X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

তাজরীন থেকে কালার ম্যাচ ফ্যাক্টরি

মোশাহিদা সুলতানা ঋতু
২৫ নভেম্বর ২০১৬, ১৫:১৫আপডেট : ২৫ নভেম্বর ২০১৬, ১৫:২০

 

মোশাহিদা সুলতানা ঋতু তাজরীন হত্যাকাণ্ডের চার বছর হয়ে গেল। দুইদিন আগে ২২শে নভেম্বর ২৫ জন শ্রমিক কালার ম্যাচ বিডি লিমিটেড নামে একটি গ্যাস লাইটার ফ্যাক্টরিতে আগুনে পুড়ে হাসপাতালে বার্ন ইউনিটে ভর্তি হয়েছেন। তাজরীনের পর স্মার্ট গার্মেন্টস (২০১৩), রানা প্লাজা (২০১৩), ট্যাম্পাকো প্যাকেজিং (২০১৬) ছাড়াও অনেক কারখানায় বয়লার বিষ্ফোরণে আরও অনেক শ্রমিক নিহত ও গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন। একেকটি ঘটনা একেকভাবে ঘটলেও মূল অভিযোগ মূলত শ্রমিক শ্রেণির প্রতি অবহেলা।
আজকে আবার প্রশ্ন উঠতে পারে, এই সময়ের সবচেয়ে বড় অগ্নিকাণ্ডকে ও ভবনধসকে নিছক দুর্ঘটনা হিসাবে চালিয়ে দিয়ে এদেশের মানুষেরা কি আসলে ভালো আছে? অথবা, একজন দায়িত্বহীন মালিককে শাস্তি না দিয়ে কি এদেশের মানুষ ভালো আছে? তাহলে প্রথমেই জিজ্ঞেস করতে হয় এদেশের মানুষেরা কারা? মালিকপক্ষ যদি হয় নিশ্চয়ই ভালো আছে। তারা তাদের উপযুক্ত শাস্তি না পেয়ে ভালোই আছে। আর এদিকে নিম্নবিত্ত খেটে খাওয়া মানুষেরা? সারাদিন নিজেদের জীবন বাজী রেখে দেশের জিডিপি বাড়াচ্ছেন। আর ভালো আছে তারাই যারা এইসব ফ্যাক্টরি ধসে অথবা আগুন লেগে মরেই গিয়েছে। তাদের আপনজনেরা যারা দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন তাদের দেখতে হচ্ছে না এইসব মৃত মানুষদের। এই যেমন তাজরীনের ১১৯ জন, রানাপ্লাজার ১১৩৬ জন, স্মার্ট গার্মেন্টেসের ৭ জন, এবং দুইদিন আগে ভাগ্যবতীদের দলে যোগ দিলেন কালার ম্যাচ বিডি লিমিটেডে কর্মরত ১৪ বছর বয়সী মেয়ে আঁখি। ১৪ বছরেই মৃত্যু-লটারি খেলায় জয়ী হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে চলে গেছে সে। যারা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে তাদের বেশিভাগেরই শ্বাসনালী পর্যন্ত পুড়ে গেছে। অনেকদিন লাগবে তাদের স্বাভাবিক হতে। কেউ কেউ কখনওই সেরে উঠবেন না, অন্যের বোঝা হয়ে বাকি জীবন পার করবেন।

 কালার ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে ২৫০ জন কাজ করতেন। আগুন লেগে পুড়ে হাসপাতালে যেই ছাব্বিশজন ভর্তি হয়েছিলেন তাদের আটজনের বয়সই ১৮র নীচে। সবচেয়ে বেশি বয়স যার তার বয়স ৩০। মানুষ সবচেয়ে বেশি কর্মক্ষম থাকে যেই বয়সে সেই বয়সেই এইসব মেয়েদের অন্যের বোঝা হয়ে বাকি জীবন কাটাতে হবে। পুড়ে যাওয়া মানুষের চিকিৎসা কিন্তু হাত পা ভাঙ্গা মানুষদের চিকিৎসার মতো নয়। একজন পুড়ে যাওয়া মানুষের নিবিড় পরিচর্যা লাগে বহুদিন। খাবার গ্রহণ করতে পারে না, রক্ত লাগে, প্লাজমা লাগে, সবসময় একজন পরিচর্যাকারী লাগে পাশে থাকার জন্য। সেই পরিচর্যা যে করবে তার খাবার লাগে। পুড়ে যাওয়ার কয়েক মাস পর্যন্ত দামি অ্যান্টিবায়োটিক লাগে। আবার যারা অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের অনেকের কর্মক্ষম হতে প্রায় ৩-৪ বছর সময় লেগে যায়। সেই সময়ের দুর্ভোগ অনেকক্ষেত্রে তাদের ঋণগ্রস্ত করে ফেলে। ক্ষতিপুরন সময় মতো না পেয়ে তার অর্থনৈতিক ভাবে অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে জীবন কাটায়। তাজরীনে অগ্নিকাণ্ডে দেখা গেছে এমন অনেক ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকেরা তিন বছর অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় মৃত্যুর সাথে লড়াই করে যখন মেডিকেল চেকআপ করতে গেছে ততদিনে তাদের শারীরিক সক্ষমতা কিছুটা বেড়েছে আর তখন তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি এই বিবেচনায় যে তারা এখন অনেকটা সেরে উঠেছেন। অর্থাৎ তিন বছর যেই অন্ধকার সময় তারা পার করে এসেছেন সেই সময়ের কোন মূল্য তারা পায়নি। অর্থাৎ এই ক্ষতিপুরন যত দেরি করে দেওয়া যায় ততই মালিক পক্ষের বা সরকারের লাভ।

কালার ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে যেই ছোট ছোট মেয়েগুলি এখন লড়াই করছে মৃত্যুর সঙ্গে তাদের সঙ্গে এমন হলে আবারও তাদের প্রতি একই অবিচার হবে যদি তাজরীন অগ্নিকাণ্ড থেকে আমরা কিছু শিখে না থাকি।  

আমাদের দেশে শ্রমিকের মূল্য এমনিতেই কম। আবার শুধু মজুরি দিয়ে শ্রমিকের শ্রমের মূল্য হিসাব করা যায় না। যেই পরিবেশে তারা কাজ করে ঝুঁকি গ্রহণের জন্য তাদের যেই মজুরি প্রাপ্য তা তো তারা পায়ই না, উপরন্তু জীবন হারালে অথবা আহত হয়ে কর্মক্ষমতা হারালেও তাদের যেই ক্ষতিপুরন দেওয়া উচিত তা দেওয়া হয় না। স্থানীয় এমপি কালার ম্যাচ ফাক্টরির শ্রমিকদের চিকিৎসা বাবদ মাত্র দশ হাজার টাকা দিবেন বলে জানিয়েছেন। অথচ দেখা যাবে একদিনে একজন শ্রমিকের অ্যান্টিবায়োটিকের খরচই লেগে যাবে দশ হাজার টাকা। আর পরিবারের যেই সদস্যরা গ্রাম থেকে এসে তাদের পরিচর্যা করছেন তাদের নিজেদের প্রতিদিনের পারিশ্রমিক থেকে তারা যেমন বঞ্চিত হচ্ছেন তেমনি মেডিক্যালে থেকে তাদের এই যে প্রতিদিন খরচ হচ্ছে সেটাই বা তারা দিবেন কোথা থেকে? এরকম দায়সারা চিকিৎসা খরচ না নিয়ে মালিকপক্ষকে বাধ্য করা উচিত পুরো চিকিৎসা খরচ বহন করতে। এক্ষেত্রে সরকার যদি ব্যার্থ হয় মালিকপক্ষকে দিয়ে খরচ বহন না করাতে তাহলে সরকারের উচিত সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেওয়া। আর সরকার যদি বলে ক্ষতিপুরণের আইন মোতাবেক তাদের ক্ষতিপুরণ দিতে হবে তাহলে বলতে হবে অবিলম্বে এই আইন পরিবর্তন করতে হবে। পুর্ণকর্মক্ষমতা হারালে ক্ষতিপুরণ মাত্র এক লাখ ২৫ হাজার টাকা, আর নিহত হলে এক লক্ষ টাকা ক্ষতিপুরণ কিসের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়েছে? এক লাখ টাকা দিয়ে কি হয়? দশদিনের চিকিৎসাই তো হয় না, খেয়ে বেচে থাকা তো দূরের কথা।

তাজরীন অগ্নিকাণ্ড চার বছর পরেও মালিকপক্ষকে কিছু শিখাতে পারেনি কিন্তু আমরা যা শিখেছি তা হল আমাদের দেশে এই মুহূর্তেই শুধু গার্মেন্টস শ্রমিক নয়, সব শ্রমিকদের ক্ষতিপুরণ নিয়েই নির্দিষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে। মালিকপক্ষ তার দায় দায়িত্ব পালন করেনি, রাষ্ট্র এই মালিকপক্ষের ব্যাপারে কঠোর হয়নি, এবং ঝরে যাওয়া প্রাণ বা ধুঁকতে থাকা অসংখ্য প্রাণ চিকিৎসার অভাবে, অবহেলায়, ক্ষতিপুরণ না পেয়ে, অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করেছে। 

প্রথমত, আমরা কোনও রকম অগ্নিকাণ্ড, ভবনধস, বয়লার বিস্ফোরন, বা অন্য কোনও দুর্ঘটনাজনিত, অস্বাভাবিক কারণে শ্রমিকের মৃত্যু দেখতে চাই না। প্রতিটি কারখানায় শ্রমিকদের জন্য উপযুক্ত কর্ম পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আর প্রতিটি শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তা সুরক্ষিত রেখে তাদের জীবনকালের আয় থেকে বঞ্চনা, প্রাত্যহিক ভোগান্তি, ঝুঁকি গ্রহণের মূল্য, এবং পারিবারিক ক্ষতি বিবেচনায় রেখে নতুন করে ক্ষতিপুরণ আইন তৈরি করতে হবে। কে চিকিৎসা খরচ বহন করবে তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। নামে মাত্র কোন পরিমান চিকিৎসা বা ক্ষতিপুরণ বাবদ ধার্য না করে শ্রমিকের চিকিৎসার পূর্ণ খরচ বহনের দায়িত্ব মালিকপক্ষের ওপর ন্যাস্ত করতে আইনত বাধ্য করতে হবে। তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের চার বছর পরও যদি আমরা এইসব পরিবর্তন না আনতে পারি, তাহলে এইসব শ্রমিকদের জীবনের বিনিময়ে মধ্যম আয়ের দেশের কোন মূল্য আমাদের কাছে নেই।

লেখক-শিক্ষক, ডিপার্টমেন্ট অফ একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ