X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতেই হবে

ড. জোবাইদা নাসরীন
২৭ নভেম্বর ২০১৬, ১২:০৮আপডেট : ২৭ নভেম্বর ২০১৬, ১২:১৯

জোবাইদা নাসরীন পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশ সরকারের কাছে তাদের পাওনা ৭০০ কোটি টাকা দাবি করেছে। এটি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানে। পাকিস্তানের স্টেট ব্যাংককে উদ্ধৃত করে এই বিষয়ে আরও খবরে বলা হয়েছে- সরকারি অফিস, ঋণ, আগাম সুবিধাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পরিবর্তনের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের কাছে যে টাকা পাওনা ছিল, যা ২০১৬ সালের জুন নাগাদ ভ্যালুয়েশন করে তা ৬০০ কোটি ৯২ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের কাছে তাদের এই টাকা ফেরত চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। তবে এই টাকা চাওয়া এবং ফেরত দেওয়া না দেওয়ার আগে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের অতি গুরুত্বপূর্ণ দরবারটি খোলাসা হওয়া প্রয়োজন।
সবচেয়ে বড় এবং অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বারবার পাকিস্তান সরকার এড়িয়ে গেছে। আর সেটি সেটি হলো ১৯৭১ সালে  এদেশের মানুষের ওপর যে গণহত্যা, নির্যাতন, নিপীড়ন চালিয়েছিল তার জন্য আজও পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়নি। বৈশ্বিক প্রবল চাপের মুখে‌ ১৯৭৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় পাকিস্তান। এবং এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে তাদের মনোভব একাত্তরের মতো, যার প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া এবং পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের কুটনীতিক প্রত্যাহার। পাকিস্তানের ক্ষমা বিষয়ে সর্বশেষ রাষ্ট্রীয় তৎপরতা ছিল ২০১২ সালে। সেই সময় পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনা রাব্বানি ঢাকায় এলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে এই ক্ষমা চাওয়ার দাবির কথা জানানো হয়। তখন হেনা  বাংলাদেশকে তার অতীত ভুলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে এই আলোচনার ইতি টানেন। সবাই জানেন যে, ১৯৮১ সালে জাতিসংঘের ঘোষিত ইউনিভার্সেল ডিক্লেয়ারেশন অব হিউম্যান রাইটস হিসাবে, সবচেয়ে কম সময়ে অর্থাৎ ১৯৭১ সালে নয় মাসে সবচেয়ে বেশি গণহত্যা করা হয়েছে বাংলাদেশে। তবে হেনা রাব্বানীর আগেও ১৯৯৮ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ঢাকা সফরে এলে এই বিষয়টি উত্থাপন করা হয় এবং শরিফ একাত্তরকে সেই সময়ের একটি রাজনৈতিক অস্থিতিশীল ঘটনা বলে আখ্যায়িত করেন। তবে এই বিষয়ে কিছুটা ব্যতিক্রম- ২০০২ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ ঢাকায় এলে আবারও ৭১'র এর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলে তিনি ৭১-এর ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। এটিই ছিল প্রথম কোনও রাষ্ট্র প্রধানের আনুষ্ঠানিক দুঃখ প্রকাশ যদিও গণহত্যার দায় তিনি স্বীকার করেননি। অবশ্য পাকিস্তানের সরকার ক্ষমা না চাইলেও বিভিন্নভাবে সরকারিভাবে বিভিন্ন ব্যক্তি এবং সংগঠন বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। ২০০২ সালে পাকিস্তানের নাগরিক সমাজের ৫১টি বেসরকারি সংগঠন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা চায়। শুধু তাই নয়, শুধু ক্ষমা চাওয়াই নয়, সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে জোর গলায় বলা হয় যে ১৯৭১ সালের ঘটনার জন্য পাকিস্তান সরকারের বাংলাদেশের কাছে আরও আগেই ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল।

কিন্তু এখন পাকিস্তান উল্টো টাকা দাবি করছে। প্রশ্ন হলো পাকিস্তানের এই দাবি কতটা যৌক্তিক? বরং উল্টো হিসেব করলে কী দাঁড়ায়? মুক্তিযুদ্ধের ক্ষতিপূরণের কথা বাদ দিলেও একাত্তর সালে ঢাকায় স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান থেকে সরিয়ে নেওয়া অর্থবাবদ পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনা প্রায় ২৪০ কোটি মার্কিন ডলার। ২০১০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের কাছে এই অর্থ ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিল বাংলাদেশ। পাকিস্তান বাংলাদেশের এই ন্যায্য দাবিকে ‘স্পর্শকাতর’ বিষয় হিসেবে বাক্সবন্দী করে এবং এই বিষয়ে আলাপ থেকে নিজেদের দূরে রাখে। যদিও কেন এটি স্পর্শকাতর সেই বিষয়ে পাকিস্তান কোনও কারণ দেখায়নি। শুধু স্টেট ব্যাংকের অর্থই নয়, এর আগের হিসেবও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭০ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বন্যাদূর্গতদের সহযোগিতা এবং বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কারের জন্য  বৈদেশিক সাহায্য হিসেবে আসা প্রায় ২১০ মিলিয়ন  ডলার রক্ষিত ছিল ঢাকায় স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানে। কিন্তু ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের পর ওই অর্থের কোনও ভাগ বাংলাদেশকে দেয়নি পাকিস্তান এবং এই বিষয়ে পাকিস্তান সব সময় চুপ থেকেছে। বাংলাদেশের তরফ থেকে দফায় দফায় তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান সরকার ওই অর্থ ফেরত দেয়নি। জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধে এদেশের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১২ লাখ ডলারেরও বেশি, যা পাকিস্তানের মাধ্যমে সৃষ্ট। ১৯৭৪ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকা সফরে আসেন। সেই সময়েও এইক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়। পাকিস্তানের প্রতি বাংলাদেশের দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দাবি ছিল ১৯৭১ সালের আগে অখণ্ড পাকিস্তানের প্রায় ৪৪০ কোটি  ডলারের সমপরিমাণ সম্পদের হিসাব, যার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ রয়েছে। তবে মজার বিষয় হলো এই সংক্রান্ত কোনও বৈঠক করতে চাইলেই পাকিস্তান 'স্পর্শকাতর' বিষয় বলে এটিকে অগ্রাহ্য করে অথবা আলাপ করতে অনাগ্রহ ভাব প্রকাশ করেছে।

পাকিস্তান মুক্তিযুদ্ধের ৪৫ বছর পরও বাংলাদেশের কাছে ১৯৭১ সালের তাদের গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি এবং কোনও ধরনের ক্ষতিপূরণ দেয়নি। মুক্তিযুদ্ধের আগে পরের অনেক অর্থনৈতিক দেনা-পাওনা বিষয়ে পাকিস্তান সরকার নীরব থেকেছে। কিন্তু উল্টো বাংলাদেশের কাছে ৭০০ কোটি টাকা দাবি করেছে। তবে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রয়োজন পাকিস্তানের ওপর চাপ তৈরি করা যাতে পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চায় এবং মুক্তিযুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ ১২ লাখ ডলার প্রদান করে। এরপর বাংলাদেশ তার পূর্বের পাওনা বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করার। এখনই সময় এই বিষয়ে প্রশ্ন তোলার, এখনই সময় এই বিষয় একাত্তরের বোঝাপড়া বুঝে নেওয়ার।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: [email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মিয়ানমার-থাই সীমান্তে আবারও বিদ্রোহীদের হামলা, থ্যাইল্যান্ডে পালাচ্ছে মানুষ
মিয়ানমার-থাই সীমান্তে আবারও বিদ্রোহীদের হামলা, থ্যাইল্যান্ডে পালাচ্ছে মানুষ
দেশের ৯ অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির বেশি, পারদ উঠতে পারে আরও
দেশের ৯ অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির বেশি, পারদ উঠতে পারে আরও
ভুয়া অবিবাহিত সনদের মেয়াদ বাড়াতে গিয়ে ধরা পড়লেন এক ব্যক্তি
ভুয়া অবিবাহিত সনদের মেয়াদ বাড়াতে গিয়ে ধরা পড়লেন এক ব্যক্তি
ঢাকায় ‘র‌্যাম্পে হাঁটলো’ উট, ঘোড়া, কুকুরসহ বিভিন্ন পোষা প্রাণী
ঢাকায় ‘র‌্যাম্পে হাঁটলো’ উট, ঘোড়া, কুকুরসহ বিভিন্ন পোষা প্রাণী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ