X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

অন্তঃসারশূন্য নয়, তবে দীর্ঘমেয়াদি

প্রভাষ আমিন
২৩ নভেম্বর ২০১৬, ১৫:৫৮আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০১৬, ১৬:০৪

প্রভাষ আমিন আগে বাংলাদেশে অর্থমন্ত্রীর বাজেট প্রস্তাবনা পেশের সঙ্গে সঙ্গে, কখনও কখনও বাজেট পেশ শেষ হওয়ার আগেই বিরোধী দল ব্যানার নিয়ে রাজপথে নেমে যেতো ‘গণবিরোধী বাজেট মানি না’ স্লোগান দিয়ে। অনেকদিন বাংলাদেশে রাজনীতি রাজপথ থেকে নির্বাসিত। তবুও ভালো মন্দ বিবেচনা না করেই, প্রতিপক্ষের কোনও প্রস্তাব নাকচ করার স্বভাব আমাদের মজ্জাগত। গত ১৮ নভেম্বর বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এক সংবাদ সম্মেলনে ‘নির্বাচন কমিশন গঠন ও শক্তিশালীকরণ: বিএনপির প্রস্তাবাবলী’ পেশ করেন। তার প্রস্তাবনা পেশ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একে ‘অন্তঃসারশূন্য’ অভিহিত করে প্রত্যাখান করেন। বেগম খালেদা জিয়া অনেকগুলো উপদফাসহ ১৩ দফার প্রস্তাবনা দিয়েছেন। ১৪ পৃষ্ঠার সেই বিস্তারিত প্রস্তাবনার ভালো-মন্দদিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ রয়েছে। তবে পুরো প্রস্তাবনাটি ভালোভাবে অনুধাবন না করেই তাৎক্ষণিকভাবে একে অন্তঃসারশূন্য বলে প্রত্যাখ্যান করে ওবায়দুল কাদের আসলে তাদের রাজনীতির অন্তঃসারশূন্যতাকেই প্রকট করে তুললেন। ওবায়দুল কাদের ছাত্র জীবন থেকে রাজনীতির মাঠের কর্মী। নিজে পেশাদার সাংবাদিক ছিলেন। তার পড়াশোনার ব্যাপ্তিও ব্যাপক। নিজে লেখালেখিও করেন। তার মত একজন প্রাজ্ঞ নেতার কাছ থেকে, এমন ঢালাও প্রত্যাখ্যান অপ্রত্যাশিত। খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলন অনেকগুলো বেসরকারি টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করেছে। ওবায়দুল কাদের নিশ্চয়ই সেটা গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখেছেন। আমিও দেখেছি। কিন্তু নিছক টেলিভিশন দেখে বেগম জিয়ার প্রস্তাবনা তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যানযোগ্য মনে হয়নি।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকারি দল আগে থেকেই প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল। আমি তার অভিযোগ অবিশ্বাস করিনি। আমারও মনে হয়েছে, বেগম খালেদা জিয়া যত ভালো প্রস্তাবই পেশ করতেন, ওবায়দুল কাদের তা মুখস্ত প্রত্যাখ্যান করতেন।
এটা ঠিক, বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরে আসার আর কোনও সুযোগ নেই। সর্বোচ্চ আদালতে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও বিএনপিও এই বাস্তবতাটুকু মেনে নিয়েছে বলেই মনে হয়। কারণ খালেদা জিয়ার বিস্তারিত প্রস্তবনায় কোথাও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলা হয়নি। বরং উনি বলেছেন, যথাসময়ে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দেবেন। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা যেহেতু এখনও অমীমাংসিত, তাই একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন অপরিহার্য। আর নির্বাচনকালীন সরকার যাই হোক, সবসময় সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের বিকল্প নেই। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশনই আমাদের রাজনীতির বিদ্যমান সমস্যার অনেক জট খুলে দিতে পারে। যেহেতু আগামী ফেব্রুয়ারিতেই ফুরিয়ে যাচ্ছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ, তাই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আলোচনা শুরুর এখনই প্রকৃত সময়। সে হিসাবে খালেদা জিয়া সঠিক সময়েই তার প্রস্তাবনা উপস্থাপনা করেছেন। এখন সরকারি দলের উচিত, তার প্রস্তাবনা কতটুকু গ্রহণযোগ্য, কতটুকু নয়; তার জন্য আলোচনার দুয়ার খোলা রাখা।

বেগম জিয়ার প্রস্তাবের মূল চেতনা হলো, সকল দলের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ করা। আর এ বিষয়ে আলোচনার জন্য এখনই প্রকৃত সময়। তাই খালেদা জিয়া সঠিক সময়েই তার প্রস্তাবনাটি পেশ করেছেন। সকল দল বলতে খালেদা জিয়া তার প্রস্তাবনায় দুটি অপশন রেখেছেন- নিবন্ধিত সকল রাজনৈতিক দল এবং এখন পর্যন্ত সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল। দ্বিতীয় অপশনটি নিলে জামায়াত এবং ফ্রিডম পার্টিও তালিকায় চলে আসতে পারে। তাই দ্বিতীয় অপশনটি বাদ দিয়ে প্রথম অপশনটি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। আর সংখ্যাটা আরও ছোট হয়ে আসবে, দল না ধরে জোট ধরলে। তাই সংখ্যাটা যথাসম্ভব ছোট রেখে আলোচনা চালানো যেতে পারে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন নিয়োগের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির। তবে রাষ্ট্রপতি চাইলে রাজনৈতিক দল দলগুলোর সাথে আলোচনার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে পারেন। এ নজিরও আছে।

বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্তাবে কৌশলে তাদের জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতির মূলধারায় ফেরানোর চেষ্টা রয়েছে বলে সমালোচনা হয়েছে অনেক। সমালোচনা আছে, নির্বাচনের সময় সশস্ত্রবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেট ক্ষমা দেওয়া এবং আরপিও সংশোধন করে নির্বাচনকালীন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভূক্তির সুপারিশ করা হয়েছে। এমনিতে নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনী স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। এটুকুই ঠিক আছে। সশস্ত্রবাহিনীকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখা সবার জন্যই মঙ্গল।

তবে প্রস্তাব সম্পর্কে সবচেয়ে যৌক্তিক সমালোচনাটি করেছেন প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল হক। তিনি সেদিন সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিতক ছিলেন। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বলেছেন, ‘প্রস্তাবনা ভালো। তবে এটা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হলে ১০ বছর পর নির্বাচন হবে। আমার জীবদ্দশায় হবে না।’ যত বছরই লাগুক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করতে সময়োপযোগী সংস্কার চালিয়ে যেতে হবে। তবে বেগম জিয়া যেমন সর্বজন শ্রদ্ধেয়, দল নিরপেক্ষ, সৎ, দক্ষ ও যোগ্য লোক চেয়েছেন; তেমন লোক আমাদের সমাজে পাওয়া সত্যিই কঠিন। এই বেগম জিয়াই একসময় বলেছিলেন, পাগল আর শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নেই। তেমন নিরপেক্ষ লোকদের দিয়েই কি তিনি নির্বাচন কমিশন গঠন করতে চান?

বেগম জিয়ার প্রস্তাবনায় আছে ,‘নতুন কমিশন নিয়োগ দেওয়ার আগে রাষ্ট্রপতি সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি বাছাই কমিটি গঠন করবেন। দলগুলো বাছাই কমিটির কাছে নাম দেবে। যে নামগুলো সব দল থেকেই এসেছে, সেখান থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে দুজন ও প্রত্যেক নির্বাচন কমিশনারের বিপরীতে দুজনের নাম চূড়ান্ত করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে কমিটি। রাষ্ট্রপতি সেখান থেকে সিইসি ও ইসি নিয়োগ করবেন। যতক্ষণ পর্যন্ত দলগুলোর দেওয়া নামের প্রস্তাবে মিল না পাওয়া যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত বাছাই কমিটি দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাবে।’ খালেদা জিয়ার প্রস্তাব মানলে ১০ বছর নয়, এই আলোচনা চলবে কেয়ামত পর্যন্ত।

বেগম জিয়ার প্রস্তাব সব মানতেই হবে এমন কোনও কথা নেই। তবে যেটুকু মানার মতো সেটুকু মানলে জাত যাবে না। বিএনপি একটি প্রস্তাব দিয়েছে, আওয়ামী লীগ আরেকটা পাল্টা প্রস্তাব দিক। সংবিধান সামনে রেখে আলোচনা হোক। সবাই মিলে নির্বাচন কমিশনটা গঠন করে ফেলতে পারলে পরবর্তী নির্বাচনের অনেক গিট্টু এখনই খুলে যাবে। আমরা চাই আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক হোক। ১৫ ফেব্রুয়ারি বা ৫ জানুয়ারির মতো আর কোনও প্রহসন আমরা চাই না।

লেখক: অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
এখনই হচ্ছে না হকির শিরোপা নিষ্পত্তি, তাহলে কবে?
এখনই হচ্ছে না হকির শিরোপা নিষ্পত্তি, তাহলে কবে?
রবিবার গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়
রবিবার গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়
চুয়াডাঙ্গায় ৪২ পেরোলো তাপমাত্রা, জনজীবনে হাঁসফাঁস
চুয়াডাঙ্গায় ৪২ পেরোলো তাপমাত্রা, জনজীবনে হাঁসফাঁস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ