X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

শেখ হাসিনার নেতৃত্ব

চিররঞ্জন সরকার
০৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৭:৩১আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৭:৩৬

চিররঞ্জন সরকার পুরাণে ও কবিতায় স্বর্ণযুগের কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু ইতিহাসে ‘স্বর্ণযুগ’ বলে কিছু হয় না, হয়নি কখনও। ভালো আর খারাপ, ‘সুদিন বা শুভদিন’ আর ‘খারাপ দিন’ হাত ধরাধরি করেই চিরকাল হাঁটে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের জীবনে সুদিনের প্রত্যাশা কখনও পূরণ হয়নি। আর সেই আশাভঙ্গের দায় গিয়ে পড়ে সরকার প্রধানের ওপর, প্রধানমন্ত্রীর ওপর। অবশ্য এর কারণও আছে। আমাদের দেশের শাসনব্যবস্থায় এখন প্রধানমন্ত্রীই সর্বেসর্বা। তার নির্দেশে দেশ চলে, সব নীতি নির্ধারণ করা হয়। দেশের মানুষের সামান্য দুর্ভোগের জন্য তাই তাকেই দায়ী করা হয়। সেটা এক দিক থেকে স্বাভাবিক। প্রশ্ন হলো, প্রধানমন্ত্রী কি পারছেন সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে? মানুষের চাওয়া-পাওয়া মেটাতে?
দেশের তিন যুগের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এ কথা বলা যায় যে, আমাদের দেশের সফলতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি নেতৃত্বের হাল ধরার পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করে আবার বিরাট গণভিত্তি দিয়েছেন। তিনি সফল রাজনৈতিক আন্দোলন যেমন পরিচালনা করছেন, তেমনি নৈরাজ্যজনক আন্দোলনও সফলভাবে দমন করেছেন। তিন তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া, দেশকে নেতৃত্ব দেওয়া, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের মতো সাহসী ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করা, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দুঃসাহসী সব পদক্ষেপ নেওয়া, বিএনপি-জামায়াত-হেফাজতসৃষ্ট সব ধরনের নৈরাজ্য ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা, আমেরিকা ও বিশ্বব্যাংককে ঘোল খাওয়ানো—এসব কাজ করে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনন্য অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় তার বিকল্প কিছু আপাতত ভাবা যাচ্ছে না। এটাই শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় সাফল্য। অবশ্য এটা দুর্বলতাও বটে। একজন মানুষ যখন অবিকল্প হয়ে যায়, তখন বিকল্পের শূন্যতার হাহাকার বড় বেশি বাজে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্ব নিয়ে সংবাদমাধ্যমে তথা সমাজে এই ধারণা তৈরি হয়েছে যে, এই সরকারের ক্ষমতা বড় বেশি কেন্দ্রীভূত। এ সরকার যেন ওয়ান ম্যান শো। এর একটা সামাজিক কারণ আছে। শক্তিশালী নেতৃত্ব সম্পর্কে আমাদের এক অদ্ভুত পৌরাণিক ধারণা আছে। শক্তিশালী নেতা হলেন তিনিই, যিনি কঠিন ও কঠোর, যিনি জনমতের পরোয়া না করে বলিষ্ঠ নির্দেশ দিতে পারেন, প্রয়োজনে কিছুটা স্বৈরতন্ত্রী হতে পারেন। শেখ হাসিনার মধ্যে দেশের অনেক মানুষ এমন একজন নেত্রীকে খুঁজে পেয়েছেন, তিনি নিজে ও তার সহযোগী ও প্রচারকরাও এই ধারণাটাতে নানাভাবে ইন্ধন জুগিয়েছেন। ফলে আজ যখন সরকারের কাজকর্ম নিয়ে হতাশা বা অসন্তোষ তৈরি হয়েছে, তখন তার নিশানাও প্রধানত ওই একজনের দিকেই নির্দিষ্ট হচ্ছে। এটাই শক্তিমান নেতৃত্বের সমস্যা।
কিন্তু কিভাবে তৈরি হয়েছে এই অতিরিক্ত শক্তিমান নেতৃত্বের ভাবমূর্তিটি? সেটাও এই পরিপ্রেক্ষিতে বড় প্রশ্ন। একটা কথা বলে রাখা দরকার। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর শেখ হাসিনা দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থে অনেক কিছুই করেছেন। তিনি নিজে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় আঠারো কাজ করতে পারেন, এগুলো বাস্তব সত্য। সমস্যাটা অন্য জায়গায়। একজন স্বাভাবিক জননেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা কতটা সার্থক হয়ে উঠতে পারছেন, কতটা যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে পারছেন—প্রশ্ন তা নিয়েই। এমন একটি সমস্যাসংকুল দেশে বাস্তবের মোকাবিলা করা একক নেতৃত্বের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন, ঝুঁকিপূর্ণও। বাংলাদেশের মতো দেশে নেতৃত্বের স্বতঃস্ফূর্ততা বড় বেশি জরুরি। মানুষের মনে নেতার মূর্তি গড়ে উঠবে একটা স্বাভাবিক, ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায়, তবেই সেটা যথার্থ হবে। কিন্তু শেখ হাসিনার ভাবমূর্তির ক্ষেত্রে সেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটার অভাব লক্ষ করা গেছে। একক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, অনেক ক্ষেত্রেই বিরোধী মতকে তোয়াক্কা না করা, যে কোনও ধরনের সমালোচনায় ক্ষুব্ধ হওয়া, দেশের নাগরিকসমাজের অভিমতকে আগ্রাহ্য করা, যেকোনও মূল্যে নিজেদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জেদি অবস্থান তাকে অনেক বেশি সমালোচিত করে তুলছে। শক্তিশালী নেতৃত্ব ও শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন করতে গিয়ে সরকারের আচরণে বারবার প্রতিভাত হয়েছে এক ধরনের অহঙ্কার, এক ধরনের তাসের দেশের অনুশাসন। ভাবটা এই রকম যে, হে দেশবাসী, আমি জানি কিসে আপনাদের ভালো হবে, তাই আমার কথা শুনে চলুন। অনেকে অনেক সময় এই ভাষণে একটা শাসনের সুর শুনতে পেয়েছেন, এমনকি কখনও বা ধমকেরও। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে চীনা তাওবাদের একটি লাইন: তুমি যদি অহঙ্কারী হও, সবাইকে ধমকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাও, তা হলে এ পৃথিবী তোমার সঙ্গে পাল্টা সংঘাতে যাবে। আর যদি তুমি নিরহঙ্কার বিনয়ী হও, তা হলে সমগ্র পৃথিবী তোমার সামনে নতজানু হবে।

স্বতঃস্ফূর্ত নেতৃত্বের সাফল্য সেখানেই, যেখানে শাসক জনমতকে শ্রদ্ধা করেন, ওপর থেকে নিচে কিছু চাপিয়ে না দিয়ে, নিচ থেকে ওপরে উঠে আসে ক্ষমতার স্রোত। তা কি আছে শেখ হাসিনার বাংলাদেশে? আরেকটু গণতান্ত্রিক ধারায় কি দেশ শাসন করা যেত না? রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে, সাঁওতাল পল্লি উচ্ছেদে কিংবা নারায়ণগঞ্জের ত্বকি বা কুমিল্লার তনু হত্যাণ্ডের ঘটনায় সরকারের ভূমিকা কি আরেকটু সদর্থক হতে পারত না?

একটা ভয় আর কৃত্রিম প্রচারের সমারোহ চলছে যেন। ভয় এবং দাপটকে পুঁজি করে কৃত্রিমভাবে সরকারি প্রচারের ঢক্কানিনাদে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাও সমাজে তৈরি করে এক ভার্চুয়াল রিয়ালিটি। আসলে আপনি কী, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আপনি কিভাবে প্রতিভাত। এই নির্মিত নেতৃত্বই কি শেষ কথা বলবে? গোটা পৃথিবী এখন এক ভার্চুয়াল রিয়ালিটির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত। বাংলাদেশের নাগরিকদের অভিজ্ঞতাতেও এ জিনিস একেবারে নতুন নয়। যখনই যে দল শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, তারাই বিজ্ঞাপনে মুখ ঢাকতে তৎপর হয়ে ওঠে। তার পর যখন ঝড় থামে, তখন মানুষ দেখে জামা বদলায়, রাজা বদলায় না। কিন্তু এখন এই জমানায় সেই ‘প্রতিমা-নির্মাণ’ যেন একটা নতুন মাত্রা নিয়েছে। ঢাকঢোলের আওয়াজ থামিয়ে সরকারকে এবার নিজের দিকে তাকানো দরকার, দরকার আত্মসংযম, কারণ সংযত না হলে আত্মসমীক্ষা করা যায় না।

প্লেটোর গণরাজ্যে টেম্পারেন্স বা মিতাচার নিয়ে সবিস্তার আলোচনা আছে। রাষ্ট্রের মিতাচার কেন প্রয়োজন? প্লেটো বলছেন, মিতাচারের মাধ্যমেই ন্যায় প্রতিষ্ঠা হতে পারে। মিতাচার হলো আত্মনিয়ন্ত্রণ। প্লেটোর গণরাজ্যে রাজাকেও আত্মনিয়ন্ত্রণে অভ্যস্ত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। শেখ হাসিনার সরকারকেও বুঝতে হবে যে, ভোটারবিহীন নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিরোধী দলের দুর্বলতার কারণে নিরুপদ্রবে ক্ষমতায় টিকে থাকাই শেষ কথা নয়, আগামী দিনে মানুষ তাদের প্রশাসনিক কাজের মূল্যায়নও করবে।

আর সেই কাজে সফল হওয়ার জন্য প্রয়োজন এক স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্ত, অকৃত্রিম নেতৃত্বের, সম্রাট অশোক থেকে আকবর, কিংবা বঙ্গবন্ধু যে নেতৃত্বের দীর্ঘ ঐতিহ্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ছিল ও আছে, তার বদলে কৃত্রিম, প্রচার-নির্মিত নেতৃত্ব যদি একমুখী ও একদেশদর্শী দর্শনে মোড়া এক তাসের দেশের প্রশাসন তৈরি করতে চায়, তা হলে ক্ষতি হবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের, ক্ষতি হবে সেই নেতৃত্বেরও। তাই কোনও কৃত্রিম সিন্থেটিক ভাবমূর্তি নয়, চাই শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো স্বাভাবিক-স্বতঃস্ফূর্ত জনকল্যাণকামী এক নেতৃত্ব। যে নেতৃত্ব যা ঘোষণা করছেন, মানুষ তা এক আন্দোলনের মতো তাকে বাস্তবায়ন করবে। সে দিনই এক নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের চেষ্টার কাজ শুরু হতে পারে।

জনপ্রিয়তা, সংখ্যাগরিষ্ঠতা, কিংবা কোনও রকম প্রতিরোধহীন ক্ষমতায় কাটানোটাই শেষ কথা নয়। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, শেখ হাসিনা শক্তিশালী, সফল নেতা নন। নানা ষড়যন্ত্র, সীমাবদ্ধতার পরও তার চনমনে অতি-সক্রিয়তা প্রশংসনীয়, আন্তরিক ইচ্ছাও আছে এ দেশের উন্নয়নের অভিমুখ বদলানোর। প্রশ্ন হচ্ছে, একার পক্ষে তা কি সম্ভব? যদি কোনও দৈবদুর্বিপাক ঘটে তখনই বা কী হবে?

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
আশরাফুলের হ্যাটট্রিকে আবাহনীর টানা ৮ জয়
আশরাফুলের হ্যাটট্রিকে আবাহনীর টানা ৮ জয়
ভিকারুননিসায় জালিয়াতি করে আরও ৩৬ ছাত্রী ভর্তির তথ্য ফাঁস
ভিকারুননিসায় জালিয়াতি করে আরও ৩৬ ছাত্রী ভর্তির তথ্য ফাঁস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ