X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

নাসির উদ্দীন এবং অসাম্প্রদায়িকতা চর্চা

আনিস আলমগীর
২৯ নভেম্বর ২০১৬, ১৬:৫৭আপডেট : ২৯ নভেম্বর ২০১৬, ১৭:২০

আনিস আলমগীর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) একটি বিভাগের অনুষ্ঠানে হিন্দু শিক্ষার্থীদের খাসির বলে গরুর মাংসের তেহারি খাওয়ানোর অভিযোগ উঠেছে। সাম্প্রদায়িক মন মানসিকতা কতটা বীভৎস এবং বিকৃতির পর্যায়ে গেলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে কল্পনা করা যায়! নিজদেশে সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি ছাড়া করে পাশের মিয়ানমারের সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে মাতম তুলছি আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায়।
ধর্মকে অধর্মের হাতিয়ার করছি সব কিছুতেই। সব কিছুকে দেখছি ধর্মীয় বিবেচনায়। মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান না করে তাকে বিবেচনা করছি তার ধর্ম দিয়ে। তাকে ভালোবাসছি ধর্ম দিয়ে, ঘৃণাও করছি ধর্ম বিবেচনা করে।
অবশ্য ধর্মকে অধর্মের হাতিয়ার করার বিষয়টি যে শুধু আমাদের কালে হচ্ছে তা নয়। যুগে যুগে চলে আসছে। আবার সেই নোংরামির ঊর্ধ্বেও উঠেছে সমাজের একটা অংশ। তারা কাজে কর্মে প্রমাণ করেছেন সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে, নিজের ধর্ম, সম্প্রদায়কে বিসর্জন না দিয়েও যে অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা করা যায় সে প্রমাণ রেখেছেন তারা।
তেমন একজন মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন। গত ২০ নভেম্বর ২০১৬ ছিল নাসির উদ্দীনের ১২৮তম জন্মবার্ষিকী। ১৮৮৮ সালের ২০ নভেম্বর চাঁদপুর জেলার পাইকদি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। একটু বিলম্বে হলেও সাম্প্রদায়িকতার চরম অবস্থায় অসাম্প্রদায়িকতার চর্চাকারী হিসেবে স্মরণ করতে চাই এই মহান ব্যক্তিত্বকে। আজকের এই সময়ে মনে হচ্ছে এসব মনীষীকে স্মরণ করা অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।

পশ্চিমের এক মনীষী বলেছিলেন, ‘ঈশ্বর যদি এক হাতে পূর্ণতা অপর হাতে প্রয়াসের অনন্ত দুঃখ, এ দুইটি নিয়ে বলেন, কোনটি নেবে বলো, তা হলে বলবো, পিতঃ প্রমাদহীন পূর্ণতা তোমাতেই সাজে। আমাকে দান কর অনন্ত দুঃখ ভরা প্রয়াস।’

নাসির উদ্দীন ছিলেন অনন্ত প্রয়াসের যাত্রী। তাকে অনেকে সাংবাদিকতার পথিকৃত বলে উল্লেখ করে থাকেন। তাঁর এ পরিচয় খুবই লঘু আকারের পরিচয়। তিনি তাঁর সাংবাদিক পরিচয়ের সঙ্গে একটা জাতির জাগরণেরও পথিকৃত। অনেকে বলতে পারেন আমি তাকে মুসলমান হিসাবে ব্রাকেটবন্দি করছি। তা কিন্তু নয়। সত্যটা তুলে ধরার চেষ্টা করছি মাত্র।

একবার এক ব্রাহ্মণ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বলেছিলেন মধুসূদন ধর্মত্যাগী, তাকে কেন আপনি এত সাহায্য করেন? তখন বিদ্যাসাগর মহাশয় বলেছিলেন, ‘তুমি ব্রাহ্মণ তুমি ধর্মপূজারী, তুমি একটা মেঘনাদবধ রচনা করে নিয়ে আসো, আমি তোমাকেও সাহায্য করব।’

বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মতো নাসির উদ্দীনও কাজী নজরুলকে অকাতরে সাহায্য সহানুভূতি প্রদান করেছিলেন। সওগাত পত্রিকাকে অবলম্বন করেই কবি নজরুল বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক জীবন ছেড়ে নজরুল সাহিত্যের অঙ্গনে আসেন ১৯২১ সালে আর নাসির উদ্দীনের সওগাতের সূচনাকাল ১৯১৭ সাল। নাসির উদ্দীন নজরুলকে সহায়তা জুগিয়ে ছিলেন শুধু তাই নয় বঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সমাজকেও অস্তিত্ব উপলব্ধিতে প্রেরণা জুগিয়েছিলেন।

তখনতো বাংলার মুসলমানেরা বাংলা সাহিত্যে তাদের অস্তিত্বের সংকটের আবর্তে পড়ে ঘুরপাক খাচ্ছিলো। বাংলার মুসলমানতো তখন বঙ্কিমের কষাঘাতে ক্ষুব্ধ ও ম্রিয়মান ছিল। নাসির উদ্দীন মুসলমান শিক্ষিত ও প্রতিভাবান যুবকদের লেখার জন্য উৎসাহ জুগিয়ে ছিলেন। ঘরে ঘরে গিয়ে লেখা সংগ্রহ করে এনে সওগাতে ছাপিয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাসির উদ্দীনের এ ব্যাকুলতা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি সওগাতকে বিনা পয়সায়  লেখা দিয়ে সহায়তা করতেন। রবীন্দ্রনাথের এ সহায়তার কারণে সওগাত নিম্নমানের পত্রিকা হিসাবে কখনও বিবেচিত হয়নি।

হিন্দু সম্পাদকের পত্রিকাগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে মাঠেই ছিল। আবার নাসির উদ্দীনের সওগাত, মওলানা আকরাম খাঁর ‘মহাম্মদী’ বা মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামবাদীর ‘সুলতান’ পত্রিকার মতো সাম্প্রদায়িকতার ক্ষত চিহ্ন কখনও বহন করেনি। মনীষী আল বেরুনি তার ভারত ভ্রমণের বৃত্তান্ত লিখেছেন, ‘মাহামুদের আঘাতে এদেশের শ্রী সম্পদ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়েছে, হিন্দুরা দিগবিদিক ধূলিকণার মতো বিক্ষিপ্ত হয়েছে, এ সব চূর্ণবিচূর্ণ কণার অন্তরে মুসলিম বিদ্বেষ নিদারুণ।’

নাসির উদ্দীন ও সওগাত এ বাস্তবতা উপলব্ধি করে কোনও বিষয়ে নির্বাক থাকাকেই উত্তম মনে করতেন কিন্তু মওলানা আকরাম খাঁ ও মহাম্মদী আর মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামবাদী ও সুলতান নির্বাক থাকাকে ভীরুতা মনে করে সোচ্চার হতেন। অবশ্য দেখা গেছে তিন পত্রিকা আর তিন সম্পাদক একযোগে প্রতিবাদমূখর হয়েছিলেন যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের মনোগ্রামে স্বরসতীর মূর্তি স্থাপন করেছিলেন।

মহাম্মদী আর সুলতান পত্রিকা লিখেছিল ধর্মীয় অনুভূতি থেকে আর সওগাত লিখেছিলো অসম্প্রদায়িকতাকে মূখ্য উপজীব্য করে। তারা সফল হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত স্বরসতীর মূর্তি বাদ দিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাধ্য হয়েছিলো। নাসির উদ্দীন কখনও অসহিষ্ণু ছিলেন না। অসহিষ্ণুতাকে তিনি কখনও অহিংষ্ণুতা দিয়ে মোকাবিলা করেননি। তিনি অন্য পত্রিকাগুলোর মতো কোনও কলহে কখনও ইন্ধনও জোগাননি।

দক্ষ মাঝি প্রতিকূল হাওয়াকেও বহু পরিমাণে তার কাজে লাগাতে পারে। নজরুল বাংলা সাহিত্যে, গানে এক নবধারা সংযোজন করলেন। বাংলার গ্রামের মানুষগুলোকে টেনে আনলেন সাহিত্যে জসিমউদ্দীন। সেটাও কিন্তু একটা নব-ধারা। মুসলমান সমাজ অনেকটা গ্লানি মুক্ত হলো। এতে নাছির উদ্দীনের ক্লান্তিহীন সাধনা ছিল।

১৯১৭ সালে চাঁদপুর থেকে কলকাতায় গিয়ে ‘সওগাত’ পত্রিকা আরম্ভ করেছিলেন তার প্র্যাগমেটিক আইডিয়ায়। তার কাছে তার সমাজ নিয়ে উদ্বেগ ছিল। মওলানা আকরাম খাঁর ‘মহাম্মদী’ বা মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামবাদীর ‘সুলতান’ পত্রিকা মুসলমান সমাজকে অধঃপতিত অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনার প্রয়াস ছিল না, প্রয়াস ছিল ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে কলহ সৃষ্টি করা। আর নাসির উদ্দীনের প্রয়াস ছিল ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে মুসলমান যে ধন্য অবস্থার মাঝে পড়েছিল তা থেকে তাকে উদ্ধার করা। তিনি বুঝেছিলেন যে ভিক্ষালব্ধ কোনও কিছু দিয়ে মুসলমানকে উদ্ধার করা যাবে না আপন প্রয়াসে আপন পরিমণ্ডলে তাকে আপন প্রয়োজন মেটাতে হবে।

মুসলমান সমাজের এই প্রয়োজন মেটানোর কাজ করেছেন নাসির উদ্দীন আর ‘সওগাত’ পত্রিকা। নাসির উদ্দীন মনে করেছিলেন, কলহ বিরোধ তার সমাজের প্রয়োজন মেটানোর পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে তাই তিনি সে পথ সব সময় পরিহার করে চলেছেন। কলহ বিরোধ সম্প্রদায়কে তুষ্ট করতে পারে সমাজকে নয়, কারণ সমাজে তো অন্য সম্প্রদায়ও থাকে। অনেক পত্রিকা অন্যান্য ধর্মের বিরুদ্ধে ইসলামকে দাঁড় করিয়ে ইসলামের মহিমা কীর্তন করাকেই তাদের কাজ মনে করতো এবং তা তারা করেছেনও।

এটি কিন্তু সাহিত্যের জন্য জরুরি কোনও বিষয় ছিল না। নাসির উদ্দীন তা উপলব্ধি করেছিলেন বলে তার সওগাত পত্রিকাকে এমন কাজ থেকে বিরত রেখেছিলেন। মূলত সওগাত সম্পাদক নাসির উদ্দীন ছিলেন গত শতাব্দীতে মুক্তবুদ্ধির চর্চার পথিকৃত।

নাসির উদ্দীন যুবা বয়সে কলকাতা গিয়েছিলেন আধুনিক পত্রিকা প্রকাশের জন্য। তখন তার বয়স ছিল ২৯ বছর। মুসলমানের পত্রিকায় নারী-পুরুষের ছবি কল্পনাই করা যেত না। হাজী শরিয়তুল্লাহর পৌত্র পীর বাদশা মিঞা সওগাত পত্রিকা পড়ে নাসির উদ্দীনকে চিঠি লিখেছিলেন আপনার পত্রিকা ভালো লেগেছে কিন্তু আপনার পত্রিকায়তো নারী-পুরুষের ফটো রয়েছে তা ঘরে রেখে নামাজ পড়লেতো নামাজ হবে না।

তখন নাসির উদ্দীন পীর সাহেবকে লিখেছিলেন, আপনারা রাজার ফটোসহ কাগজের নোট কয়েন পকেটে রেখে নামাজ পড়েন। কখনওতো নামাজ পড়ার জন্য টাকা মসজিদের বাইরে রেখে আসেন না। তখন নামাজ হয় কিভাবে? পীর সাহেব নাসির উদ্দীনের উত্তর শুনে তার অভিযোগ প্রত্যাহার করেছিলেন এবং সওগাত-এর নিয়মিত গ্রাহকও হয়েছিলেন।

নাসির উদ্দীনকে পীর সাহেব চিঠি লিখেছিলেন তার ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর আগে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ছৈয়দ আহাম্মদকে দিল্লির রাজপথে ওলামা মাশায়েকেরা দৈহিকভাবে লাঞ্ছিত করেছিলেন। আধুনিকতার ছোঁয়া থেকে মুসলিম সমাজকে বাইরে রাখার জন্য তারা অনেকটা অবরোধই সৃষ্টি করেছিলেন। নাসির উদ্দীন তার দীর্ঘদিনের সাধনায় সে অবরোধ ভেঙেছিলেন। তিনি যা করেছেন তাতে তার সম্প্রদায়ের ও উপকার হয়েছে আবার সমাজও উপকৃত হয়েছে।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গরমে রাস্তায় পানি ছিটানোর সুপারিশ সংসদীয় কমিটির
গরমে রাস্তায় পানি ছিটানোর সুপারিশ সংসদীয় কমিটির
মাটি কাটার সময় বেরিয়ে এলো রাইফেল, গ্রেনেড ও মর্টারশেল
মাটি কাটার সময় বেরিয়ে এলো রাইফেল, গ্রেনেড ও মর্টারশেল
২৩ মিনিটে জামালকে তিন গোল দিয়ে সেমিফাইনালে পুলিশ
২৩ মিনিটে জামালকে তিন গোল দিয়ে সেমিফাইনালে পুলিশ
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ