X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

এই লেখাটির কোনও শিরোনাম নেই

আমীন আল রশীদ
০৪ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৬:০৫আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৬:৫৪

আমীন আল রশীদ নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে কান ধরে ওঠবোস করানোর ছবি ফেসবুকে দেখে কেঁদেছিলাম। কারণ আমার বাবাও একজন শিক্ষক। ফলে শ্যামল কান্তির পক্ষে ঢাকায় যেসব সভা-সমাবেশ ও বিক্ষোভ হতো, সেসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করতাম।
শ্যামল কান্তি অধ্যায়ের আপাতত সমাপ্তি ঘটেছে। দেশের মানুষ এবং আদালত তার পক্ষে ছিলেন বলে চাকরিটা ফিরে পেয়েছেন। যদিও তাকে কান ধরে ওঠবোস করানোর নায়ক সেলিম ওসমানদের কিছুই হয়নি। সম্ভবত হবেও না। এরপরও এটুকু সান্ত্বনা যে, শ্যামল কান্তিকে অন্তত অপমানে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করতে হয়নি বা ‘মালাউনের বাচ্চা’ গালি শুনে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়নি। কিছুটা ন্যায়বিচার অন্তত তিনি পেয়েছেন।
কিন্তু শ্যামল কান্তিকে কান ধরে ওঠবোস করানোর এই দৃশ্য আমাদের দৃশ্যপট থেকে দৃশ্যান্তর না হতেই নতুন দৃশ্যের আবির্ভাব ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়ায়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যাচ্ছে, পুলিশ ফুলবাড়ীয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পেটাচ্ছে। সেই পিটুনিতে আবুল কালাম আজাদ নামে এক শিক্ষক নিহত হয়েছেন। কলেজের একজন শিক্ষক সাংবাদিকদের বলেছেন, অফিস কক্ষে ঢুকে পুলিশ গরুর মতো শিক্ষকদের পেটানো শুরু করে। পুলিশের লাঠিচার্জেই শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ মারা গেছেন। কথায় আছে- ‘গরুকে মানুষ করার জন্য’ অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের শিক্ষকের কাছে পাঠান। কিন্তু ফুলবাড়ীয়ায় সেই শিক্ষকদেরই পেটানো হলো গরুর মতো। এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে!
কান ধরে ওঠবোস করানো, শিক্ষককে প্রকাশ্যে জুতাপেটা করা, মারধর করা—এসব এখন গণমাধ্যমের সাদামাটা শিরোনাম; সড়ক দুর্ঘটনায় দু’জন নিহতের মতো। খবরের ভাষায় আমরা বলি, ‘কোনও সেনসেশন নেই’। কিন্তু প্রকাশ্য দিবালোকে ক্যাম্পাসে ঢুকে পুলিশ আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গরুর মতো পেটাবে এবং তাতে একজন শিক্ষক ও একজন পথচারী নিহত হবেন—সম্ভবত এই দৃশ্যের জন্ম দেওয়ার জন্য ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি।


যে দেশে একজন পুলিশ কনস্টেবল বা এএসআই অথবা এসআইস কিংবা ওসি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী একজন শিক্ষককে বেধড়ক লাঠিপেটা করতে পারে—সেই দেশ অবকাঠামোয় যত চকচকে দৃশ্যের অবতারণা করুক না কেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যত বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাক না কেন—সেই দেশের অভ্যন্তরে, সেই দেশের রাষ্ট্রযন্ত্রে, সেই রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রশাসনের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে যে ভীষণ বিষ এখনও ক্রীয়াশীল—তা চোখ বন্ধ করলেই আমরা দেখি। আপনিও দেখতে পাবেন।
যে শিক্ষকের কাছে প্রথম পাঠ, অ-আ শেখা, স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জন বর্ণ, দুই দ্বিগুণে চার শেখা—সেই শিক্ষকের শরীরে আঘাত করার আগে যদি কোনও বাহিনীর কোনও সদস্যের হাত না কাঁপে—তাহলে সেই বাহিনী নাগরিককে কী নিরাপত্তা দেবে? সেই প্রশ্ন তোলার সময় হয়েছে।

২.
গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, ফুলবাড়ীয়া কলেজ সরকারিকরণের দাবিতে ২৭ নভেম্বর রাস্তায় নামেন ছাত্র-শিক্ষকরা। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে বিক্ষোভকারীরা মিছিল বের করতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। এমনকি কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। এর প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা ফুলবাড়ীয়া- ময়মনসিংহ সড়ক ব্যারিকেড দেওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাঁধে।
কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ইমাম হোসেন সাংবাদিকদের জানান, কলেজে অফিস রুমে ঢুকে পুলিশ শিক্ষকদের ওপর বেধড়ক লাঠি পেটা করে। এ সময় আবুল কালাম আজাদ নামের সহকারী অধ্যাপক সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। তাকে ময়মনসিংহের চুরখাই কমিউনিটি বেজড মেডিক্যাল হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পুলিশের লাঠিচার্জ ও রাবার বুলেটে শিক্ষক শিক্ষার্থীসহ আহত হন কমপক্ষে অর্ধশত। নিহত হন ছফর আলী নামে এক পথচারী।
প্রশ্ন হলো, কলেজ জাতীয়করণের দাবিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি রাস্তায় একটা বিক্ষোভ মিছিল করেন এবং যদি তারা নাশকতামূলক কাজ যেমন গাড়ি ভাঙচুর বা পুলিশকে লক্ষ করে ইট-পাটকেল না ছোড়েন; জানমালের ক্ষতি না করেন—তাহলে পুলিশের কী ক্ষতি হতো?
এখন বিষয়টা এ রকম দাঁড়িয়ে গেছে যে, পুলিশ যেকোনও মিছিল বা সমাবেশ দেখলেই সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটি যেকোনও উপায়ে দমনের চেষ্টা করে। এটি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত নাকি পুলিশ নিজেদের করিৎকর্মা প্রমাণের জন্য স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এসব করে—সেটি খতিয়ে দেখা দরকার।
একটি এলাকার কলেজ জাতীয়করণের দাবিতে যদি শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেন, তাহলে তাতে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে পুলিশের বরং সহায়তা করা উচিত। যেমন তারা যদি জেলা প্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বা অন্য কাউকে স্মারকলিপি দিতে যায়, তাহলে পুলিশের উচিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু ফুলবাড়ীয়ায় কী এমন হলো যে ক্যাম্পাসে ঢুকে পুলিশকে মাস্তানি করতে হলো?
ফুলবাড়ীয়ায় যদি আরও তিনটি কলেজ জাতীয়করণ হয়, তাতে পুলিশের কী সমস্যা? শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আগ বাড়িয়ে পুলিশকে লক্ষ করে ইট-পাটকেল ছুড়েছে বা নাশকতা করেছে—এমন কোনও খবর আমরা স্থানীয়ভাবে জানতে পারিনি। সংবাদমাধ্যমেও আসেনি। তাহলে পুলিশ কার নির্দেশে ওই ন্যাক্কারজনক হামলা চালালো? ক্যাম্পাসে এমনকি অফিস কক্ষে ঢোকার সাহস পুলিশ কোথায় পেলো? স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কী করেছেন?
ফুলবাড়ীয়া থানার ওসি দাবি করেছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ তথা জনগণের জানমালের নিরাপত্তায় যতটুকু শক্তি প্রয়োগ না করলেই নয়, তারা ততটুকুই প্রয়োগ করেছেন। কী ভয়াবহ ব্যাপার! এই সামান্য শক্তি প্রয়োগেই একজন শিক্ষক এবং একজন পথচারীর প্রাণ গেলো। আরেকটু বেশি প্রয়োগ করলে কতজন মরতো রে বাবা!
স্থানীয়রা পুলিশের ওই হামলার পেছনে স্থানীয় সংসদ সদস্য মোসলেমউদ্দিন এবং তার ছেলের ইন্ধন/উস্কানি রয়েছে বলে অভিযোগ করলেও এমপি বলছেন, ঘটনার দিন তিনি এলাকায় ছিলেন না। অবশ্য গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে পুলিশের গুলিতে তিনজন সাঁওতাল নিহত হওয়ার পরও ভুক্তভোগীরা এজন্য স্থানীয় এমপিকে দায়ী করলেও, তিনিও সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ঘটনার দিন তিনি এলাকায় ছিলেন না। প্রশাসনকে কোনও বিষয়ে নির্দেশ দিতে হলে যে এমপিদের এলাকায় থাকতেই হয়, তা অবশ্য আমাদের জানা নেই।
তবে এসব প্রশ্নর উত্তর আমাদের জানতে হবে। কারণ এটা পুলিশি রাষ্ট্র নয়। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে পুলিশের পিটুনিতে শিক্ষকের মৃত্যুর জন্য নয়। এই ঘটনার অবশ্যই সঠিক তদন্ত হতে হবে। ন্যায়বিচার হতে হবে।
লেখক: যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর

 

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিজিএপিএমইএ’র নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা, শাহরিয়ার নতুন প্যানেল নেতা
বিজিএপিএমইএ’র নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা, শাহরিয়ার নতুন প্যানেল নেতা
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত
২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেট্রোরেল লাইনের ওপর থেকে ক্যাবল সরানোর অনুরোধ
২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেট্রোরেল লাইনের ওপর থেকে ক্যাবল সরানোর অনুরোধ
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অসন্তোষ জানালেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অসন্তোষ জানালেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ