X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

আমাদের সন্তানরা কি আদৌ দুধেভাতে আছে?

চিররঞ্জন সরকার
২০ নভেম্বর ২০১৬, ১২:১৩আপডেট : ২০ নভেম্বর ২০১৬, ১২:২৬

চিররঞ্জন সরকার একটা খুব বড় ঘটনা, বা অনেকগুলো ছোটো-ছোটো বিচ্ছিন্ন অথচ আদতে পরস্পর-সম্পর্কিত ঘটনার একটা পরম্পরা যখন অনেকটা সময় জুড়ে আমাদের চারপাশে ঘটে যেতে থাকে, তখন অনেক সময়ই, সেই ঘটনা বা ঘটনাক্রমের সত্যিকারের প্রভাব আমাদের নজর এড়িয়ে যায়। ঘটনাপ্রবাহের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকার ফলেই হোক, কিংবা একই ধরনের ঘটনা ক্রমাগত দেখতে থাকার কারণেই, তার প্রতি এক ধরনের অভ্যস্ততা তৈরি হয়ে যায়। ফলে, প্রতিক্রিয়ার ধার কমে আসতে থাকে। কিন্তু তারপরও কিছু কিছু ঘটনা আমাদের নাড়া দেয়। আমাদের আলোড়িত করে।
ঠিক যেমন ভিয়েতনাম যুদ্ধের পুরো কাহিনিটি ধরা থাকে নাপাম বোমায় বিধ্বস্ত রাস্তা দিয়ে নয় বছরের কিশোরী কিম ফুক-এর বিহ্বল ছুটে আসার ছবিতে; সিরিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপট লিপিবদ্ধ থাকে তুরস্কের সাগরবেলায় বালিতে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা আয়লান কুরদির তিন বছরের ছোট্ট শরীরে, কিংবা আলেপ্পোয় বোমাবর্ষণের পর ধুলো আর রক্তে মাখামাখি পাঁচ বছরের ওমরান দাখনিশের চোখেমুখে লেপটে থাকা আতঙ্কের মধ্যে। যদি এই তিনটি ছবিকে পাশাপাশি রাখা যায়, অনায়াসে তা হয়ে উঠতে পারে গত অর্ধশতাব্দী জুড়ে সারা পৃথিবীতে নিরপরাধ শিশুদের যে ভাবে বার বার শিকার হতে হয়েছে হিংসা ও সন্ত্রাসের, তার এক মর্মস্পর্শী কোলাজ।
এই তিনটি ছবির কথা একটানে মনে পড়ে গেল সম্প্রতি ‘ইউনিসেফ’ প্রকাশিত ‘আপরুটেড: দ্য গ্রোয়িং ক্রাইসিস ফর রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেন্ট চিলড্রেন’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি পড়ে। বিশ্বজোড়া হিংসা-বিদ্বেষ, সন্ত্রাস ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে যে বিশাল সংখ্যক শিশুর গায়ে ‘রিফিউজি ’ বা ‘ছিন্নমূল’ তকমা সেঁটে দেওয়া হয়েছে, তারই বিশদ অঞ্চলভিত্তিক খতিয়ান এই প্রতিবেদন। এই প্রতিবেদনের পাতা উলটোতেই আরও অনেক কিম ফুক, আয়লান কুরদি, ওমরান দাখনিশদের সঙ্গে পরিচয় হয়। চোখের সামনে এসে দাঁড়ায় ‘ছিন্নমূল’ শব্দটি-নিজস্ব শিকড় ছিঁড়ে নামহীন, ঠিকানাহীন ছড়িয়ে পড়া সেইসব শৈশবের কাহিনিই যেন বা সারি দিয়ে দাঁড়াতে শুরু করে।
বিশ্বজুড়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত শৈশবের কোন বাস্তবতাকে তুলে ধরছে ইউনিসেফ-এর এই প্রতিবেদন? তথ্য বলছে, সারা পৃথিবী জুড়ে এ পর্যন্ত ছিন্নমূল শিশুর সংখ্যা পাঁচ কোটির কাছাকাছি। এই গৃহহীন শৈশবের অধিকাংশই সরাসরি দাঙ্গা, সন্ত্রাস, হিংসা, গৃহযুদ্ধ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার। এর বাইরেও রয়েছে আরও প্রায় দু’কোটি শিশু, যারা স্রেফ একটু সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার জন্য ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। এ -পর্যন্ত পড়েই ধাক্কা খেতে হয়। মনে পড়ে যে, ১৯৮৯ -এ জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে খুব স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, নিজের ঘরই শিশুদের সবচেয়ে বড় আশ্রয় এবং তারা সবচেয়ে বেশি সুরক্ষিত কেবল তাদের বাবা-মায়েদের কাছেই। অথচ এখনও, তার পর প্রায় তিন দশক পেরোতে চললেও, সে অঙ্গীকার রক্ষার ধারেকাছেও যে পৌঁছনো যায়নি, তার একেবারে টাটকা উদাহরণ তুরস্কের সাগরবেলায় শান্ত ঘুমিয়ে থাকা আয়লান কুরদির দেখতে-না-পাওয়া মুখ। সে ধাক্কা সামলে এগোতে গিয়ে প্রতি পদক্ষেপে আরও অসংখ্য আয়লান কুরদির সঙ্গে পরিচয়। পরিসংখ্যান বলছে, সারা বিশ্বে মোট যত মানুষকে যুদ্ধ, হিংসা ও সন্ত্রাসের কারণে উদ্বাস্তু হতে হয়েছে, তার অর্ধেকই শিশু। এবং যুদ্ধের কারণে নিজের মাটি থেকে উৎখাত হয়ে ভিনদেশে (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শরণার্থীশিবিরে ) আশ্রয় নিতে বাধ্য হওয়া মানুষদের মধ্যেও শিশুদের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে ক্রমবর্ধমান। এদের একটা বড়ো অংশই (বিশ্বজুড়ে উদ্বাস্তু শিশুদের মোট সংখ্যার প্রায় ৪৫%) মধ্যপ্রাচ্যে-সিরিয়া, তুরস্ক, ইরাক, লেবানন, ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, ইউক্রেন ও আফগানিস্তানের হিংসাদীর্ণ এলাকায়। সংখ্যার হিসেবে, প্রায় দু’কোটি ৮০ লক্ষ। এর মধ্যে এক কোটির কাছাকাছি শিশু ঘর হারিয়ে দিন কাটাচ্ছে নিজের দেশেই, আর বাকিরা ছড়িয়ে পড়েছে অন্যত্র। একেবারে সাম্প্রতিক তথ্য উদ্ধার করে ইউনিসেফ দেখিয়েছে, কেবল গত এক বছরেই এক লক্ষ পরিবার-হারানো শিশু আশ্রয় নিয়েছে ৭৮টি দেশে। এবং ২০১৫'র এই পরিসংখ্যান ২০১৪-র তুলনায় বেড়েছে তিন গুণ। ‘আপরুটেড’-এর তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক অতীতে এই বিপুল সংখ্যক শিশু-শরণার্থীদের অধিকাংশই আশ্রয় নিয়েছে মূলত সিরিয়া ও লেবাননে।

শিশুদের ক্ষেত্রে বিষয়টি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। কেননা, যে কোনও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয় তাদেরই-একেবারে শৈশবাবস্থায় যে প্রাথমিক স্বাস্থ্য-চিকিৎসা পরিষেবা এবং শিক্ষার সুযোগ তাদের জন্য অত্যাবশ্যক, সেখানে মস্ত বড়ো ফাঁক রয়ে যায়।
ঠিক এই প্রসঙ্গটিতে এসে ঘরের দিকে চোখ ফেরানোও সমান প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। এ-কথা ঠিক, সাম্প্রতিক অতীতে তেমন কোনও দীর্ঘমেয়াদি হিংসা বা গৃহযুদ্ধের মুখে পড়তে হয়নি আমাদের দেশকে। ফলে সিরিয়া বা লেবাননের শরণার্থী -শিবিরগুলোতে শৈশবের যে তুমুল অপচয়, তার তেমন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও আমাদের হয়তো বা নেই। কিন্তু তারপরও আমাদের দেশের অনেক শিশুই স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও ভোগ করতে পারে না।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জের সাঁওতালপল্লীর শিশুরা প্রায় দশদিন ধরে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছে। খাবার জুটছে না। তারা স্কুলেও যেতে পারছে না। একই রকম অবস্থা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের সংখ্যালংঘু পরিবারের শিশুদেরও। চরম নিরাপত্তাহীনতা ও আতংকে তাদের দিন কাটছে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেকে দূরে রয়েছে প্রায় তিনসপ্তাহ ধরে। এসব স্থানে কোনও ‘যুদ্ধ’ নেই। তবু শিশুরা ভুক্তভোগী। ইউনিসেফের প্রতিবেদনে এই শিশুরা স্থান পায়নি। কিন্তু দুর্দশার অভিজ্ঞতায় লেবানন কিংবা সিরিয়ার শিশুদের সঙ্গে এই শিশুদের খুব একটা পার্থক্য আছে কী?

বাংলাদেশে শুধু সংখ্যালঘু পরিবারের শিশুরাই নয়, আরও অনেক শিশুই আছে যারা বেঁচে থাকার ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। দেশে প্রায় ৮০ লাখ পথশিশু সুবিধাবঞ্চিত হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জীবনযাপন করছে। এদের মধ্যে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে ১০ লাখেরও বেশি। বিবিএস এর তথ্য বলছে, শিশুরা বড়দের মতো কাজ করে ৮৫ শতাংশ, স্কুলে যায় না ২৪ লাখ শিশু, মজুরি পায় না ১৬ লাখ শিশু, পরিবারকে সহায়তা দিতে কাজ করে ৩০ শতাংশ শিশু, কৃষি ও কল কারখানায় কাজ করে ৬৫ শতাংশ শিশু।

শিশুরা ব্যাপক হারে নির্যাতন ও সহিংসতারও শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে ৩২৫টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে; যার মধ্যে দলগত ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৮, যার ৩১ জন প্রতিবন্ধী, ৫ জন গৃহকর্মী। এর মধ্যে ১৫ শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। আর এ সময় ধর্ষণের চেষ্টা করা হয় ৫৪ শিশুকে। হিসেব বলছে, প্রতি মাসে গড়ে ৩৫ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষিতদের অধিকাংশের বয়স ৫ থেকে ১২ বছরের মধ্যে।

আমাদের দেশে স্রেফ দু’মুঠো খাবারের জন্য এখনও বিপুল সংখ্যক শিশু দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে। আর মেয়েশিশুদের দুর্দশা তো আরও কয়েকগুণ বেশি। যৌন হয়রানি ও নির্যাতন ছাড়াও নানা কৌশলে ১২-১৪ বছর বয়সী কিশোরী মেয়েদের চাকরির লোভ দেখিয়ে পাচার করে দেওয়া হচ্ছে ভারতসহ মধ্যপ্রচ্যের নানা দেশে। দু’-তিন দফা হাতবদলের পর অনেক ক্ষেত্রেই তাদের স্থায়ী ঠিকানা হচ্ছে কোনও পতিতাপল্লীতে।

নদীভাঙ্গনের শিকার ও চরাঞ্চলের দরিদ্র পরিবারের কিংবা বিভিন্ন জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু পরিবারের শিশুরা কিভাবে বেঁচে আছে, তাদের খাদ্য-পুষ্টি-শিক্ষা-চিকিৎসা কিভাবে হচ্ছে, সে খবর আমরা রাখি না। সরকারের তরফেও তার কোনও সুনির্দিষ্ট নথিভুক্তিকরণ ঘটেনি।

যদিও আমাদের সরকার শিশুদের নিয়ে অনেক ইতিবাচক প্রকল্প রচনা করেছেন। কিন্তু বিরুদ্ধ প্রাকৃতিক পরিবেশ বা দীর্ঘমেয়াদি দারিদ্র্য অথবা দমন-পীড়ন-নির্যাতনের ঘটনা কী ভাবে বিভিন্ন স্তরে শিশুদের জীবনকে প্রভাবিত করে, কী ভাবে তাদের সরিয়ে রাখে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সুরক্ষার নিরাপত্তাবলয় থেকে, তা নিয়ে সর্বাঙ্গীণ কোনও তথ্যভিত্তি এখনও গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। পোশাকি ইংরেজিতে যাকে বলা যায় ‘ভালনারেবিলিটি ম্যাপিং’-প্রতিকূল পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশুদের জন্য তেমন কোনও সামগ্রিক সমীক্ষা বা গবেষণাও, অন্তত সরকারি তরফে, হয়নি।
প্রায় তিন শ বছর আগে ‘অন্নদামঙ্গল কাব্যে’ কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর লিখেছিলেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে।’ বাঙালি অভিভাবকের চিরন্তন আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি যেন এই বাক্যটি। যদিও ‘গোয়াল ভরা গরু ও গোলা ভরা ধান’-এর দেশে এটা খুবই সামান্য চাওয়া। বলা যায় ন্যূনতম চাওয়া। কিন্তু দুধভাত তো দূরের কথা, আমাদের শিশুরা আদৌ বেঁচে থাকার ন্যূনতম সুবিধেটুকু পাচ্ছে কি? তার ব্যবস্থা কবে হবে? কে করবে?

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সিলেটে আবারও শুরু হচ্ছে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম
সিলেটে আবারও শুরু হচ্ছে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম
ভ্রমণ শেষে ভারত থেকে তিন দিনে ফিরলেন ১৫ হাজার পর্যটক
ভ্রমণ শেষে ভারত থেকে তিন দিনে ফিরলেন ১৫ হাজার পর্যটক
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
মার্কেসের 'আনটিল আগস্ট'
মার্কেসের 'আনটিল আগস্ট'
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ