X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

দিল্লির দরবারে - পর্ব ১

জুলফিকার রাসেল
০৫ অক্টোবর ২০১৫, ১৯:০৭আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৭:৪৫

জুলফিকার রাসেল ‘আচ্ছা, বাংলাদেশে এখন নতুন করে নির্বাচন হলে আমাদের কি আদৌ কোনও লাভ আছে? খামোখা আমরা সেখানে অন্তর্বর্তী নির্বাচন চাইতে যাব কেন বলুন তো?’
বক্তার নাম প্রকাশ করতে পারব না। তবে তিনি ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপির একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা, বিশেষ করে ভারতে সরকারের ‘বাংলাদেশ অ্যাফেয়ার্স’ নিয়ে খুবই মাথা ঘামান–ঢাকায় রাজনীতিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন এবং নিজের সরকারকে নিয়মিত ‘ইনপুট’ দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী নির্বাচনের সম্ভাবনা নিয়ে ভারতের মনোভাব কী, জিজ্ঞেস করতেই তার কাছ থেকে ওপরের ওই জবাবটা পেলাম।
দক্ষিণ দিল্লির অভিজাত এলাকায় ওই বিজেপি নেতা তথা এমপি’র চমৎকার সাজানা-গোছানো বাড়িতে বসে তুমুল আড্ডা চলছিল। ভারত ও বাংলাদেশ সম্পর্কের নানা বিষয় নিয়ে সব প্রশ্নেরই খোলামেলা জবাব দিচ্ছিলেন তিনি, তবে শর্ত ছিল–পুরো আলাপটাই ‘অফ দ্য রেকর্ড’, তাকে কোনওভাবে কোট করা চলবে না। না, তার পরিচয় প্রকাশ করতে চাইছিও না–কিন্তু বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের রাজনীতিকরা ঠিক কীভাবে ভাবেন, বাংলাদেশিদের কীভাবে দেখেন সে ব্যাপারে ওই আলাপচারিতা আমার চোখ অনেকটাই খুলে দিয়েছিল।
আসলে গত সপ্তাহে টানা তিনদিন ধরে দিল্লিতে ক্ষমতার অলিন্দের আনাচেকানাচে ঘুরে, ক্ষমতাসীন বিজেপি বা বিরোধী কংগ্রেসের রাজনীতিকদের সঙ্গে একান্তে কথাবার্তা বলে বা সরকারি নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সুযোগ পেয়ে শেষ পর্যন্ত যে ছবিটা উঠে এল তা যেমন ইন্টারেস্টিং, তেমনই বোধহয় ‘থট-প্রভোকিং’। মানে তাতে নানা আকর্ষণীয় দিক যেমন আছে, তেমনি নতুন ভাবনার খোরাকও আছে যথেষ্ট! ১১ নম্বর অশোকা রোডে বিজেপি’র সদর দফতরে গিয়েও দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, প্রতিবেশী বাংলাদেশকে নিয়ে তারা ইদানিং খুব সিরিয়াসলি ভাবছেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ডায়নামিক্স, সেখানে ইসলামপন্থীদের প্রভাব বা জঙ্গী গোষ্ঠীগুলির বাড়বাড়ন্ত- এর সবই যে সীমান্তের অন্য পারেও ছায়া ফেলে বা ফেলছে সেটা তারাও ক্রমশ আরও বেশি করে অনুধাবন করছেন এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপও নিচ্ছেন।

ভারতে রাষ্ট্রপতি ভবনে

মানুষের এখন যেগুলো তাজা প্রশ্ন, সেগুলো নিয়ে ভারতে ক্ষমতাসীন দল বা সরকারি নীতিনির্ধারকদের চিন্তাভাবনা কী? আমি যেভাবে জবাবগুলো পেয়েছি, সেই উত্তরগুলো বরং সংক্ষেপে সাজিয়ে দিই!

১) শিগগিরই বাংলাদেশে নাকি নির্বাচন হতে পারে? এর জন্য নাকি পশ্চিমা চাপও আছে? তাতে ভারতের ভূমিকা কী হবে?

এর উত্তরটা লেখার প্রথমেই দিয়েছি। ভারত মনে করে, শেখ হাসিনা সরকারের পুরো পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে দেওয়া উচিত। ভারতের মত, ২০১৪’র ৫ জানুয়ারি একটা আদর্শ নির্বাচন হয়নি, মেনে নিয়েও বলতে হবে ওই নির্বাচনকে কিছুতেই অসাংবিধানিক বলা যাবে না। আর তা ছাড়া এখন বাংলাদেশে একটা স্থিতিশীলতা আছে, রাজনৈতিক সহিংসতাও কমেছে–সর্বোপরি ঢাকার ক্ষমতায় আছে ভারতের একটি বন্ধু সরকার। বিজেপি নেতাদের কথায় যারা ‘ট্রায়েড ও টেস্টেড’, বন্ধুত্বের পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ! ২০১৯-এ নির্ধারিত সময়ে নির্বাচনের আগে তাদের অযথা ঝামেলায় ফেলে বাংলাদেশে অস্থিরতা বাড়ানোর কোনও কারণই দেখছে না দিল্লি। তা সে আমেরিকা বা ব্রিটেন যা-ই বলুক না কেন!

ভারতের রাষ্ট্রপতির প্রেস সেক্রেটারি ভেনু রাজামনির সঙ্গে

২) অদূর ভবিষ্যতে তিস্তা চুক্তি সম্পাদনের সম্ভাবনা কতটা?
সোজা উত্তর, ২০১৬ তে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের আগে তিস্তা চুক্তি নিয়ে কোনও অগ্রগতির আশা নেই। দিল্লি মোটামুটি হাল ছেড়ে দিয়েছে, এক্ষুনি তিস্তা নিয়ে আর কিছু করা যাবে না।

আর এর কারণটাও সুবিদিত, সেটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য নির্বাচনের আগে রাজ্যবাসীর স্বার্থ বিকিয়ে তিনি কোনও আন্তর্জাতিক চুক্তিতে রাজি হয়েছেন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এমন কোনও বার্তা দিতে একেবারেই রাজি নন। সেটা দিল্লির সরকারও খুব ভালোভাবেই বুঝে গেছে। আর বিগত মনমোহন সিং সরকার যেভাবে পশ্চিমবঙ্গকে পাশ কাটিয়েই বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি সেরে ফেলতে চেয়েছিল, বিজেপি সরকার সেই ভুল কিছুতেই করবে না।
অগত্যা এখন অপেক্ষা ২০১৬’র নির্বাচনের জন্য; যে ভোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস হাসতে হাসতে জিতবে বলেই দিল্লি এখন ধরে নিয়েছে। আর তারপর নতুন করে মানুষের ম্যান্ডেট পাওয়া মুখ্যমন্ত্রী হয়তো তিস্তা নিয়েও উদার মনোভাবের পরিচয় দেবেন, আপাতত তিস্তা নিয়ে এটুকুই স্বপ্ন দেখছে দিল্লি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের দেশে আওয়ামী লীগ সরকারেরও তাতে বোধহয় খুব আপত্তি নেই, কারণ তিস্তা চুক্তিতে ২০১৯-র নির্ধারিত ভোটের ঠিক আগে আগে হলেই তো তাদের ভালো!

রাষ্ট্রপতি ভবনে মহাত্মা গান্ধীর ভাস্কর্যের সামনে

৩) ভারতে বিজেপি’র সঙ্গে বাংলাদেশে বিএনপি’র নাকি তলায় তলায় একটা বোঝাপড়া চলছে?
দিল্লিতে বিজেপি নেতারা সরাসরি অস্বীকার করবেন যে কোনও ধরনের বোঝাপড়া-র কথা। তবে যোগাযোগ বা সম্পর্ক যে একটা তৈরি হয়েছে তাতে কোনও ভুল নেই। বিজেপি-র এক শীর্ষস্থানীয় মন্ত্রীর কথায়,‘ভারতের ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশের একটা বিরোধী দলের যে সম্পর্ক থাকা উচিত, আমাদের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কও তাই। এর বেশিও নয়, কমও নয়।’
আসলে এর আগের কংগ্রেস আমলে বিএনপি’র সঙ্গে ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্টের সম্পর্ক কার্যত ধুয়েমুছে গিয়েছিল। এর একটা কারণ হতে পারে কংগ্রেসের ফার্স্ট ফ্যামিলি বা গান্ধী পরিবারের সঙ্গে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা। নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গেও শেখ হাসিনার চমৎকার সমীকরণ তৈরি হয়েছে গত সোয়া বছরে, কিন্তু বিজেপি মনে করে বাংলাদেশে বিরোধী দলের সঙ্গে সম্পর্ক একেবারে মুছে দেওয়াটা কোনও কাজের কথা নয়। সে কারণেই বিজেপির পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত দুতিনজন নিয়ম করে বিএনপি’র কয়েকজন বাছাই করা নেতার সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেন।
‘দেখুন, বিএনপি যে একদিন আবার বাংলাদেশের ক্ষমতায় ফিরতে পারে সেই বাস্তবতাটা আমাদের ভুললে চলবে না। তাই সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখলে চলবে না। আর তা ছাড়া আমরা যে চাইছি বিএনপি জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ুক, সেই চেষ্টাটাও তো আমাদের চালাতে হবে বিএনপি’র সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেই’, বলছিলেন বিজেপির শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতা।
কিন্তু অমিত শাহ আর খালেদা জিয়ার কথিত টেলিফোন-আলাপের প্রসঙ্গটা তুলুন, সঙ্গে সঙ্গে বিজেপির নেতারা তুমুল তর্ক তুলে বলবেন, একদম বাজে কথা! ওরকম কোনও কথাই হয়নি!
আসলে এই ২০১৫’র ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের মধ্যেও কিছু অস্বস্তি, কিছু সন্দেহ বা কিছু আড়ষ্টতার উপাদান কিন্তু রয়েই গেছে। সে প্রসঙ্গ তোলা থাক দিল্লি দরবারের পরের পর্বের জন্য!

লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, বাংলা ট্রিবিউন

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ