X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গাদের বেঁচে থাকার অধিকার আছে

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
২৪ নভেম্বর ২০১৬, ১৪:৪৯আপডেট : ০৭ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৭:১১

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী নাফ নদীর ওপাড়েই রাখাইন রাজ্য। এটা বাংলাদেশ সংলগ্ন মিয়ানমারের একটা প্রদেশ। পূর্বে ছিল আকিয়াব ডিভিশন। এখানে ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাস করে। তারা সবাই মুসলমান। রোহিঙ্গা জনসংখ্যা আরও ব্যাপক ছিল। নাফ নদীর পূর্ব তীর থেকে ইরাবতীর পশ্চিম তীর পর্যন্ত অত্র এলাকায় তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করতো। রাখাইনরাও এখানে বসবাস করে।
১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তির পর বরিশাল অঞ্চল থেকে ব্যাপক জেলে সম্প্রদায়, যারা ধর্ম বিশ্বাসে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিল, তারা দেশ ত্যাগ করে আকিয়াব বা রাখাইন অঞ্চলে চলে যায়। মূলতঃ তারাই আকিয়াব বা রাখাইন অঞ্চলের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে।
১৯৪৮ সাল থেকে রোহিঙ্গারা অত্যাচারের সম্মুখীন হতে থাকে। ধীরে ধীরে রোহিঙ্গারা আকিয়াব বা রাখাইন ত্যাগ করে চলে যেতে শুরু করে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, সৌদি আরব, বাংলাদেশে তারা চলে যায়। বাংলাদেশে নিবন্ধিত আর অনিবন্ধিত ১০ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। অধিকাংশ বাংলাদেশিদের সঙ্গে মিশে গেছে। এছাড়াও দেশত্যাগ করে নৌ-পথে চলে যাওয়ার সময় গত ৭০ বছরে কয়েক লাখ রোহিঙ্গার সলিল সমাধি হয়েছে।
বঙ্গোপসাগর আর মার্তাবান উপসাগরে কত রোহিঙ্গা যে ডুবে মরেছে, তার কোনও  হিসাব নিকাশ কেউ রাখেনি। মরে মরে এখনও রাখাইনে ১১ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। সম্ভবতো রাখাইন, ধর্মীয় সম্প্রদায় আর মিয়ানমারের সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, এবার আর কোনও রোহিঙ্গাকে তারা জীবিত রাখবে না।
রয়টার্স সংবাদ পরিবেশন করেছে, স্যাটেলাইট যে ছবি ধারণ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে যে, শত শত ঘরবাড়িতে মিয়ানমারের সৈন্যরা আগুন দিচ্ছে। নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে, আর আগুনে পুড়িয়ে রোহিঙ্গাদের হত্যা করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত নাকি প্রায় ১০০ জন রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে। রোহিঙ্গা তরুণীদের শ্লীলতাহানী করে নাকি হত্যা করা হচ্ছে। ছয় শ’ রোহিঙ্গাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ত্রিশ হাজার রোহিঙ্গা পাহাড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে। এলাকায় কারফিউ বলবত রয়েছে। এটা মিয়ানমারের সৈন্য বাহিনীর চিরুনী অভিযান।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সীমান্ত চকিতে ৯ জন পুলিশকে গুলি করে ঘুমন্ত অবস্থায় মেরে ফেলেছে। মিয়ানমারের সেনা বাহিনীর ধারণা, এ হত্যাকাণ্ড রোহিঙ্গাদেরই কাজ। মিয়ানমারের ১৩৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস। কেউই মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষকে মান্য করে চলে না।
যাক, এ কাজ যদি রোহিঙ্গারাও করে থাকে, তবে অপরাধী ধরার চেষ্টা করাইতো নিয়ম। নির্বিচারে কারফিউ দিয়েতো সাধারণ মানুষ হত্যার কোনও কানুন পৃথিবীতে কেউ কখনও দেখেনি।
১৯৯১ সালে রাখাইনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ৩২ হাজার এখনও পর্যন্ত  ক্যাম্পে আছে। অবশিষ্টরা কক্সবাজার আর বান্দরবন জেলায় বসতি গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশ ৫৬ হাজার বর্গমাইল আয়তনের দেশ, আর ১৬ কোটি মানুষ এখানে বসবাস করে। নিজের মানুষের জায়গা সংকুলান যেখানে হচ্ছে না, সেখানে মিয়ানমারের লাখ লাখ মানুষকে জায়গা দেওয়া তো বাংলাদেশের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
মিয়ানমার সরকার বলতে চায় যে- এরা বাঙালি। এরা কখনও বাঙালি নয়। মুঘলদের সমসাময়িককালে এখানে একটা ছোট রাজ্য ছিল। এরা হচ্ছে রোসাং রাজের প্রজা রোহিঙ্গা। রোসাং রাজ কখনও ব্রহ্মদেশের রাজার সঙ্গে সম্পৃক্ত রাজা নন। আকিয়াব অঞ্চলেই ছিল তার রাজত্ব। সেই দিক থেকে বিবেচনা করলে আকিয়াব অঞ্চল ব্রহ্মদেশেরই অংশ নয়। ১৯৩৬ সালে ব্রিটিশেরা শাসন কাজের সুবিধার জন্য বার্মাকে ভারত উপমহাদেশ থেকে পৃথক করে, ভিন্ন ভাইসরয়ের অধীনে ন্যস্ত করেছিল। তখন  ব্রিটিশরা  নাফ নদীকে সীমানা সাব্যস্ত করেছিল। রোহিঙ্গারা তখনও এ অন্তর্ভুক্তিকে মানেনি। তারা আকিয়াবের স্বতন্ত্র মর্যাদা দাবি করেছিল।

শক্তিশালী কোনও নেতৃত্ব ছিল না বলে তারা তাদের দাবি আদায় করতে পারেনি। দাবি আদায় করতে পারেনি বলে দাবি তামাদি হয়ে যায়নি। রোহিঙ্গারা রোসাং রাজার এলাকায় তাদের স্বতন্ত্র রাজ্যের সংগ্রাম বহুদিনব্যাপী চালিয়ে ছিল। এখনও অং সাং সুচি রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করলেই তার প্রতিবাদ করে। রোহিঙ্গা শব্দের মাঝে বহু পুরনো ইতিহাস রয়েছে, এ কথা সম্ভবতো অং সাং সুচি  অনুধাবন করতে পারেন।

গত ১৭ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা বিষয়টি অনির্ধারিত বিষয় হিসেবে উত্থাপন করেছে। শক্তিশালী সব সদস্য রাষ্ট্রগুলো অনতি বিলম্বে এই অনাচার বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা বাংলাদেশকে সীমান্ত খুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। অথচ, সীমান্ত খোলা বাংলাদেশের পক্ষে কখনও সম্ভব নয়। কারণ, ১৯৯১ সালে যে শরণার্থী এসেছিল, মিয়ানমার সরকার তাদের সম্পূর্ণ ফেরৎ নেওয়ার ব্যাপারে কখনও মনোযোগ দেয়নি।

পুনরায় লাখ লাখ শরণার্থীর বোঝা বাংলাদেশ নিতে পারে না। জাতিসংঘ অনাচার বন্ধের জন্য সোচ্চার হতে পারে। সীমান্ত খোলার প্রয়োজন হলে ভারত, চীন, থাইল্যান্ডের সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্ত রয়েছে। এবার সীমান্ত খোলার জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানানো উচিৎ।

রোহিঙ্গারা মুসলমান কিন্তু দুর্ভাগ্য যে ওআইসির একটি সদস্য রাষ্ট্রও এযাবৎ এ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি দেয়নি। অথচ ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়া, ব্রুনাই মিয়ানমারের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। সৌদি আরবের বাদশা দুই হারেমের খাদেম। আমরা এযাবৎ লক্ষ্য করেছি যে, মিয়ানমার কারও কথা শোনা প্রয়োজন মনে করে না। সুতরাং রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে ওআইসিকে উদ্যোগ নিতে হবে। ওআইসির প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রকে স্বতন্ত্রভাবেও মিয়ানমারকে এ সমস্যা সমাধানের জন্য জোর তাগিদ প্রদান করতে হবে। এ বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে উদ্যোগী হয়ে যোগাযোগ করুক, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ তা প্রত্যাশা করে।

এতদিন মিয়ানমারের সামরিক জান্তার শাসন ছিল। এ বছর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অং সাং সুচিই হচ্ছেন এ সরকারের মুখ্য ব্যক্তি। তিনি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের সুপারিশ প্রদানের জন্য আনান কমিশন গঠন করেছিলেন। সবাই আশাবাদী হয়েছিল যে, সমস্যা সমাধানে সুচি গঠনমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। সুতরাং একটা সমাধানের পথ হয়তো বের হবে। এ উদ্যোগকে আবার হতাশাগ্রস্ত হতে হলো।

আমি পূর্বেই বলেছি, মিয়ানমারের ১৩৫ নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে, তারা কেউই মিয়ানমারের সরকারকে মানে না। মিয়ানমারের প্রতিবেশী ভারতেও এমন পরিস্থিতি ছিল। ভারত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র  রাজ্য গঠন করে এ সমস্যার সমাধান বের করেছে। মিজোরাম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড এগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপজাতি নিয়ে গঠিত রাজ্য। মিয়ানমারকে এমন একটা কিছু চিন্তা করতে হবে। সাড়ে তিন লাখ সদস্যের সামরিক বাহিনী গঠন করে সমস্যার সমাধান হবে না। মনে রাখতে হবে সমস্যার সমাধান না করে সমস্যা অব্যাহত রাখলে দেশ পিছিয়ে যায়। সম্পদের প্রাচুর্য আছে মিয়ানমারের কিন্তু সে হিসাবে অগ্রগতি নেই।

 লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
লাগাতার তাপদাহে যশোরে জনজীবন দুর্ভোগে
লাগাতার তাপদাহে যশোরে জনজীবন দুর্ভোগে
জেলেনস্কিকে হত্যার পরিকল্পনায় জড়িত অভিযোগে পোলিশ নাগরিক গ্রেফতার
জেলেনস্কিকে হত্যার পরিকল্পনায় জড়িত অভিযোগে পোলিশ নাগরিক গ্রেফতার
বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিলেন মিয়ানমারের আরও ১৩ সীমান্তরক্ষী
বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিলেন মিয়ানমারের আরও ১৩ সীমান্তরক্ষী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ