল পোড়ানো হয়েছে, শাস্তি হয়েছে, কঠোর মনিটরিং হয়েছে। ফল হাতেনাতে। যেকোনও অপরাধে আইনের তাৎক্ষণিক কিছু পদক্ষেপ খুব জরুরি। ধর্ষণ বা শিশুধর্ষণ যা-ই বলি, কঠোর শাস্তির মাত্র ২/১ টা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে, তা হতে হবে সর্বনিম্ন সময়সীমার মধ্যে এবং অবশ্যই তা বেশ ফলাও করে। তাহলেই এই বর্বরতার চলন থেমে যাবে অনেকাংশে, ধর্ষণের শিকার হয়ে কেউ পড়ে থাকবে না, ধর্ষক নিজেই মুখ থুবড়ে পড়বে।  শকুনগুলোর অন্তরাত্মা নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কোন বিকল্প নেই। যত ব্যস্ততাই থাকুক, যত সমস্যায় আমরা জর্জরিত থাকি না কেন, এই আবেদনের চেয়ে বড় এই মুহূর্তে আর কোন দাবি থাকতে পারে না।

মনের সবচেয়ে নিচুস্তর থেকে ক্ষোভ নিঙ্‌ড়ানো ধিক্কার জানাই তাদের, যাদের কারণে ঘৃণার থুথু, পুরুষ হিসেবে কখনও কখনও আমাকেও সিক্ত করে চলেছে।

লেখক: অ্যাসোসিয়েট নিউজ এডিটর ও সিনিয়র প্রেজেন্টার, একাত্তর টেলিভিশন
[email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
কানে ডিভাইস নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে বোন, বাইরে থেকে উত্তর বলার অপেক্ষায় ভাই
কানে ডিভাইস নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে বোন, বাইরে থেকে উত্তর বলার অপেক্ষায় ভাই
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ