X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

নারীর ক্ষমতায়ন মানেই পুরুষরা দুর্বল নয়

সাদিয়া নাসরিন
২৫ নভেম্বর ২০১৬, ১১:১১আপডেট : ২৫ নভেম্বর ২০১৬, ১১:২২

সাদিয়া বিশ্বব্যাপী রাজনীতিকে ‘পুরুষের বিশ্ব’ বলে বিশ্বাস করা হয়। রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে উচ্চাকাঙ্ক্ষা, প্রতিদ্বন্দ্বীতার মনোভাব, বলিষ্ঠতা, আগ্রাসন ইত্যাদি গুণাবলি আবশ্যক যা পুরুষের একচেটিয়া বৈকি! এছাড়া বিশ্বব্যাপী রাজনীতি এখন টাকা এবং পেশি শক্তির কাছে বাঁধা। ক্ষমতার সঙ্গে পুরুষতন্ত্রের রসায়নই একমাত্র সত্য। যেহেতু যুগ যুগ ধরে ক্ষমতা চর্চা পুরুষের হাতে ছিল, তাই নারী ও ক্ষমতার কাছাকাছি গেলে বা শীর্ষ চেয়ারে বসলে পুরুষের মতোই আচরণ করে। একবার ইন্দিরা গান্ধীকে তার মন্ত্রিসভার নারী সদস্যের কম উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি হাসিমুখে বলেছিলেন, ‘আমার মন্ত্রিসভায় আমিই একমাত্র পুরুষ সদস্য’। ইতিহাস সাক্ষী, বিশ্বের ক্ষমতাবান কোনও নারীই পুরুষতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করেননি, বরং ক্ষমতালোভী পুরুষের মতোই আচরণ করেছেন। যারা এর ব্যতিক্রম, তারা জোয়ান অব আর্ক, সুলতানা রাজিয়া, বা খনার মতো পুরুষতন্ত্রের নির্মম বলি হয়েছেন।
এই পৃথিবী, এই রাজনীতির মাঠ ‘ট্রাম্প’ এর অর্থাৎ পুরুষতন্ত্রের। তা কখনও ট্রাম্পের হাত ধরে চর্চা হয়, কখনও বা হিলারির। ট্রাম্প ও হিলারিরা চিরদিনই বন্ধু। উভয়েই ব্যবসায় ও রাজনীতিতে ওপরে ওঠার জন্য ভেতরে পাশবিক ও গলাকাটা রূপটি ঢেকে রাখতে নারীকে বা নারীত্বকে ব্যবহার করেন। ম্যানহাটনের শিক্ষিকা স্যাম মিলার ‘জ্যাকোবিন’ সাময়িকীতে ‘ট্রাম্প অ্যান্ড উইমেন: এ মার্ক্সিস্ট ক্রিটিক’ এ বলেছেন, ‘ট্রাম্পের মেয়ে ইভাঙ্কা ও তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক বন্ধু হিলারি—উভয়েই করপোরেট নারীবাদ এর হাতে নারীর প্রকৃত স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে মুনাফা অর্জনের বা ক্ষমতা লাভের জন্য নারীকে কাজে লাগান। তাই ক্লিনটনের লাম্পট্যের প্রতিবাদ না করে তার রাজনৈতিক বিপদের দিনে হিলারি তাকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন যেমনটি আজকে ইভাঙ্কা তার বাবার রাজনৈতিক বিপদের দিনে চারিত্রিক সনদপত্র দিচ্ছেন সব লাম্পট্যকে সমর্থন করে’।
রাজনীতিতে নারীর উঁচুপদ বা ক্ষমতা মানেই নারীর ক্ষমতায়ন কিংবা নারীবাদের জয় নয় তা খুব পরিষ্কার। পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার বলয় ভাঙতে যে শক্তি, সাহস ও পরিবেশ দরকার তা নারী রাজনীতিবিদদের জন্য বিশ্বের কোথাও অবারিত নয়, ছিল না কখনও। যুগে যুগে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতা নারীর স্বার্থ রক্ষার জন্য যতুটুকু ব্যবহার হয়েছে তার চাইতে অনেক বেশি হয়েছে পুরুষতন্ত্রের স্বার্থ রক্ষার জন্য। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ বোধহয় সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিসা রাইস।তিনি একই সঙ্গে একজন নারী এবং একজন কালো মানুষ হিসেবে পুরুষতান্ত্রিক নিপীড়ন এবং বর্ণবাদী নিপীড়নের ও প্রতিনিধি। কিন্তু ক্ষমতাসীন হয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যের একজন শীর্ষ আগ্রাসী পুরুষতান্ত্রিকতার প্রতিনিধিত্ব ছাড়া কিছু করেননি রাইস। তেমনি হিলারি ক্লিনটন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য পুরুষতন্ত্রের সুবিধাভোগী হিসেবে করপোরেট নারীবাদকে প্রকাশ্যে ব্যবহার করেছেন। অতীতে যুক্তরাজ্যের লৌহমানব প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থেচার ও ক্ষমতায় থাকার জন্য নারীবাদীদের বিরুদ্ধে ছিলেন।

ইতিহাস বিশ্লেষণে ও আমরা দেখি, বিশ্বব্যাপী নারী নেতৃত্বের ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন এবং সার্বিকভাবে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন একেবারেই ভিন্ন বিষয়। শ্রীলঙ্কায় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েকের হাত ধরে বর্তমান বিশ্বে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে নারীর আগমন ঘটেছে। তারপর ইসরায়েলের গোল্ডামেয়ার, ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, যুক্তরাজ্যের মার্গারেট থ্যাচার, ফিলিপাইনের কোরাজন আকিনো, পাকিস্তানের বেনিজির ভুট্টো, বাংলাদেশে খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছানো নতুন রাজনৈতিক ধারণার জন্ম দিয়েছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে এটি ও পরিষ্কার হয়েছে যে, ক্ষমতার চেয়ারের বসা নারী এবং সেই নারীকে চালানো পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতি আসলে পরষ্পরের স্বার্থরক্ষাকারী বন্ধু। এই প্রভাবশালী নারীরা তাদের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ক্ষমতা দিয়ে বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক নিয়ম ও ক্ষমতাবলয়কে চ্যালেঞ্জ করেননি। বরং সর্বতভাবেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজকাঠামো, রীতিনীতি ও মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার অধীনেই তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা চর্চা করেছেন। আপোস করেছেন, শক্তিশালী করেছেন পুরুষতন্ত্রের হাতকে; পুরুষালি রাজনীতিবিদদের মতো যুদ্ধবাজি,অস্ত্রবাজি করেন এবং সাম্প্রদায়িকতা পুষে রেখেছেন।

ক্ষমতায় থাকা নারীরা পুরুষতন্ত্রকে দুর্বল করতে না পারার আর একটা কারণ হচ্ছে এদের অধিকাংশই প্রভাবশালী, ধনাঢ্য, ক্ষমতাবান, কিংবা খ্যাতিমান পরিবার থেকে এসেছেন, যা তাদের কিছু সুরক্ষা দিয়েছে। পারিবারিক প্রভাব বা ক্ষমতাবলয়ে বেড়ে ওঠা এই নারীদেরকে সমাজে চলমান বৈষম্য বা প্রথাগত অত্যাচার তেমন করে সহ্য করতে হয়নি, যা অন্য সাধারণ নারীকে করতে হয়েছে। যেমন, আরবে যে যুগে কন্যা সন্তানদের জীবিত কবর দেওয়া হত, সে যুগেই বিবি খাদিজা বড় ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন। ইউরোপে যে সময় 'ডাকিনি' হওয়ার মিথ্যা অভিযোগে নারীদের জীবিত আগুনে পোড়ানো হত, সেই সময়ে ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথ কিংবা স্পেনের রাণী ইসাবেলা ‘উইচহান্ট’ যুগে দাপটের সঙ্গে রাজ্য শাসন করেছেন। নারী স্বাধীনতার সূচকে তলানিতে থাকা পাকিস্তানে বেনজির ভুট্টোর মতো নারী নেত্রী বা বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খাঁ এবং স্পিকার ড. ফাহমিদা মির্জা, তারা প্রত্যেকেই অনেক প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য। কাঠ মোল্লাদের তাদের নিয়ে মন্তব্য করার সাহস করে না, যেমন বাংলাদেশে ধর্ম ভিত্তিক দলগুলো পর্দা নিয়ে বিভিন্ন দাবি দাওয়া তুললে ও বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ এর মতো নারীপ্রধান দল নিয়ে কিছু বলে না।

এবার আসি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক শীর্ষপদে নারী আছেন বলেই নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হয়েছে বা পুরুষতন্ত্র দুর্বল হয়েছে তা ভাবার অবকাশ নেই। কারণ একজন প্রধানমন্ত্রীকে যে রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এই পদে আসতে হয় সেটি  পুরুষ নিয়ন্ত্রিত এবং নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক। যে রাজনৈতিক দল প্রধানমন্ত্রী কিংবা বিরোধী নেতার ক্ষমতার উৎস, সেই দল রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণকে নিস্কণ্টক করে না, উৎসাহিত করে না। প্রধানমন্ত্রী নারী হলেও পুরুষতান্ত্রিক এই সিস্টেম এর বাইরে যেতে পারেন না। তাই গত দুই দশকের ও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে নারীরা রাজনীতি এবং প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে থাকলে ও নারী নীতি বা উত্তরাধিকার আইন কিংবা অভিভাবক আইনের মতো বিষয়ের কোনও মীমাংসা হয়নি। এ এস রুইয়ান এবং ভি এস পেটারসন বলেন, ‘...যারা বলেন যে, সফল মহিলাদের পক্ষে তথাকথিত পুরুষসুলভ গুণাবলি রপ্ত করার প্রয়োজন নেই, তারা ভুলে যান যে, সমাজ কর্তৃক সংজ্ঞায়িত নারী ও পুরুষের পরিচয় জ্ঞাপক বৈশিষ্টের পরিপ্রেক্ষিতে পুরুষসুলভ বৈশিষ্ট্য গ্রহণ ও ধারণ নারীকে কর্তৃত্বের ভূমিকায় গ্রহণযোগ্য করার একমাত্র সম্ভাব্য কৌশল...(গ্লোবাল জেন্ডার ইস্যুসঃ ইন দ্যা নিউ মিলেনিয়াম)

নারীর হাতে ক্ষমতা থাকা স্বত্ত্বেও যদি নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর না হয়, যদি সন্তানের অভিভাবকত্বের অধিকারটুকু নারী না পায়, যদি সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্যমূলক আইনের পরিবর্তন না হয়, যদি এখনও ধর্ষিতাকেই ধর্ষণ প্রমাণ করতে হয়, যদি আইসিস নামক ভয়ঙ্কর ধর্ম-দানবের হাত থেকে যৌনদাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দী থাকা, প্রকাশ্য বাজারে কেনা-বেচা হওয়া, ইয়াজিদি নারীদের ভোগ করা শেষে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা অথবা সৌদি বাদশার হেরেমে আটকে থাকা হাজার হাজার যৌন দাসী মুক্তি না পায়, যদি রাজনৈতিক এজেন্ডায় না থাকে নারীর সর্বোত্তম স্বার্থ সুরক্ষা, যদি পুরুষের বৈষম্যমূলক নিয়ম কোনও ক্ষোভের উদ্রেক না করে, তবে নারী যতই শীর্ষক্ষমতায় বসুক না কেন, তিনি রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাহীন। সে ক্ষমতা পুরুষতন্ত্রের নারীরুপ ছাড়া আর কিছুই নয়।

দেশের সাধারণ নারীরা নিজ যোগ্যতায় রাজনৈতিক চর্চার মধ্য দিয়ে শীর্ষে পৌঁছুতে পারলেই কেবল নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন সম্ভব। সেই নারীরা, যারা সন্ধ্যার অন্ধকারে ধর্ষণের ভয় নিয়ে ফুটপাতে একা হাঁটে বা রাতের বাসে ঘরে ফিরে, যে নারী তার প্রাত্যহিক জীবনে টিকে থাকার সংগ্রাম করেছে, আর ডানে-বামে-উত্তরে-দক্ষিণে নিষেধের কাঁটাতার পেরিয়ে রাজপথে এসেছে, যে নারী রাজনীতিতে পুরুষ সহকর্মীর হাতে সহিংসতার শিকার হয়ে ও ঘুরে দাঁড়িয়েছে, পুরুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, টাকার জোর, পেশির জোর, আগ্রাসন, ইত্যাদিকে পদে পদে মোকাবিলা করে রাজনীতি চর্চা করেছে যে নারী, তাদের হাতে ক্ষমতা এলেই নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যাবে এবং তখনই সমাজে নারীদের নায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।

লেখক: প্রধান নির্বাহী, সংযোগ বাংলাদেশ, কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভাতা বাড়ানোর আশ্বাসে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার
ভাতা বাড়ানোর আশ্বাসে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার
সরকারি চাকরির আশ্বাস ও ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে কোটি টাকা আত্মসাৎ
সরকারি চাকরির আশ্বাস ও ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে কোটি টাকা আত্মসাৎ
আইসিসি এলিট প্যানেলে প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার সৈকত
আইসিসি এলিট প্যানেলে প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার সৈকত
অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে ভুটানের রাজার সন্তোষ প্রকাশ
অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে ভুটানের রাজার সন্তোষ প্রকাশ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ