X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রাম্প ভেলকি ও অনিশ্চিত যাত্রা

চিররঞ্জন সরকার
১১ নভেম্বর ২০১৬, ১১:৫২আপডেট : ১১ নভেম্বর ২০১৬, ১১:৫৮

চিররঞ্জন সরকার এর আগে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের সময় জনমত জরিপ, বিশেষজ্ঞরা সবাই বলছিল, আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিজয়ী হবে। হয়নি। আমেরিকার এবারের নির্বাচনের ক্ষেত্রেও কোনও ভবিষ্যৎ বাণীই কাজে লাগেনি। সব জরিপ, বিশেষজ্ঞ মতামতকে ভুয়া প্রমাণ করে ৪৫তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তারই হাত ধরে আট বছর পরে ক্ষমতায় ফিরল রিপাবলিকান পার্টি। ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন’-এই স্লোগানেই বাজিমাত করলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি রাজনীতির লোক নন। তার ধরন-ধারণ মোটেই রাজনীতিক-সুলভ নয়৷ স্বাদুভাষণ , এমনকি সাধুভাষণ, তার একেবারেই আসে না৷ কাটা -কাটা কথা , উপরন্তু অন্যদের নিন্দেমন্দ করা তার স্বভাবসিদ্ধ বাচনভঙ্গি৷ এ সব সত্ত্বেও ট্রাম্পের জয় হলো!
ট্রাম্প একজন সফল ব্যবসায়ী ও ধনী ব্যক্তি। নির্মাণ ব্যবসার পাশাপাশি বিনোদন জগতেও তিনি রাজত্ব গড়ে তোলেন। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত মিস ইউনিভার্স, মিস ইউএসএসহ বিভিন্ন সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার আয়োজক সংস্থার মালিক ছিলেন তিনি। ২০০৩ সালে এনবিসি টেলিভিশনে তিনি শুরু করেন জনপ্রিয় শো 'অ্যাপ্রেনটিস'। ১৪ বছর ধরে এই শো তিনি চালিয়েছিলেন।
এই ‘ভদ্রলোক’ বিয়ে করেছেন তিনবার। তার স্ত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত প্রাক্তন চেক অ্যাথলেট এবং মডেল ইভানা জেলনিকোভা। ১৯৯০ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়। সেই সময় তার বিরুদ্ধে স্ত্রীকে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছিল। ১৯৯৩ সালে তিনি মারলা মেপলসকে বিয়ে করেন। দ্বিতীয় ওই বিয়েও ভেঙে যায় ১৯৯৯ সালে। এরপর ২০০৫ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিয়ে করেন তার বর্তমান স্ত্রী, মডেল মেলানিয়া ক্নাউসকে।
এবার নির্বাচনের আগে আনুষ্ঠানিকভাবে তার বিরুদ্ধে অন্তত এক ডজন নারী যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন। তাদের তিনি ‘দেখে নেব’ বলে হুমকিও দিয়েছেন। সেই নারীদের রাতের ঘুম হারাম করে দিয়ে নির্বাচনে ট্রাম্পই জিতেছেন।
তার এই বিজয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ছাড়া বিশ্বনেতারাও খুব একটা খুশি হয়েছেন বলে মনে হয় না। একমাত্র পুতিনই ট্রাম্পকে, হিলারের চেয়ে ‘যোগ্যতর প্রেসিডেন্ট’ বলে মনে করার কথা প্রকাশ্যেই জানিয়েছিলেন।
হিলারির মতো একজন বিশুদ্ধ রাজনীতিককে বাদ দিয়ে মার্কিন নাগরিকরা কেন এমন একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে তাদের নেতা হিসেবে বেছে নিলেন-এই প্রশ্ন নিয়ে চলছে চুলচেড়া বিশ্লেষণ। তবে এ জন্য আমেরিকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও ডেমোক্র্যাটদের অর্থনৈতিক নীতিকেই বেশিরভাগ বিশ্লেষক দুষছেন। গভীর হতাশাবোধ শ্রমজীবী ও নিম্নবিত্ত শ্রেণিকে ট্রাম্পের মতো রাজনীতিকের দিকে ঠেলে দিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। মার্কিন শ্রমজীবীদের এই হতাশার কারণ বুঝতে হলে তাদের আর্থিক অনটন এবং অর্থনৈতিক সচ্ছ্বলতার অভাব, আর তার পাশাপাশি, অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান অসাম্য, এই তিনটে উপাদানের মিশ্রণের রসায়ন বুঝতে হবে।

সংখ্যাগুরু শ্বেতাঙ্গ শ্রেণির মধ্যে ট্রাম্পের মেক্সিকো-সীমানায় পাঁচিল তৈরির স্লোগান, মুসলিমদের দেশে ঢুকতে দেওয়া না দেওয়ার প্রস্তাব, কিংবা চীনের সঙ্গে কড়া হতে হবে-এই ধরনের জাতিবিদ্বেষী (xenophobic), অভিবাসন-বিরোধী, এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী (isolationist) স্লোগানগুলো জনপ্রিয় হয়েছে। ট্রাম্পের প্রস্তাবগুলো বঞ্চনাক্লিষ্ট সাধারণ আমেরিকানদের মনে ধরেছে।

একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ধরা যাক, আপনি একটা বাসস্টপে দাঁড়িয়ে। যদি অনেক বাস আসতে থাকে, আশেপাশে কিছু বিজাতীয় মানুষদের প্রতি আপনার মনে প্রীতিমূলক ভাব থাক বা না থাক, আপনি নিজের যাত্রার দিকেই মন দেবেন। কিন্তু বাসের সংখ্যা যদি কমতে থাকে, তখন বাসস্টপে যাত্রীর ভিড় বাড়বে, আপনার হতাশা এবং রাগ উত্তরোত্তর বাড়বে এবং মনে মনে নিশানা খুঁজবেন কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে পুঞ্জীভূত হতাশা উগরে দেওয়ার। অপেক্ষমাণ সব যাত্রী যদি দৃশ্যত একই রকম হয়, তা হলে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া না করে তাদের ক্ষোভ ‘বাসের সংখ্যা এত কম কেন’ এই দিকে গড়াবে। কিন্তু সেখানে যদি দৃশ্যত অনেক বহিরাগত যাত্রী থাকে, তা হলে সংখ্যাগুরু গোষ্ঠীর রোষ তাদের দিকে গিয়ে পড়বে। বাস যদি চাকরি বা অন্যান্য অর্থনৈতিক সুযোগের রূপক হয়, অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং সচলতা যত কমে, অভিবাসীদের মতো দৃশ্যমান এবং শনাক্তযোগ্য গোষ্ঠীর দিকে আঙ্গুল তোলার প্রবণতা তত বাড়ে। সাদা চোখে জাতিগত পরিচয় যতটা ধরা পড়ে, অর্থনীতির মানচিত্রের ওলোটপালট ততটা পড়ে না। তাই অভিবাসী এবং ভিনজাতীয়রা হয়ে দাঁড়ায় দেশের নানা সমস্যার ‘নন্দ ঘোষ’। আমেরিকায়ও তাই হয়েছে।

এই অবস্থার পরিবর্তনে তিনি নিজের দেশের বড় বড় কোম্পানিকে দাবড়ানি দিয়ে ঠাণ্ডা করে দিতে চেয়েছেন, যাতে তারা আমেরিকার শ্রমিকদের চাকরি অন্যত্র পাচার না করে; চীনের মতো আমেরিকা যাদের সঙ্গে বাণিজ্যে লিপ্ত, সেই সব দেশের সঙ্গে এমন দরাদরি করতে চেয়েছেন যে, তারা সুড়সুড় করে তার সমস্ত শর্ত মেনে নিয়ে নতুন বাণিজ্য চুক্তি করবে; আর অন্য দেশের বিশেষত অশ্বেতাঙ্গ কাউকে আমেরিকায় ঢুকতে দেবেন না যাতে তারা চাকরির বাজারে ভূমিপুত্রদের পিছু না হঠাতে পারে, বা আরও খারাপ সম্ভাবনার কথা ভাবলে, যাতে তারা অপরাধ আর সন্ত্রাসবাদের সমস্যা আরও না বাড়িয়ে তুলতে পারে। এই কথাগুলো সাধারণ আমেরিকানদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে। অবশ্য রিপাবলিকান দল চিরকালই আকাট ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে বিশ্বাসী ; তাদের ধারণা নিয়ন্ত্রণ যত কমবে, ততই কর্মোদ্যম বাড়বে, বাণিজ্যের উন্নতি হবে, জীবনযাত্রার মান ঊর্ধ্বগামী হবে৷ তাই তারা কর-শুল্ক কমাতে চান, সরকারের প্রকোপ বাদ দিতে উৎসাহী, মনে করেন ধনীদের ভালো হলে গরিবদেরও ভাগ্য খুলবে৷

এখন ট্রাম্পের সামনে সব কিছু ‘করে দেখানোর’ চ্যালেঞ্জ। বাণিজ্য এবং অভিবাসন সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিলেও, দেশের পুঁজিপতিরা বেশি মজুরিতে দেশীয় অদক্ষ শ্রম নিয়োগ করবেন, এমন ভাবার কারণ নেই, বরং যান্ত্রিকীকরণ বাড়ার সম্ভাবনা, আর তার সঙ্গে জাতীয় পুঁজি স্থায়ী ভাবে দেশছাড়া হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। ১৫% ট্যাক্স রেহাতের প্রস্তাবটাও খুব একটা বাস্তসম্মত নয়।

একাধিক বিশেষ সমস্যা আজ ট্রাম্প একই সঙ্গে বিশ্বজগতের সামনে। সেগুলোর মোকাবিলা তিনি কীভাবে করবেন, তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। যেমন সন্ত্রাসবাদ৷ যেটা চিরকালই ছিল, স্বতঃস্ফূর্ত ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক; এখন হয়েছে সংগঠিত, রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ও বিজ্ঞানসমৃদ্ধ৷ বোমা ফেলা ও ড্রোন পাঠানো ব্যতিরেকে কোনও ভালো সমাধান এখনও কেউ জানে না। মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান, পাকিস্তান প্রশ্নে তার নীতি কী হবে, কিভাবে তিনি এইসব দেশের জটিলতর হয়ে ওঠা সন্ত্রাসবাদ সমস্যাকে মোকাবিলা করবেন- সেটা একটা বড় প্রশ্ন। উদ্বাস্তু ও অভিবাসন সমস্যা কিভাবে মোকাবিলা করা হবে- সেটাও একটা জটিল ধাঁধাঁ। উদ্বাস্তুরা সমুদ্রে ও ইউরোপের রাস্তাঘাটে মরছে; শুধু সিরিয়া থেকেই উৎখাত প্রায় এক কোটি নরনারী, কিন্তু জঙ্গিদের ভয়ে অনেকেই এদের নিতে চাইছে না৷

চীন নিয়ে তাকে হাঁটতে হবে সরু সুতোর ওপর দিয়ে। এক দিকে মানবাধিকার সংকট, দক্ষিণ চীন সমুদ্রে চীনা আক্রমণের মোকাবিলা, অন্য দিকে চীনের বাণিজ্যিক গুরুত্ব। সিরিয়া ইস্যুতে রাশিয়ার সঙ্গে, পরমাণু অস্ত্র ইস্যুতে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে ওবামা প্রশাসনের যে বৈরিতা ছিল, এই বৈরিতাকে কিভাবে ম্যানেজ করবে-সেটাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

নির্বাচিত হওয়ার পর নিউইয়র্কে সমর্থকদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ডোনাল্ড ট্রাম্প ঐক্যের ডাক দিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সব মানুষের প্রেসিডেন্ট হবেন তিনি। বিভক্তির ক্ষত সারাতে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি আমেরিকাকে ঐক্যবদ্ধ করার ঘোষণা দেন। পাশাপাশি তিনি একথাও বলেছেন যে, ‘আমেরিকা এখন আর প্রাপ্য কিছুর চেয়ে কম মেনে নেবে না।’ তার এই শেষ কথাটি বিশ্ববাসীর জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমেরিকার এই ‘প্রাপ্য’ শুধতে তো পৃথিবীর অনেক দেশেই অতীতে রক্তগঙ্গা বয়েছে, এখন আবার নতুন করে ‘প্রাপ্য মেটাতে’ আবার না জানি কোন খেলা শুরু হয়!

ট্রাম্পের হাত ধরে কেবল আমেরিকানরাই নয়, বিশ্ববাসীও বুঝি এক অনিশ্চিত পথে যাত্রা শুরু করল! 

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কামরাঙ্গীরচর নাগরিক পরিষদের সঙ্গে মেয়র তাপসের মতবিনিময়
কামরাঙ্গীরচর নাগরিক পরিষদের সঙ্গে মেয়র তাপসের মতবিনিময়
সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির নতুন প্রো ভিসি এম মোফাজ্জল হোসেন
সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির নতুন প্রো ভিসি এম মোফাজ্জল হোসেন
কাপ্তাই হ্রদে তিন মাস মাছ শিকার বন্ধ
কাপ্তাই হ্রদে তিন মাস মাছ শিকার বন্ধ
আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচের আগে জিমিকে নিয়ে উত্তপ্ত হকি অঙ্গন
আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচের আগে জিমিকে নিয়ে উত্তপ্ত হকি অঙ্গন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ