X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রেমহীন বাঙালির জাতীয় জীবন!

মাসুদা ভাট্টি
১৯ নভেম্বর ২০১৬, ১১:৪৫আপডেট : ১৯ নভেম্বর ২০১৬, ১৩:২৮

মাসুদা ভাট্টি মাদার তেরেসার একটি উক্তি দিয়ে শুরু করি, তিনি বলেছেন, ‘আমাদের এই পৃথিবীতে এই মুহূর্তে ভালোবাসার অভাব ছাড়া আর কোনও অ-সুখ নেই।’ বাক্যটি ব্যক্তিগতভাবে আমাকে বেশ ভাবনায় ফেলে দিয়েছে। বেশ কিছুদিন যাবতই মনে হচ্ছিলো, এই যে বাংলাদেশে আমরা এতো বিশাল জনসংখ্যা নিয়ে সামনের দিকে এগুচ্ছি, আমরা অর্থনৈতিক সাফল্য লাভ করছি কিন্তু আমাদের মধ্যে সত্যিই ভালোবাসার প্রাচুর্য আছে তো? নাহলে এই যে চারদিকে ভয়ানক অস্থিরতা, খুনোখুনি, হানাহানি, রক্তপাত এর মূলে আসলে কী আছে? শান্তি ও সংঘাতের মূল কথা হলো, যুদ্ধের অনুপস্থিতি আসলে প্রকৃত শান্তি নয়, প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই যুদ্ধের প্রয়োজন। তাহলে কি বাঙালির জাতীয় জীবন এক নীরব যুদ্ধের ভেতর দিয়ে এগুচ্ছে? এর অন্তে রয়েছে অপার শান্তি? হয়তো আমার মতো অনেকেই এরকমটা ভেবে একটু হলেও শান্তি পেতে পারেন। কিন্তু ধরুন পশ্চিম বা তথাকথিত উন্নত বিশ্বের দিকে যদি তাকাই তাহলে কী দেখতে পাই? সেখানেও কি অপার শান্তি আছে? নাকি অপার শান্তি বলে কিছুই নেই?
ঠিক আছে, বিশ্বের কথা আপাতত তুলে রাখি, দেশের কথা বলি। শিশুকালের কথা বলি। যখন চারদিকে বিল আর বিশাল বিশাল পাথার সঙ্গে নিয়ে একটি গ্রাম দাঁড়িয়ে থাকতো। সেখানে সভ্যতা বলতে রেডিও, তাও মাত্র দুই বা তিনটি বাড়িতে। মঙ্গলবার নাটক হতো, সেই নাটক শুনতে অনেকেই জড়ো হতেন কিন্তু বেশিরভাগই রেডিও-নাটক বুঝতে পারেন না বলে শুনতে আসতেন না। তবে নাটক শুনতে আসার অন্য উদ্দেশ্যও ছিল, সঙ্গে এক কাপ চা ও মুঠ মুঠ গরম গরম মুড়িও বরাদ্দ ছিল। যাদের এই নাটকে পোষাতো না, তাদের জন্য শীতের রাতে রাতভর যাত্রা কিংবা কবিগান ছিল, তারা খুব সহজেই এসবে ঢুকে যেতে পারতেন। চাদর মুড়ি দিয়ে মাটিতে বিছানো ধানের নাড়ার ওপর একে অন্যের সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে কমলার বনবাস কিংবা মধুমালা-মদনকুমার দেখে এসে কয়েক সপ্তাহ ধরে সেগুলোর গান আর প্রেমের দৃশ্যাবলী/ডায়ালগ আউড়ে যাওয়াটাই বোধকরি ছিল জীবনের মোক্ষ। আর বর্ষাকালে চারদিকে যখন অথৈ পানি, গরুর ঘাস জোগানো ছাড়া আর কোনো কাজ-কর্ম নেই তখন হারিকেন জ্বালিয়ে কিস্তার আসর-এ বিজয়ীনি সোনাভান কিংবা কৃত্তিবাসী রামায়ণ শোনার চেয়ে আনন্দ আর কিছুতেই ছিল বলে মনে হয় না। এমনকি এই শীতের শুরুতে যখন ধান কাটার ধুম লেগেছে, সারা বছরের খাবারের ব্যবস্থা হবে কি হবে না সেই চিন্তা মাথায় নিয়ে কৃষক রাত পার করছে, যখন পাথার থেকে বর্ষার জল নেমে গিয়ে বুক চিতিয়ে থাকা মাটিতে মাতা-লাগানো খুঁদে খুঁদে ফুল গাছে মৌমাছি গুন গুন করতে করতে দিন শুরু করছে তখন মানুষের মনে প্রেম না জেগে উপায় থাকতো কি?
আজকে যখন সেই গ্রামে ফিরে যাই, তখন দেখি চারদিকে অসংখ্য রাস্তা হয়েছে, শহরকে ধরতে চাওয়ার প্রাণপণ প্রতিযোগিতা চলছে, তাই অপরিকল্পিত রাস্তা দিয়ে শহরকে নিকটে আনতে গিয়ে বর্ষার জল আর ঠিক আসছে না, তাই ফসল উৎপাদনেও পরিবর্তন এসেছে। যদিও আমি যে এলাকার কথা বলছি সেখানে এখনও পেঁয়াজ আর পাট ছাড়া আর কোনও ফসল তেমন হয় না। আগে সেখানে রবিশষ্য ছিল দৃষ্টিময়, এখন তা নেই, কেউ আর ছোলা বোনে না, মুশুরি বোনে না- অথচ পল্লী কবি জসিমউদ্দিন তার কবিতায় ছোলাপোড়া খাওয়ার যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা আর পাওয়ার সম্ভাবনা নেই কোনো কিশোরের ভাগ্যে। তার চেয়েও বড় কথা হলো, এখন মোবাইলে মোবাইলে ‘মাই নেম ইজ শীলা, শীলা কি জাওয়ানি’ বাজে, প্রেমের নাটক থেকে কারো চোখ ফেরানোর ফুরসৎ নেই, কাজকর্ম এমনিতেই কমে এসেছে কারণ এখন তো আর কেউ গরু দিয়ে হালচাষ করে না, জমি নিড়াতেও নাকি এখন স্বয়ংক্রিয় ‘লাইংল্যা’ ব্যাবহার হয় - তারপরও এই গ্রামটিতে নিত্য অশান্তি। একটি সর্ব-সাম্প্রতিক অশান্তির বিবরণ দিই।

গ্রামে একসময় রহমত আলী (কাল্পনিক নাম) ও তার তিন ভাই খুব ক্ষমতাবান ছিলেন, ছিলেন কারণ তারা উত্তরাধিকার সূত্রে জমি পেয়েছিলেন প্রায় পঞ্চাশ বিঘের মতো। তাছাড়াও কথিত আছে যে, তারা ওই এলাকায় হিন্দু উৎখাতে ভূমিকা রেখেছিলেন। রহমত আলীর বাবা করিম মাতুব্বর ৪৬-সালের এক গভীর রাতে সাঙ্গাপাঙ্গ নিয়ে এলাকার হিন্দু জমিদারের ঘরে ঢুকে তাকে সপরিবারে হত্যা করেছিল এবং বলাই বাহুল্য এসব জমি ওই জমিদারেরই। যাহোক, সে তো ইতিহাস। জমির মালিক হিসেবে রহমত আলী ও তার ভাইয়েরা এলাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য চালিয়েছে প্রায় দশকখানেক। কিন্তু এর মাঝে গ্রামের যুবকদের যারা মধ্যপ্রাচ্য কিংবা মালয়েশিয়া গিয়ে অর্থশালী হয়েছে তারা একের পর এক জমি কিনেছে, রহমত আলী ও তার ভায়েদের অবস্থা ক্রমশ পড়েছে, তাদের সবাই মিলে এখন প্রায় চল্লিশের ওপর সদস্য, হাড়ি আলাদা হয়েছে অনেক আগে, এখন ভায়ে-ভাস্তেতে মিল নেই। এই ভাস্তেদেরই কারো সঙ্গে মালয়েশিয়া ফেরত কারো লেগে থাকবে, ভরা হাটে রহমত আলীর এক বৃদ্ধ ভাইকে বেদম মার দিয়েছে এক নব্য অর্থশালী যুবক। গ্রামে এ নিয়ে তুমুল তাণ্ডব। কিন্তু রহমত আলীদের পক্ষে তেমন কেউ নেই, তাই গ্রামের দক্ষিণ পাড়ার মসজিদে পর্যন্ত রহমত আলীদের ঢোকা নিষিদ্ধ হয়েছে, মানে হুমকি দেওয়া হয়েছে যে, তারা কেউ মসজিদে এলে পিটিয়ে হাড্ডি গুড়ো করে দেওয়া হবে। সংক্ষেপে এই-ই হলো অশান্তির বিবরণ। এরকম আরও অশান্তির খবর দিতে পারি, বেশিরভাগই জমি নিয়ে, জায়গা নিয়ে, দখল নিয়ে, আধিপত্য প্রতিষ্ঠা নিয়ে -শেক্সপিয়র তার আমলে এরকমই দুই ক্ষমতাশালী পরিবারের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব নিয়ে লিখেছিলেন ‘রোমিও-জুলিয়েট’ কিন্তু তার ভেতরেও প্রেম ছিল, কী নিবিষ্ট প্রেম, আমার কথিত গ্রামে প্রেম নেই সেকথা বলছিনে, কিন্তু আমি কেবল অশান্তির ‘মাইক্রো’ দিকটি বলেছি, এর ‘ম্যাক্রো’ দিকও যে আছে, সেটাই আজকের লেখায় বলতে চাই এবং তা বলেই শেষ করবো।

গত ৭-৮ বছর ধরে আমি আমাদের জাতীয় জীবনকে গভীর ভাবে দেখার চেষ্টা করছি, এর আগে যেভাবে দেখেছি তাতে গভীরতা ছিল না তা নয়, কিন্তু এই সাত-আট বছরে আমার দেখার চোখ যে বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক ভাবে আবিষ্কার করেছে তাহলো, আমাদের জাতীয় জীবন আসলে ভয়ঙ্কর প্রেমহীন একটা অবস্থা পার করছে। আমাদের রাজনৈতিক জীবন যদি দেখি তাহলে দেখতে পাই দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল আসলে কেবল বিপরীতমুখী নয়, মৌলিকভাবেই তারা একে অপরের শত্রু। তারা দেশের স্বাধীনতা নিয়ে একমত নয়, দেশের ইতিহাস নিয়ে একমত নয়, জাতির পিতা নিয়ে একমত নয়, এমনকি একদল জাতীয় নেতাদের হত্যার মধ্য দিয়ে নিজেদের শক্তিশালী করেও শান্তি পায়নি, তারা এখনও সেই হন্তারকের ভূমিকায় আছে, তারা আরেকটি দলের নেতৃত্বকে হত্যার জন্য গ্রেনেড হামলা চালাতেও দ্বিধা করে না। একটু আগে গ্রামের অশান্তির যে টুকরো বর্ণনা দিয়েছি তাকেই যদি আমি জাতীয় জীবনে এনে ফেলি তাহলে দেখতে পাই যে, এখানেও ৭৫ সালের পর একটি রাজনৈতিক পক্ষ ভেবেছিল যে, আর নয়, ক্ষমতা বুঝি চিরস্থায়ী হয়ে গেলো, কিন্তু তাদের হাত থেকে ৮১ সালেই চলে গেলো আরেক স্বৈরাচারের হাতে, তারপর তার হাত থেকে ক্ষমতা ফেরাতে সেনা ছাউনির অপর রাজনৈতিক দলটি গণতন্ত্রের পোশাক পরলো ঠিকই কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাদের স্বৈরাচারী চরিত্রকে বদলালো না। এর সঙ্গে টেক্কা দিয়ে দেশের স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দলটি পুনরায় যখন ক্ষমতায় এলো তখন তারাও কট্টরপন্থী হলো, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে তাদেরকেও কৌশল বদলাতে হলো - সে কৌশলে ভুল আছে, বলাই বাহুল্য । ফলে আমরা জাতীয়ভাবে রাজনৈতিক দিক দিয়ে এক ভয়ঙ্কর সংঘাতের ভেতর দিয়ে হাঁটছি। আমাদের বিশ্লেষকগণ এই সংঘাতকে যখন বর্ণনা করেন তখন তারা ‘নিরপেক্ষ’ হতে গিয়ে ডাকাত ও ছিঁচকে চুরিকে একই মাপের অপরাধ বলে গণ্য করেন বটে! কিন্তু কথা সেটি নয়, এই রাজনৈতিক সংঘাত আমাদের সমাজ জীবনকেও গ্রাস করেছে চরম ভাবে। আর এর সঙ্গে যদি যোগ করি জায়গা-জমি দখল, ক্ষমতার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং ধর্মের অহংকে যোগ করি তাহলে জাতিগত ভাবে আমাদের সামনে আর কোনো আশার আলো তথা প্রেমের আলোকে আমি জ্বলতে দেখি না, আপনি দেখতে পান কি?

লেখাটি বড় হয়ে যাচ্ছে। যা বলতে চেয়েছিলাম তা স্পষ্ট করে বলা হলো না হয়তো, যদি সম্পাদক মহাশয় রাজি থাকেন এ বিষয়ে আরও একটি লেখা লেখার ইচ্ছে রইলো সামনে। কিন্তু আমাদের জাতীয় জীবনকে বোঝার জন্য আমাদের ব্যাক্তি জীবনকে বোঝার প্রয়োজন সবার আগে, কারণ ব্যাক্তিই প্রথমে পরিবার ও পরে সমাজ পার হয়ে রাষ্ট্রীয় জীবন গঠনে ভূমিকা পালন করেন। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, যেখানে প্রেম বা ভালোবাসা, সেখানেই জীবন, আমার প্রশ্ন হলো, আমাদের জাতীয় জীবন কি আসলে প্রেমহীন হয়ে পড়েছে? আর তাই আমাদের কোনো সুষ্ঠু, শান্তিময় জীবন অবশিষ্ট নেই আর? আসুন, একটু ভাবি প্রশ্নটা নিয়ে, সময় হলে উত্তরটাও জানতে চাইবো আপনার কাছেই, তারপর একদিন আপনাদের উত্তর নিয়েই আবার লিখবো, এই প্রেমহীন জাতীয় জীবন নিয়ে। সবাইকে ভালোবাসা।

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইতিহাস বিকৃত করে বিএনপি সফল হয়নি, এখন আবোল-তাবোল বলছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ইতিহাস বিকৃত করে বিএনপি সফল হয়নি, এখন আবোল-তাবোল বলছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
শাহীনকে সরিয়ে বাবরকে নেতৃত্বে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে পিসিবি!
শাহীনকে সরিয়ে বাবরকে নেতৃত্বে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে পিসিবি!
মেঘলা আকাশ থেকে ঝরতে পারে বৃষ্টি, বাড়বে গরম
মেঘলা আকাশ থেকে ঝরতে পারে বৃষ্টি, বাড়বে গরম
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ