X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভাবনা কাহারে বলে...

শুভ কিবরিয়া
২২ নভেম্বর ২০১৬, ১২:৫০আপডেট : ২২ নভেম্বর ২০১৬, ১২:৫২

শুভ কিবরিয়া কদিন ধরে ভালো কোনও সংবাদ পাচ্ছি না । না রাষ্ট্রের না ব্যক্তির, না সামাজের। আমেরিকার নির্বাচনের পর মনে হলো ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়তো থিতু হবেন। ভাববেন যা বলেছেন নির্বাচনের আগে তা করলে ভালো দেখাবে না। আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে হলে ভালো নীতি দিয়েই এগুতে হবে। উগ্র জাতীয়তাবাদ কখনোই ভালো কিছু তৈরি করেনি। তা সে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি যাই হোক না কেন? গায়ের চামড়ার রং বা ধর্মের রং দেখে যে জাতীয়তাবাদ গজায়, আখেরে তাকে হিংসার আগুনে পুড়েই মরতে হয়। কেননা অন্যকে হিংসা করে, ঘৃণা করে কিংবা অগ্রাহ্য করে মহান কিছু তৈরি হয় না। আমেরিকার সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সহযোগি হিসাবে এখন পর্যন্ত যাদের খুঁজে পেয়েছেন তারা সবাই হিংসাশ্রয়ী ভিত্তির ওপরে কাজ করা মানুষ। সেই কারণেই এখন শুনছি আমেরিকায় অভিবাসী মুসলমানদের আলাদা ডাটাবেজ তৈরি হবে। মনে হচ্ছে ট্রাম্প মহাশয় গাটা পৃথিবীকে নানান বিপদের মুখেই হয়তো ফেলবেন তার বিভাজিত নীতি-নির্দেশনা দিয়ে। আমেরিকায় যে সব বাংলাদেশি আছেন যারা ধর্মে বা নামে মুসলমান তাদের অনেককেই পড়তে হবে নানা বিড়ম্বনায়।
দুই.
আমরা যখন ট্রাম্প জ্বরে কাঁপছি তখন আবার আমাদের প্রতিবেশি মিয়ানমার তার হিংসাশ্রয়ী নীতি নিয়ে হামলে পড়ছে রোহিঙ্গাদের ওপর। রোহিঙ্গারা ধর্মে মুসলমান। জাতিগত অবস্থানে তারা সেখানে সংখ্যালঘু। তারা নিপীড়িত। তার একঅর্থে রাষ্ট্রহীন নাগরিক। মিয়ানমার তাদের সে দেশের নাগরিক হিসাবে মনে করে না। তারা তাদেরকে সেখান থেকে উচ্ছেদ করতে চায়। সামরিক জান্তার মিয়ানমারের ওপর আমাদের ভরসা নেই। আমরা আশা করেছিলাম মিয়ানমারের আপসহীন নেত্রী, যিনি নিজে সারা জীবন নির্যাতিত মানুষের পক্ষে লড়েছিলেন তার সময়টা কিছুটা ভিন্ন হবে। মিয়ানমারে এখন এক ট্রানজিশন কাল চলছে। সামরিক জান্তার শাসনকাল হাটি হাটি পা করে গণতন্ত্রের দিকে যাত্রা শুরু করেছে কেবল। অং সান সূচি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মানুষ। অং সান সূচি ধর্মে বৌদ্ধ। আশা ছিল শান্তিবাদী বৌদ্ধ আর নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী অং সান খুন-হত্যা কিংবা নিদেন পক্ষে গণহত্যার বিপক্ষে দাঁড়াবেন। কিন্তু আমরা দেখলাম অন্য চিত্র। অং সান সূচি মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দ্বারা চালিত গণহত্যার পক্ষেই রয়েছেন। তার পশ্চিমা শিক্ষিত মনে মানবাধিকারের প্রশ্ন জাগেনি। তার মনে গৌতম বুদ্ধের অহিংসা আর শান্তির বাণী সাড়া ফেলেনি। তিনি উগ্র ধর্মাশ্রয়ী বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের পক্ষেই দাঁড়িয়েছেন। তার কাছেও রোহিঙ্গারা মানুষ নন!
সে কারণেই মনটা খারাপ। ছাত্রজীবনে অং সান সূচির ‘ভয় হতে অভয়’ নামের বক্তৃতার অনুবাদের বই পড়ে কী আলোড়িতই না হয়েছিলাম। সেই বইয়ের অং সান সূচি আর আজকের সূচির তফাৎ কত!

তিন.

মিয়ানমারে নারী ধর্ষণ হচ্ছে। নারী শিশুদের পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। প্রাণভয়ে ভীত শিশু নারীরা বাংলাদেশ- মিয়ানমার জলসীমায় তাড়া খেয়ে অকূল পাথারে পড়েছে। তাদের ভাগ্যে কী ঘটছে আমরা জানি না। আমাদের মানবতাবাদী হৃদয়ও নানা প্রশ্নে বিভাজিত হয়ে পড়ছে। ট্রাম্পের বিভাজিত নীতি আমাদের যাদের উদ্বেগাকূল করে, মধ্যপ্রাচ্যের শরণার্থী শিশু আয়লানের মৃতদেহের ছবি যাদের বিপন্ন করে সেই আমরাই বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের প্রবেশের প্রশ্নেও কঠোর জাতিয়তাবাদী হয়ে উঠছি। অন্যপ্রশ্নে আমাদের মানবতাবাদী মন নরম হলেও রোহিঙ্গা প্রশ্নে আমাদের অনেকের হৃদয় কঠিন কঠিন সব যুক্তি তুলে ধরছে। এসব আন্তর্জাতিক ভাবনার মধ্যেই চারপাশে চেনা আপনজনদের বেশ কটি পারিবারিক সদস্যের মৃত্যুর খবর জানলাম। যারা মারা গেছেন তারা সবাই অকালপ্রয়াত। স্বাভাবিক হিসাবে এদের কারও মৃত্যুর বয়স হয়নি। এরা খুব আচানক রোগে অথবা সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েই মারা গেছেন। তাদের প্রতিটি পরিবারের বিপন্নতা আমাকেও ছুয়েছে। যে জীবনের জন্য এতো হুড়োহুড়ি এতো কাড়াকাড়ি তা যে কত ক্ষণস্থায়ী তা মাঝে মাঝে এসব মৃত্যু নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেয়। এসব শোকজ্বালাও ক্ষণস্থায়ী বলে আমরা বেঁচে যাই। আবার স্বাভাবিক জীবনে প্রবেশ করি।

চার.

এই জীবন মৃত্যুর অভিজ্ঞতা নিয়ে মহাবীর আলেকজান্ডারের নানারকম কৌতুহল ছিল। তিনি নিজে স্বল্পায়ু জীবন পেয়েছিলেন। বিশ্বজয়ের তাগিদে আলেকজান্ডার ভারতবর্ষের কাছাকাছি এসেছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে। নদীপথে ভ্রমণ করতে করতে আলেকজান্ডার দশজন ভারতীয় দার্শনিককে বন্দী করেন। অভিযোগ ছিল, এরা আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন। আলেকজান্ডার তাদের বিচারের জন্য নতুন কায়দা আঁটলেন। বললেন, দার্শনিকদের তিনি কিছু প্রশ্ন করবেন। উত্তর সন্তোষজনক না হলে এদের হত্যা করা হবে। এদের মধ্যে যিনি বড় ছিলেন তাকে আলেকজান্ডার বিচারক নিযুক্ত করলেন। এরপর প্রশ্ন শুরু হলো। এদের একজনকে তিনি প্রশ্ন করলেন-

প্রশ্ন : জীবন না মৃত্যু- কে শক্তিশালী?

উত্তর : জীবন মৃত্যুর চাইতেও শক্তিশালী, কেননা জীবন অনেক দুঃখ সহ্য করে।

চার.

শুরু করেছিলাম উগ্র জাতীয়তাবাদের কাহিনি দিয়ে। এই অভিজ্ঞতা শুধু আজকের সময়ের নয় অতীতেও এরকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মানুষ গেছে। কিন্তু সকল রকম দুঃখের মধ্যেও মাথা তুলে দাঁড়ান অনেক বিবেকবান মানুষ। তারা নমস্য। এরকম এক মানুষের কথা বলেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার ‘বিপুলা পৃথিবী’ বইয়ে-

‘ভদ্রলোকের নাম আনোয়ার আবদেল-মালেক, জাতে মিশরীয়, তখন তার বয়স পঞ্চাশ হবে। মিশরের জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিশীল আন্দোলনে তাঁর বড় ভূমিকা ছিল। জামাল আবদেল নাসের যখন বামপন্থীদের দমন করতে শুরু করেন, তখন তিনি পালিয়ে চলে আসেন প্যারিসে। সেখানে সিএন আরএস নামে পরিচিত প্যারিসের একটি বড় প্রতিষ্ঠানে তিনি গবেষণা-অধ্যাপক। পরে আনোয়ারের প্যারিসের আর্টমেন্টে নাসেরের বাঁধানো ছবি দেখে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি না নাসেরের দ্বারা নির্যাতিত? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, আমার প্রতি তিনি অন্যায় করেছেন, কিন্তু মিশরের জন্য যা করেছেন, তার জন্যে তাঁর প্রতি সকল মিশরীয়ের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। (পৃষ্ঠা-৭৪, বিপুলা পৃথিবী)

পাঁচ.

এইসব ভাবনার মধ্যেই মনে হলো প্রতিটি সকাল আসে এক সূর্যসম্ভাবনা নিয়ে। প্রতিটি সকালেই মানুষের মনে আশা জাগে। সকল বিপত্তি সত্ত্বেও মানুষ ভেবে নেয় নতুন সকালে নতুন সূর্য উদিত হবে। সেই আলোয় কেটে যাবে ঘনায়মন অন্ধকার। ব্যক্তিমানুষ যেমন, রাষ্ট্রও তেমনি। তার সামনে সংকট যেমন চিরস্থায়ী নয়, তেমনি আশাও দূরহস্ত নয়। আশা ও সংকটের মধ্য দিয়েই রাষ্ট্র এগোয়। যদিও ব্যক্তি মানুষের মনোজগত যা চিন্তা করে, রাষ্ট্র চালকরা সেই চিন্তা দ্বারা তাড়িত হয়েই দেশ বা রাষ্ট্র চালান। ব্যক্তি মানুষের শুভ ইচ্ছা অনেক সময় অনেক সংকট উত্তরণের পথকে সহজ করে দেয়। যারা বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রার মহাসড়কে বিঘ্নহীন মনে করেন তারা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু যারা ভাবেন তাদের শাসনই চূড়ান্ত, তারা যা ভাবছেন সেটাই সঠিক তাহলে বোঝা যাবে তারা ক্ষমতারোগে ভুগছেন। তারা ক্ষমতা দিয়ে উন্নয়ন, শাসন এবং ভবিষ্যত দেখছেন। সেই দেখা যে সঠিক দেখা নয় সেটা অতীতে প্রমাণিত হয়েছে। হয়তো ভবিষ্যতেও প্রমাণিত হবে।

পুনশ্চ:

লেখাটা শেষ করি বঙ্গবন্ধুর একটা কাহিনি দিয়ে। এটিও লিখেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার ‘বিপুলা পৃথিবী’ বইয়ে-

১৯৭৪ সালের ৭ জুন বঙ্গবন্ধুর কাছে আমরা শিক্ষা কমিশনের চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করতে গেলাম। সভাকক্ষে এসে আসন গ্রহণ করে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, সভার পরে আমি যেন তার সঙ্গে দেখা করে যাই।... আমি যখন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, তখন সেখানে শিক্ষামন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন।...

...আমি সেই অবকাশে জানতে চাইলাম, তিনি কেমন আছেন। কিছুকাল আগে তিনি মস্কোতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার দেশে প্রত্যাবর্তনের পরে আমার সঙ্গে এই প্রথম দেখা। আমার প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বললেন, তিনি খুব ভালো নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে মস্কো থেকে চলে এলেন কেন? তিনি বললেন, ‘আমি এমন একজন প্রধানমন্ত্রী যাকে ভাইস চ্যান্সেলর ঘেরাও হলে তাকে উদ্ধার করতে যেতে হয়। মস্কোতে থাকতে খবর পেলাম, সূর্যসেন হলে সাতজন ছাত্র খুন হয়েছে। তখন চিকিৎসা অসম্পূর্ণ রেখে চলে এলাম।’ বললাম, ‘আপনি বিশ্রাম নিন না কেন? এখানে না পারেন, সপ্তাহান্তে ঢাকার বাইরে কোথাও চলে যান।’ তিনি বললেন, ‘দেশে কোথাও গিয়ে বিশ্রাম হবে না। যেখানে যাবো, সেখানেই লোকজন ভিড় করবে।’ বললাম, ‘লোকজনকে দেখা দেবেন না।’ এবার তার চোখে পানি এসে গেল। বললেন, ‘লোককে খেতে দিতে পারি না, পরতে দিতে পারি না, দেখাও যদি না দিতে পারি, তাহলে আমার আর থাকলো কী?’ আমি এবারে অপ্রস্তুত হলাম।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
ইউএনআরডব্লিউএ-তে ফের অর্থায়নের পরিকল্পনা জাপানের
ইউএনআরডব্লিউএ-তে ফের অর্থায়নের পরিকল্পনা জাপানের
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ