X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

মার্কিন নির্বাচনে বিএনপির হস্তক্ষেপ!

আনিস আলমগীর
১৫ নভেম্বর ২০১৬, ২৩:৫২আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০১৬, ২০:০৯

আনিস আলমগীর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জামানত প্রদানের প্রথা আছে কিনা জানি না, যদি থেকে থাকে তবে মিডিয়ার প্রচারণায় মনে হয়েছিল হিলারি ক্লিনটনের হাতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জামানত বাজেয়াপ্ত হবে।
মিডিয়াগুলো এত উচ্ছ্বাসী হয়ে ওঠেছিলো যে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ম্যাগাজিন নিউজ উইক ‘ম্যাডাম প্রেসিডেন্ট’কভার হিস্ট্রি করে একটা বিশেষ সংখ্যাও আগেভাবে বের করেছিল। তাতে হিলারির দস্তক্ষতও নিয়েছিল। কথা ছিল ৯ তারিখ সন্ধ্যায় বাজারে ছাড়বে। ৯ তারিখ সকালবেলা কিছু নাকি অতি উৎসাহী হয়ে বাজারে ছেড়েও দিয়েছিলো। কিন্তু ফল বিপর্যয়ের পর সন্ধ্যায় তা প্রত্যাহার করে নেয়।
ঢাকার কাগজও পিছিয়ে ছিল না। ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামতো নির্বাচনের দিন স্বনামের কলাম লিখে নির্বাচনি সাফল্যের জন্য হিলারিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
ক্ষণে ক্ষণে জনমত জরিপ। কোনও জরিপে হিলারি পিছিয়ে ছিল না। আমাদের দেশের ইত্তেফাক ৮ তারিখ জনমত জরিপের পরিসংখ্যান দিয়ে দেখালো যে হিলারি জনমত জরিপে ২৫% এগিয়ে। জনমত জরিপটা এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একেবারে গুরুত্ব হারিয়ে ব্যর্থ ইন্সট্রুমেন্ট হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে।

জনমত জরিপের আবিষ্কারক ছিলেন মার্কিন পরিসংখ্যানবিদ জর্জ গ্যালপ। এজন্য এ পদ্ধতিটাকে গ্যালপ পোলও বলা হয়। সম্ভবতো মার্কিন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া জনমতকে বিভ্রান্ত করে হিলারির পক্ষে ভোট টানার জন্য এ কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলো। হিলারি ডলারের বস্তার মুখ খুলে দিয়েছিলেন। খরচের খাতে হিলারি নাকি ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন।

অনেকে বলতে পারেন যুক্তরাষ্ট্র সুসভ্য দেশ, আমি মিডিয়া বেচাকেনার ইঙ্গিত দিলাম কেন? আমেরিকায় এটা স্বাভাবিক ব্যবসা। বড় বড় সিনেটর, কংগ্রেসম্যানকে টাকা দিয়ে আপনি আপনার পক্ষে কাজে লাগাতে পারেন। তখন তাদেরকে বলা হয় লবিস্ট। লবিস্ট ভদ্র জাতির ভদ্র ভাষার ভদ্র শব্দ। বাঙালি হলে বলতো দালাল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মিডিয়া বিভ্রান্ত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়ার কারণে।

১৯৪৯ সালের নির্বাচনেও অনুরূপ বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিলো গ্যালপ পোল আর মিডিয়া। রুজভেল্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন ট্রুম্যান। রুজভেল্টের মৃত্যুর পর তিনি কয়দিন প্রেসিডেন্টগিরিও করেছিলেন। ১৯৪৯ সালের নির্বাচনে তিনি প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তখন মিডিয়ার পণ্ডিতেরা বলেছিলেন এবার ট্রুম্যান এন্টি এস্টাবলিস্টমেন্ট-এর তোড়ে পড়বেন।  একই দল ক্ষমতায় আসবে না। কিন্তু ডেমোক্র্যাট দলের ট্রুম্যানই নির্বাচিত হয়েছিলেন। ক্ষমতায় বসার পর পরই জাপানে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটান। তিনি অনেক কৃতিত্বের অধিকারীও ছিলেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্রেইন ট্রাস্ট ছিলেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী জেনারেল চার্চিল। তিনি কিন্তু যুদ্ধ শেষে অ্যান্টি ইনকামবেন্সির তোড়ে ১৯৪৫ সালে ব্রিটেনে যে নির্বাচন হয়েছিলো তাতে হেরে গিয়েছিলেন।

অর্থবিত্ত পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকলে বর্ণবাদী রূপটা সহজে প্রকাশিত হয় না। তখন বর্ণবাদী রূপটা ভণ্ডামি করে উদারতার ভান করে। অর্থবিত্তের টান পড়লে বর্ণবাদ আপন চেহারায় উদ্ভাসিত হয়। আমেরিকার এখন ফতুর অবস্থা। তার টানাটানির সংসারে আর কাউকেও অ্যাকোমোডেট করা সম্ভব হচ্ছে না। সুতরাং ট্রাম্প যখন বললেন, মেক্সিকোর কোনও মানুষকে প্রবেশ করতে দেবেন না- প্রয়োজনে দেয়াল তুলবেন, লেটিনোদের কোনও জায়গা হবে না আমেরিকায়, হিস্পানিদেরও জায়গা হবে না। মুসলমানদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করবেন। তখন গ্রামের শ্বেতাঙ্গরা বুঝলো-  ট্রাম্পই তাদের আসল নেতা।

আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গ ৭৫% সুতরাং তারা একতাবদ্ধ হলে তাদের সঙ্গে পারে কে? হিলারি তালিয়া বাজালেন ঘুরে ঘুরে কিন্তু কোনও সুস্পষ্ট এজেন্ডা দিতে ব্যর্থ হলেন। প্রাইমারিতে তার প্রতিদ্বন্দ্বি সেন্ডার্স-এর সঙ্গে যে লক্ষ লক্ষ যুবক জড়ো হয়েছিলো তাদেরকেও হিলারি ধরে রাখতে পারলেন না। তারা ভোট দিল না কাউকেই। সুতরাং হিলারির পরাজয় তো আনিবার্য ছিল।

সমজদারেরা তা আগেই, বুঝে ছিল। কিন্তু তার প্রাইমারিতে প্রতিদ্বন্দ্বি স্যান্ডার্স এর এজেন্ডা ছিল সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট। তিনি পুঁজিবাদ সংস্কারের কথা উচ্চারণ করেছিলেন অ্যান্টি এস্টাবলিস্টমেন্টের বক্তব্যও ছিলো তার। শ্রমিক শ্রেণি ও যুবসমাজ সেন্ডার্স-এর পেছনে সমবেতও হয়েছিলো। কিন্তু ডেমোক্র্যাট পার্টির এস্টাবলিসমেন্ট কলকাঠি ছিল হিলারির হাতে, তাই সেন্ডার্স পেরে উঠেননি। এখন অনেকে বলছেন সেন্ডার্সকে প্রার্থী করলে নাকি বিপর্যয় এড়ানো যেত।

এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলাদেশের বিএনপিও একটা প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে ছিল জাতীয় প্রেস ক্লাবের প্রাক্তন সভাপতি শওকত মাহামুদের নেতৃত্বে। আমেরিকায় যারা বিএনপির রাজনীতি পছন্দ করেন সে সব বাঙালিদের নিয়ে মিটিং মিছিল করছেন তারা। গত ২ নভেম্বর এই সংবাদ জামাত সমর্থক পত্রিকা ‘দৈনিক নয়াদিগন্ত’ প্রকাশ করেছে। নয়াদিগন্ত লিখেছে হিলারির নির্বাচনি প্রচারণায় সরব বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। শওকত মাহমুদ বিএনপির সহ-সভাপতি এবং বেগম খালেদা জিয়ার অন্যতম উপদেষ্টা। বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মাহিদুর রহমানও শওকত মাহামুদের সঙ্গে আমেরিকায় গিয়েছিলেন। তারা নিউইয়র্ক-এর জ্যাকসন হাইটসের একটি পার্টি হলে সমাবেশ করে বক্তৃতা দিয়েছেন।

শওকত মাহামুদ মার্কিন নির্বাচনে বাঙালি ভোটারদেরকে আহ্বান জানিয়েছিলেন হিলারিকে ভোট দেওয়ার জন্য। তিনি বলেছেন, হিলারি নাকি সভ্যতার পক্ষের প্রার্থী। তার মতে হিলারি প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগেই দুই দুই বার বাংলাদেশ সফর  করেছেন। তার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক গভীর। মাহিদুর রহমান বলেছেন ইমিগ্রেন্ট কমিউনিটিকে রক্ষা করতে হলে হিলারির প্রয়োজন।

জানি না বিএনপি পক্ষ থেকে বেগম জিয়া বা তারেক জিয়া কেন তাদেরকে ভিন্ন দেশের নির্বাচনি কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য পাঠালেন। আমেরিকা তো একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। অন্যদেশের রাজনৈতিক দলের নেতা গিয়ে এভাবে সেখানে নির্বাচনি প্রচারণায় যোগ দেয়া কাণ্ডজ্ঞানহীন ব্যাপার, অন্যায়, আইন বহির্ভূত কাজ। যদি তাদের অনুমোদন থাকে তাহলে বেগম জিয়া ও তারেক জিয়ার এটা ধৈয্যহীন কাণ্ড। রাজনীতিতে সবকিছুই আনসারটেন। তারা হিলারির বিজয়কে সম্ভবতো সারটেন বলে মনে করেছিলেন।

নিজের প্রভু নিজেকে হতে হয়। জনগণ সঙ্গে না থাকলে বিদেশের প্রভু কিছুই করতে পারে না। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পূর্বে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত দিল্লি পর্যন্ত গিয়েছিলেন। কী করতে পেরেছেন!

গত কয়দিন আগে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ওবামাকে মা তুলে গালি দিয়েছেন। ফিলিপাইন সফরের সময় লাল গালিচা সংবর্ধনা দেননি আবার বলেছেন তোমাদের সৈন্যের প্রয়োজন নেই, তোমরা ফিলিপাইন থেকে আমেরিকার সৈন্য ফেরিয়ে নাও।

আমেরিকার পড়ন্ত বেলা। বিশ্ব নেতৃত্বের পালাবদল হচ্ছে। ক্ষমতার জন্য এতো পাগল হলে চলে না। যাক, বেগম জিয়া, তারেক জিয়া আর শওকত মাহামুদকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়ে উর্দু-পার্সি কবি মির্জা গালিবের একটা কবিতা বলবো। সম্ভবত লাইনটি ছিল এমন ‘খোদা কা ঘর মে দের হ্যায় আন্ধেরা নেহি’। মানে খোদার ঘরে দেরি হতে পারে কিন্তু নিরাশ হওয়ার কিছু নেই।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
প্রীতি উরাংয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু: ‘অপরাধ আড়ালের চেষ্টা হচ্ছে’
প্রীতি উরাংয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু: ‘অপরাধ আড়ালের চেষ্টা হচ্ছে’
মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হলো সেনাসহ ২৮৫ বিজিপি সদস্যকে
মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হলো সেনাসহ ২৮৫ বিজিপি সদস্যকে
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে বাইডেনের সই
ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে বাইডেনের সই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ