X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

আমলা ও জনগণ

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
০৯ নভেম্বর ২০১৬, ১৩:১০আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০১৬, ১৩:২৭

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) চৌধুরী মোয়াজ্জাম আহমদকে শেষ পর্যন্ত সরিয়ে নিয়েছে সরকার, কিন্তু তার শাস্তি হয়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক যুবকের ধর্মীয় অবমাননাকর একটি পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে ৩০ অক্টোবর সকালে স্থানীয় ডিগ্রি কলেজ মোড়ে আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’আতের উপজেলা কমিটির আহ্বায়ক রিয়াজুল করিমের নেতৃত্বে এবং স্থানীয় খেলার মাঠে খাঁটি আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’আতের সভাপতি মো. মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে পৃথক দুটি সমাবেশ হয়। উপজেলা প্রশাসন ওই সমাবেশের অনুমতি দিয়েছিল। ওই দিন ওই সমাবেশ থেকে হিন্দুদের মন্দির ও বাড়িঘরে হামলার ঘটনাটি ঘটে বলে অভিযোগ ওঠে।
ঘটনার পরে সরকারি অফিসে চৌধুরী মোয়াজ্জাম আহমদকে মন্ত্রীর উপস্থিতিতে যেভাবে সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হতে দেখা গেছে, তাতে বোঝা যায় কতটা কদর্য সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে বিকশিত হচ্ছে আমাদের আমলাতন্ত্র। বারবার তিনি চিৎকার করেছে, সাংবাদিকদের শারীরিকভাবে আক্রমণ করতে ছুটে গেছেন আর বলে গেছেন, ‘চেনেন আমি কে?’ ভিডিওটা যতবার দেখেছি, মনে হয়েছে ক্যাডার সার্ভিস কর্মকর্তা নয়, যেন কোনও সত্যিকারের ক্যাডারের হিংস্রতা দেখছি।
দীর্ঘ মেধাচর্চা, কঠোর শ্রম, নিয়মানুবর্তিতা, নৈর্ব্যক্তিক ও বাস্তববাদী প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজগঠন ও সংস্কারে তীব্র ইচ্ছাশক্তি ও আত্মবিশ্বাস এবং জনগণের সেবক হিসেবে সবসময় মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত, এই গুণাবলি যে- জনপ্রশাসকের মাথার মুকুট, তাকে ‘আমলা’ অভিধা দেওয়া হয়। এর কি কোনও কিছু আর অবশিষ্ট আছে? ব্রিটিশরা চলে গেছে, পাকিস্তানিরও গেছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৫ বছর, অথচ আমাদের জনপ্রশাসককে সমাজ-বিচ্ছিন্ন থাকতে তার সেবকদের আমলায় রূপান্তরিত করে আমলাতন্ত্র প্রসারিত হয়েছে এমন তীব্রভাবে যে উচ্চ আদর্শ, উচ্চ শির, উচ্চ চরিত্র এখন এই পেশার আর বৈশিষ্ট্য নয়।
নিঃসন্দেহে সব আমলাই চৌধুরী মোয়াজ্জাম আহমদের মতো নয়। কিন্তু একটা পারসেপশন বা সাধারণ ধারণা এখন এদের ব্যাপারে এমনই। আমাদের শাসনতন্ত্র ব্রিটিশদের থেকে যে শাসনব্যবস্থা গ্রহণ ও আত্মস্থ করেছে, তা পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তা, বিশেষ করে, বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের অফিসারদের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তব শাসন ব্যবস্থায় তারা নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেন, নির্বাচিত সরকার ও তার মন্ত্রীদের জননেতা হতে দক্ষ প্রশাসকে পরিণত করার প্রক্রিয়াটির প্রয়োজনীয় তদারকিও তারাই করেন। শাসন পরিচালনার জটিল, বহুমুখী ও বহুমাত্রিক বিষয়গুলো নেতা-মন্ত্রীদের গোচরে আনা, তাদের সে সব বুঝানো এবং হাতে ধরে শেখানোর কাজও এদেরই। কিন্তু সময় যত যাচ্ছে দেখছি এরা হয়ে উঠছে মন্ত্রী আর এমপিদের তাবেদার।
চৌধুরী মোয়াজ্জাম আহমদ হিন্দুদের বিরুদ্ধে শুধু সমাবেশের অনুমতিই দেননি, নিজে সেই সমাবেশে বক্তব্য রেখেছেন। কী সাংঘাতিক চাকরিবিধি লঙ্ঘন! অথচ এখন পর্যন্ত ব্যবস্থা বলতে শুধুই প্রত্যাহার। গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে এমন একটি নাজুক সময়ে তিনি যে আচরণ করেছেন, বোঝা যায় সাধারণ সময়ে কতটা গণবিরোধী ভূমিকায় থাকেন তিনি। দুষ্কৃতিকারীদের যে তাণ্ডব এলাকা জুড়ে সংঘটিত করেছে, তা মোকাবিলায় কোনও চেষ্টা যে ছিল না এই প্রশাসকের সেটা তার আচরণেই স্পষ্ট।

আমলারা সরকারের স্থায়ী কর্মচারি। তাদের অন্যতম দায়িত্ব হলো, যেসব রাজনীতিক সরকারি কাজে নিযুক্ত তাদের সরকারি নীতিমালা সম্বন্ধে অবহিত করা, পরামর্শ দেওয়া এবং সরকারি নীতি ও নির্দেশনা অনুসারে কাজ বাস্তবায়ন করা। তারা তাদের দায়িত্ব ও পালনের জন্য জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে দায়ী। তবে শেষ বিচার তিনিই দেখবেন কোথাও আইনের ব্যত্যায় ঘটছে কিনা।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ভারতে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরপরই প্রশাসনিক কাজে স্বচ্ছতা ও গতি আনতে সর্বভারতীয় সিভিল সার্ভিসের বিধিতে সংশোধন করেন। সংশোধনীতে আমলাদের সততার পাশাপাশি নীতি বোধ এবং ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার  উৎকর্ষতা বৃদ্ধির ওপরে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। কোনও প্রশাসনিক বিষয়ের গুরুত্ব বিচার করে স্বচ্ছতা ও পক্ষপাতহীনভাবে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব পালন করবেন বলে নয়া বিধিতে উল্লেখ করা।
এমন নির্দেশনা আমরা বাংলাদেশেও শুনি। কিন্তু তা কতটা বাস্তবে দেখা যায়? মাঠ পর্যায়ে তারা আর প্রশাসনিক ক্যাডার থাকেন না, হয়ে ওঠেন রাজনীতিকদের ক্যাডার, হয়ে ওঠেন এক একজন চৌধুরী মোয়াজ্জাম আহমদ। আর কেন্দ্রীয পর্যায়ে এরা হয়ে ওঠেন বড় রাজনীতিকদের মতোই ক্ষমতালিপ্সু, সুবিধাবাদি।
বাংলাদেশে বিদ্যমান আমলাতন্ত্র ১৮৫৮ সালে চালু করা ভিক্টোরিয়ান আমলাতন্ত্র। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের শাসন সরাসরি ব্রিটিশরাজের হাতে ন্যস্ত করেছিল। কোম্পানি শাসন থেকে বৃহৎ ভারত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। উপনিবেশ ভারত ‘শাসন’-এর জন্য প্রযুক্ত হলো ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস। ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তির মাধ্যমে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস হিসেবে নাম বদলের ধারায় ১৯৭২ সালে হয় বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস। নিয়োগ পদ্ধতি, কাঠামো, স্তর বিন্যাস ও মূল্যবোধে কোনও ইতিবাচক ও গণতান্ত্রিক পরিবর্তন কিন্তু আসেনি। উপনিবেশ শাসনের মতোই এরা শুধু মানুষকে শাসন করা জানে, জনগণকে সেবা দেওয়ার কথা মনোজগতে কখনও থাকেনা।

অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান কিছুদিন আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সম্মেলন কক্ষে এক অনুষ্ঠানে সরকারি অফিসের আচরণ পরিবর্তনের আহবান রেখেছিলেন।  বলেছিলেন, 'আমাদের আচরণগত কিছু বিষয় আছে, পুরনো দিনের আচরণ, সরকারি অফিসগুলোর চালচলন, আমি কাউকে দোষ দিচ্ছি না, আমি নিজেও এর মাঝ দিয়ে এসেছি। পরিবর্তনের হাওয়ার সাথে সাথে আমাদের এটিও পরিবর্তন হওয়া উচিৎ’। তিনি বলেছেন, সরকারি অফিসগুলোতে গেলে যে ব্যবহার পান মানুষ তা কাম্য নয়। 

অর্থ প্রতিমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করতে পারেন, তবে বাস্তবতা এটাই। গণতান্ত্রিক সমাজ বা স্বাধীন  স্বদেশের জনগণের সেবার উপযোগী সংস্কার বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রে হয়নি। তাই ক্রমেই এরা একেকজন চৌধুরী মোয়াজ্জেম হয়ে উঠছেন, যারা বিকারগ্রস্ত, ঔদ্ধত্যপূর্ণ, দুর্নীতিপরায়ণ, ও দলবাজ। পদায়ন ও পদোন্নতি দলীয় আনুগত্য ও দলীয় চাটুকারিতার ভিত্তিতে হওয়ায় আমলারা জনসেবক নন, গণবিরোধী  ভূমিকাতেই বেশি সক্রিয়। দায়িত্ব রাজনৈতিক সরকারের। আমলাতন্ত্রের চরিত্র ও মূল্যবোধে গণতান্ত্রিক রূপান্তর না ঘটাতে পারলে উন্নয়ন আর গণতন্ত্র দুটোই একসময় ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে।

লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ