X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

নারায়ণগঞ্জ বনাম জেলা পরিষদ

আমীন আল রশীদ
২৫ নভেম্বর ২০১৬, ১০:৫৮আপডেট : ২৫ নভেম্বর ২০১৬, ১১:০৩

আমীন আল রশীদ এক নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন নিয়ে গোটা দেশের রাজনীতিতে যতটা উত্তাপ—সারাদেশের জেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে তার সিকিভাগ উত্তেজনাও নেই। মানুষেরও কোনও আগ্রহ নেই এই নির্বাচন নিয়ে। কারণ সাধারণ মানুষ জানে না, স্থানীয় সরকারের এই প্রতিষ্ঠানে তাদের কী কাজ বা জেলা পরিষদের তরফেও নাগরিকদের কখনও এটা বলা হয় না যে, এখান থেকে তারা নাগরিকদের এই-এই সেবা দেয় বা দিতে পারে।
ফলে আগামী ২৮ ডিসেম্বর তিন পার্বত্য জেলা বাদে দেশের ৬১টি জেলায় যে জেলা পরিষদ নির্বাচন হবে, তা নিয়ে সাধারণ মানুষ তো বটেই, রাজনীতিকদের মধ্যেও তেমন আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। এর প্রথম কারণ, এই নির্বাচনে সাধারণ মানুষের ভোট দেওয়ার সুযোগ নেই। বরং ভোট দেবেন স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। এটা অনেকটা মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইলেকটোরাল কলেজের মতো। দ্বিতীয়ত, যারা এই নির্বাচনে অর্থাৎ চেয়ারম্যান বা সদস্য হওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বা করতে আগ্রহী—তাদের বাইরে অন্য রাজনীতিকরাও জেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে খুব একটা ভাবেন না। তারা বরং মনযোগ দিয়েছেন ওই নির্বাচনের ছয়দিন আগে হতে যাওয়া নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশেন নির্বাচনের দিকে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন কেবল ওই মহানগরীর মানুষের জন্য প্রযোজ্য হলেও সারা দেশের মানুষেরই আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ঢাকা সংলগ্ন এই জেলা শহর। এর কারণও স্পষ্ট। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে আলোচিত হত্যাকাণ্ড, আইনশৃঙ্খলা, একটি বিশেষ রাজনৈতিক পরিবারের প্রতাপ—সব মিলিয়ে নারায়ণগঞ্জ বরাবরই খবরের শিরোনাম। কিন্তু সেই তুলনায় জেলা পরিষদ কখনোই শিরোনাম হয় না।

পার্বত্য তিনটি জেলা বাদে বাকি ৬১ জেলা পরিষদে ২০১১ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রশাসক নিয়োগ করে সরকার। তখন স্থানীয় সরকার বিভাগসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরা বলেছিলেন, ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে জেলা পরিষদ গঠন করা হবে। কিন্তু গত পাঁচ বছরেও সেই ছয় মাস শেষ হয়নি। ক্ষমতাসীন বা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর তরফেও এই নির্বাচন নিয়ে কোনও জোর দাবি উত্থাপতি হয়নি। এমনকি সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা ঘোষণা করা হলেও বিএনপি পরিষ্কার বলে দিয়েছে যে, তারা জেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেবে না। তার মানে তারাও জানে, এই পরিষদের আসলে কোনও ক্ষমতা নেই। ওই অর্থে কোনও কাজও নেই।

জেলা পরিষদ আইনে এই প্রতিষ্ঠানের ৮০টি কাজের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যে ১২টি বাধ্যতামূলক এবং বাকিগুলো ঐচ্ছিক। ১২টি বাধ্যতামূলক কাজের মধ্য রয়েছে জেলার সব উন্নয়ন কার্যক্রম পর্যালোচনা; উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভার গৃহীত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা; সাধারণ পাঠাগারের ব্যবস্থা ও রক্ষণাবেক্ষণ; বৃক্ষরোপণ; জনসাধারণের জন্য উদ্যান, খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত স্থানের ব্যবস্থা ও রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি। আর ঐচ্ছিক কাজের মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজকল্যাণ, জনস্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক কল্যাণসহ নানাবিধ কর্মকাণ্ড। প্রশ্ন হলো, বর্তমানে প্রশাসকদের অধীনে পরিচালিত জেলা পরিষদ উপরোক্ত কাজের আদৌ কোনও বাস্তবায়ন করেছে কিনা?

জেলার সব উন্নয়ন কার্যক্রম পর্যালোচনা করার কথা জেলা পরিষদ আইনে বলা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। জেলার অবকাঠামো উন্নয়ন বিশেষ করে রাস্তা-সেতু-কালভার্ট ইত্যাদি বানানোর দায়িত্ব মূলত স্থানীয় সরকার এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের। স্থানীয় সরকারের বাইরেও বিভিন্ন ভবন নির্মাণ করে গণপূর্ত বিভাগ। তাদের অংশীদার হয়ে কাজ করে পৌরসভার মতো প্রতিষ্ঠান। সুতরাং এসব জায়গায় গিয়ে জেলা পরিষদ কখনও নাক গলিয়েছে বা নিজেদের মতামত দিয়েছে অথবা কোনও কাজের মান খারাপ বলে জেলা পরিষদ সেই কাজ পুনরায় করতে বাধ্য করেছে, এমন নজির সম্ভবত নেই।  

তাছাড়া আমাদের স্থানীয় সরকারকাঠামোয় পৌরসভা ছাড়া অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানই ওই অর্থে খুব শক্তিশালী নয়। যেমন উপজেলা পরিষদ। নামকাওয়াস্তে এখানে চেয়ারম্যান, ভাইস-চেয়ারম্যান থাকলেও তাদের যে আসলে কী কাজ, তা অনেক চেয়ার‌ম্যানও পরিষ্কার নন।

ইউনিয়ন পরিষদ দেশের সবচেয়ে বড় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান। তৃণমূলের মানুষের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের যে বাজেট তা একদিকে যেমন হাস্যকর; তেমনি এই স্বল্প বাজেটের মধ্যেও আছে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ।

এখন স্থানীয় সরকারের এসব প্রতিষ্ঠানেও দলীয়ভিত্তিতে নির্বাচন হওয়ায় আগে যেমন নির্দলীয় ভদ্রলোকেরা বা এলাকার গণ্যমান্য মুরুব্বি, সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোক বলে পরিচিত কিন্তু সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত নন, তাদের অনেকে ইউনিয়ন পরিষদের নেতৃত্বে যেতে পারতেন, এখন সেই সুযোগটিও তিরোহিত। কারণ দলীয়ভিত্তিতে ভোট হওয়ার ফলে এখন সেখানে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার জন্য যে লবি এবং পয়সার দরকার—যে পেশিশক্তির প্রয়োজন, তা ওই শিক্ষিত ভদ্রলোকদের থাকার কথা নয়। ফলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো এখন বস্তুত ক্ষমতাসীন দলেরই আরেকটি অংশ। ফলে সেখান থেকে সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রেও নাগরিকের রাজনৈতিক পরিচয় গুরুত্ব বহন করে। এমনকি বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি যেমন বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা কে পাবেন কে পাবেন না, তা নির্ধারিত হয় জনপ্রতিনিধির ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের ভিত্তিতে। কোথাও কোথাও মৃত মানুষের নামে টাকা তুলে খেয়ে ফেলার খবরও আমরা গণমাধ্যমের কল্যাণে জানতে পারি।

ফলে জেলা পরিষদ হোক কিংবা উপজেলা, পৌরসভা অথবা ইউনিয়ন পরিষদ—মানুষ আসলে তার প্রয়োজনীয় সেবাটুকু পাচ্ছে কি না, সেটিই মুখ্য। দলীয় ভিত্তিতে ভোট কিংবা নির্দলীয়—সেবা পওয়ার ক্ষেত্রে নাগরিকরা মানুষ বলে বিবেচিত হচ্ছেন না কি বিএনপি আওয়ামী লীগ—সেটি ‍গুরুত্বপূর্ণ। কে কাকে ভোট দিয়েছেন বা কার প্রতি কার অনুরাগ-বিরাগ-তার ওপর ভিত্তি করে সেবা দেওয়ার যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে, সেটি দূর করা না গেলে নির্ধারিত মেয়াদান্তে ভোট হবে, অবকাঠামোর কিছু উন্নয়ন হবে, কিছু লোকের পকেট ভারি হবে, কারো টিনের ঘর ছয় তলা দালানে রূপান্তরিত হবে, রিকসা ছেড়ে দামি গাড়িতে চড়বেন, দলীয় লোকদের পুনর্বাসন হবে ঠিকই—কিন্তু স্থানীয় সরকার কখনোই মানুষের বন্ধুতে পরিণত হবে না।

লেখক: যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
তিন মামলায় জামিন পেলেন মামুনুল হক 
তিন মামলায় জামিন পেলেন মামুনুল হক 
গাজায় ৫০টি লক্ষ্যবস্তুতে হামলার দাবি ইসরায়েলের
গাজায় ৫০টি লক্ষ্যবস্তুতে হামলার দাবি ইসরায়েলের
থাইল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রীকে লাল গালিচা সংবর্ধনা
থাইল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রীকে লাল গালিচা সংবর্ধনা
জেল থেকে বেরিয়ে ফের শিশু পর্নোগ্রাফি চক্রে জড়ান শিশুসাহিত্যিক টিপু!
জেল থেকে বেরিয়ে ফের শিশু পর্নোগ্রাফি চক্রে জড়ান শিশুসাহিত্যিক টিপু!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ