X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

কেন এমন হলো?

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১৬ নভেম্বর ২০১৬, ১১:৫৭আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০১৬, ১২:০৫

একাত্তর টিভির পরিচালক (বার্তা) সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বিশ্বব্যাপী বড় বড় গণমাধ্যম পণ্ডিতরা বিস্মিত, হতবাক কিংবা কিছুটা ক্ষুব্ধও। কিন্তু বাস্তবতা হলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশ্বের মানুষ নতুন করে জানলো চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত গণমাধ্যমকে, বিশেষ করে মূলধারার গণমাধ্যমকে। আমেরিকার বড় বড় গণমাধ্যমতো বটেই, বিশ্বব্যাপী প্রায় সব গণমাধ্যম জিতিয়েই দিয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটনকে। কিন্তু সবাইকে হতবাক করে দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন জিতলেন অরাজনৈতিক ব্যক্তি ডোনাল্ড ট্রাম্প, শুরু থেকেই যাকে কোনও আমলে নিতে চায়নি মূল ধারার পত্রিকা ও টেলিভিশন।
তবে কি বড় বড় মিডিয়া হাউজ, যারা নিজেদের মুল ধারার গণমাধ্যম বলে দাবি করে, তারা মানুষকে বুঝতে পারেনি? নাকি আসলে তারা মানুষ থেকেই বিচ্ছিন্ন? নির্বাচনের আগে সব হিসেব আর জরিপে হিলালিকে জয়ী দেখানো গণমাধ্যমের এই হাল দেখে অনেকেই বলছেন, মানুষকে বুঝতে না পারলে কিসের তরে তাহলে সাংবাদিকতা?
অনেকেই বলছে আসলে সময় বদলেছে, প্রেক্ষাপট বদলেছে, কিন্তু মূল ধারার সাংবাদিকরা বদলাননি। তারা সেই আগের মতোই বার্তাকক্ষ কেন্দ্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিতে তাদের মতো করে দেখেন চারপাশকে। আর তাই তারা বুঝতে পারছেন না মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা আসলে হারিয়ে ফেলেছে গণমাধ্যম। আর এই নির্বাচনের মাধ্যমেই পৃথিবী দেখতে পেলো চতুর্থ স্তম্ভ এখন আর বাস্তবতা নয়, অনেকটাই নস্টালজিক।
এখন দেখা যাচ্ছে, নিউ মিডিয়া এবং ছোট ছোট গণমাধ্যমের অনেকগুলো ট্রাম্পই বিজয়ী হবে বলে জরিপের ফল প্রকাশ করেছিল। কিন্তু বড় গণমাধ্যমে চড়া গলার কাছে খুব জোর পায়নি ছিল এইসব কণ্ঠস্বর। তাই প্রশ্ন উঠছে, কেন তাহলে বড় বড় নির্বাচনি পণ্ডিত, বড় গণমাধ্যমের সব জরিপ এমন ব্যর্থ হলো? আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বলে যাদের পরিচিতি, তারা আসলে যতটা না সাংবাদিকতা করেছে তার চেয়ে বেশি করেছে হিলারির পক্ষে প্রচারণা। উপরে উপরে, ভাসা ভাসা রিপোর্ট আর মন্তব্য দিয়ে গেছে অবিরাম, সমাজের গভীরে প্রবেশ করতে পারেনি। ধরতেও পারেনি, সমাজের রন্ধ্রে, রন্ধ্রে দক্ষিণপন্থী ভাবধারা কতটা শক্ত অবস্থান নিয়েছে।  

আর প্রভাবিত হয়ে আমেরিকার বাইরে নানা দেশের গণমাধ্যমও হিলারির বিজয় নিশ্চিত করে দিয়েছিল। ব্যতিক্রম ছিল না বাংলাদেশের বড় বড় পত্রিকা আর টেলিভিশনও। ডানপন্থী দর্শনের এমন বাড় বাড়ন্তের খবরই রাখেনি মার্কিন, যেমনটা রাখিনা আমরাও। ২০১৩ সালের ৫ মে, হেফাজতে ইসলাম নামের এমন একটি ভূঁইফোড় সংগঠনের যাকে লাখে লাখে লোক ঢাকায় চলে আসবে, এমন তাণ্ডব ঘটাবে, এটা কি আমরা বুঝতে পেরেছিলাম? তাদের ১৩ দফা দাবি নিয়ে নানা ধরনের রিপোর্ট হয়েছে ঠিকই, কিন্তু গভীরে প্রবেশ করে জানতে পারেনি গণমাধ্যম তলে তলে কতটা বেড়েছে এরা। সাংগঠনিক দুর্বলতায় পুলিশি আভিযানে এরা ভেগেছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের মনে করিয়ে দিয়ে গেছে কতটা সমর্থন ভিত্তি এদের।    

মুল ধারার গণমাধ্যম এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস নিয়ে চলছে। সে না পারছে মানুষকে বুঝতে, না পারছে সাধারণ মানুষের ভাষায় কথা বলতে। এখনও সে যে ভাষা ব্যবহার করে, মানুষ, বিশেষ করে ডিজিটাল মানুষ, যে সেই ভাষা ছুড়ে ফেলে দিয়েছে, তা সে ঠাহরই করতে পারছে না। এই তথাকথিত গণমাধ্যম। 

বিতর্ক উঠেছে নির্বাচনি খবর প্রচারের ধরন নিয়ে। সংবাদের সঠিকতা, বস্তুনিষ্ঠতা আর ন্যায্যতার কথা ভুলে গিয়ে অনেক গণমাধ্যমই হিলারির প্রচার এমনভাবে করেছে যা ছিল পুরোপুরি পক্ষপাতদুষ্ট। বিতর্ক তাই একারণেও যে ‘ম্যাস মিডিয়া’ কি আসলেই ‘ক্লাস মিডিয়া’তে পরিণত হয়েছে? কারণ নিউজরুম বা বার্তা কক্ষ কেন্দ্রিক যে পরিবেশে কাজ করে সাংবাদিকরা, তাতে শুধু ওঠাবসা হয় সমাজের ধনিক শ্রেণি, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত আর বুদ্ধিজীবীদের সাথে যাদের সাথে মাটি আর মানুষের যোগাযোগ সেভাবে নেই। তাই গণমাধ্যম তাদের দৃষ্টিতেই দেখে পৃথিবীকে। কিন্তু পৃথিবীতে এখন আর সুশীলদের একচ্ছত্র আধিপত্য নেই। হাতে হাতে নিউজ ফিড তাকেও দিয়েছে এক অন্যরকম ক্ষমতায়ন, যেখানে তার কাছেও তথ্যের কোনও ঘাটতি নেই।

তবে সনাতনী পথে কোন তথ্য কিভাবে দেওয়া হবে তা নিয়ে গণমাধ্যম যখন গেটকিপার বা সম্পাদকীয় বিবেচনায় সময়ক্ষেপণ করছে, তখন তথ্য চলে গেছে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। তাই মূল ধারার গণমাধ্যমকে এখন বুঝতে হবে তার জন্য বসে নেই মানুষ। তাই তাকে ছুঁতে হলে নিজেকে সেই জায়গায় নিতে হবে। কিন্তু অবশ্যই শুদ্ধতার চর্চা বজায় রেখেই, যা তার অলংকার।

সামাজিক মাধ্যমের প্রতি দোষারোপ আসছে। বলা হচ্ছে নির্বাচনের সময় ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমে ভূয়া তথ্য ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে অনেক। একথা সত্য যে, সামাজিক মাধ্যমে অনেক দায়িত্বহীন তথ্য থাকে, ভূয়া তথ্য দিয়ে বড় অঘটন ঘটনো সম্ভব। কিন্তু দোষারোপ করে মূল ধারার গণমাধ্যম নিজেদের সমস্যাকে আড়াল করতে পারবে না।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়া নিয়ে গণভোটেও ব্রিটিশ গণমাধ্যম যেসব জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেছিল সেসবও ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। ভারতের নির্বাচনের আগেও প্রায় সব গণমাধ্যম নরেন্দ্র মোদির বিজয়ের কথা বলেছিল। কিন্তু এমন বিপুল বিজয় হবে তেমনটা তাদের জরিপে প্রকাশ পায়নি।

এসব ঘটনায় একটা কথাই এখন মানতে হয় সংবাদমাধ্যমর বিশ্বাসযোগ্যতা এখন প্রশ্নের মুখে। সাধারণভাবে সমাজে তার প্রভাব কমতির দিকে। তথ্যের জন্য এখন আর আমরাই মানুষের জন্য একমাত্র উৎস নই, হাতে হাতে তথ্যের ভাণ্ডার। আস্থা আর বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার এক নতুন লড়াইয়ে মূল ধারার গণমাধ্যম আর সাংবাদিকরা। সবাই গভীরে গিয়ে দেখুক কেন এমন হলো?  ফেরার পথটা আসলে কী?

লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ