X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

গুম বলে কোনও শব্দ নেই

রুমীন ফারহানা
০৭ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৩:১২আপডেট : ০৭ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৬:৪৮

রুমীন ফারহানা ‘গুম বলে কোন শব্দ নেই। গুম বলে আমাদের কোনও কিছু জানা নেই। যারা গুম রয়েছেন বলে অভিযোগ করা হচ্ছে, তাঁরা বিভিন্ন কারণে আত্মগোপনে রয়েছেন।’ বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। বেশ ভালো বলেছেন। মন্ত্রী, এমপি'রা হরেক রকম কথা বলেন। জেনে বলেন, না জেনে বলেন, বুঝে বলেন, না বুঝে বলেন, নিজ গদি সামলাতে বলেন, তেল মারতে বলেন, মুখ ফসকে বলেন, বেফাঁস বলেন, বিরামহীনভাবে বলেন। জনগণ বিশ্বাস করলো কী করলো না, কে কী ভাবলো তা নিয়ে সময় নষ্ট করতে তাদের বয়েই গেছে। আমরা শুনি, শুনে যাওয়াই যেহেতু আমাদের কাজ, কখনও ব্যাপক বিনোদন পাই, কখনো রাগ করি কিন্তু বিস্মিত হই না বহুদিন। এসব বিষয়ে আমাদের বিস্ময়বোধ নষ্ট হয়ে গেছে অনেক আগেই। রানা প্লাজা বিরোধীদল ঝাঁকি দিয়ে ফেলে দিয়েছে এমন বক্তব্যও তো আমরা শুনেছি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে। যাই হোক গুম বিষয়ে মন্ত্রীর এই বক্তব্য ছাপা হবার পর আমি বাংলা ট্রিবিউনে পাঠকদের মন্তব্য দেখছিলাম। মন্ত্রী মহোদয়রা ব্যস্ত মানুষ, আমজনতা তাদের নিয়ে কী ভাবলো বা বললো তা দেখার সময় তাদের নেই। আমজনতার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার দিকে একটু তাকানোর সময় পেলে এ ধরনের রসিকতা করার আগে দশবার অন্তত ভাবতেন, আমি নিশ্চিত।
যাই হোক, এবার কাজের কথায় আসি। মন্ত্রী বললেন 'গুম বলে কোনও শব্দ নেই'। ভালো কথা। কিন্তু কোথায় নেই? অভিধানে নেই নাকি বাস্তবে নেই? সংসদ বাঙ্গালা অভিধান ঘেঁটে দেখি শব্দটি আছে এবং এর অর্থ বলা আছে গুপ্ত, অপ্রকাশিত (গুম খুন); নিখোঁজ ( গুম করা বা হওয়া), নির্বাক ও নিশ্চল, স্তম্ভিত (গুম হয়ে থাকা)। অভিধানে থাকার পরও এত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী যখন দাবি করছেন গুম বলে কোনও শব্দ নেই তাহলে নিশ্চয় তিনি বোঝাতে চেয়েছেন গুম বলে বাস্তবে কিছু নেই। এই যে যখন তখন বলা নেই কওয়া নেই এক এক জন নাই হয়ে যান তারা নিশ্চয় ইচ্ছে করে হারিয়ে যান। মন্ত্রীর ভাষায় ‘আত্মগোপনে’ যায়। কেউ হাওয়া খেতে, কেউ একটু বেরিয়ে আসতে, কেউ বা পরিবার পরিজনদের সঙ্গে নিছক মজা করতে দুষ্টুমি করে লুকিয়ে যায়। ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম, হিরু, হুমায়ন কবীর পারভেজ, সাজেদুল ইসলাম, মাহবুব হাসান, মাজহারুল ইসলাম, আদনান চৌধুরী, পারভেজ হোসেনসহ প্রায় হাজার খানেক মানুষ এখন আত্মগোপনে আছেন। রসিকতা কত নির্মম, নিষ্ঠুর আর কুৎসিত হতে পারে এটা এদেশের ক্ষমতাসীনরা মাঝে মধ্যেই জনগণকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে ছাড়েন।
আমার দুর্ভাগ্য যে এমন ভাবেই আত্মগোপনে যাওয়া এক ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আমি বাস করছি গত তিন বছর ধরে। যে এ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের চার তলায় আমি থাকি উনার পরিবার থাকেন সাত তলায়। গুম হওয়া এই ব্যক্তির নাম হুমায়ুন কবীর পারভেজ। তার পরিবারের ভাষ্যমতে, ২০১৩ সালের ২৭শে নভেম্বর লাকসাম পৌর বিএনপি'র সভাপতি হুমায়ুন কবীর পারভেজ ও থানা বিএনপি'র সভাপতি, সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম হিরু লাকসাম থেকে ঢাকা আসার পথে নিখোঁজ হন। রাত আনুমানিক সাডে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে আলীশ্বর থেকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় তাদের। সঙ্গে জসিম নামের আরেক সাবেক কর্মী ছিল বিএনপি'র। তাকে ঐদিনই রাতে থানার সোপর্দ করে র‌্যাব এবং এক মাস পর তিনি জামিনে মুক্তিলাভ করেন। এখানে বিএনপি'র সাবেক কর্মী বলছি এই কারণে যে তিনি পরবর্তীতে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে প্রাণে রক্ষা পান। পরবর্তীতে বার বার র‌্যাব এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও পুরো বিষয়টিকেই অস্বীকার করে র‌্যাব। আজ অবধি পরিবারটি তার অপেক্ষায় আছে।
খুব কাছে থেকে দেখা বলেই বলছি গুমের থেকে মৃত্যু ভাল। প্রতিমূহুর্ত অপেক্ষা করে পরিবারটি। এই বুঝি ফিরে এলো হারিয়ে যাওয়া মানুষটা। এই অপেক্ষার প্রহর গোনা চলে আমৃত্যু। প্রতিটা কড়া নাড়ায় আশায় কেঁপে ওঠে আর প্রতিবার সেই আশার মৃত্যু ঘটে। এ কষ্ট মৃত্যু যন্ত্রণা থেকে অনেক বেশি, এই কষ্ট তিলে তিলে একটি পরিবারকে মেরে ফেলে। এই মৃত্যু চোখে দেখা যায় না, এই মৃত্যুর কষ্ট শুধুমাত্র ঐ পরিবারটিই জানে।
গুমের শিকার পরিবারটি একবার আমাকে প্রশ্ন করেছিল গুম হওয়া মানুষের পরিবারের জন্য আইন করা যায় না? কারণ, গুম হওয়া ব্যক্তিটি ছিলেন পরিবারের কর্তা। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ব্যবসাসহ জমি, বাড়ি সব তার নামে। ফলে ব্যাংকে যথেষ্ট পরিমাণ টাকা থাকা সত্ত্বেও তা তুলতে পারছে না পরিবারটি। জমিও বিক্রি সম্ভব নয়, কারণ যেহেতু তিনি জীবিত না মৃত কেউ জানে না তাই ওয়ারিশদের মধ্যে এই জমি ভাগ করাও যাচ্ছে না। পরিবারের বড় ছেলেটিকে পড়া বাদ দিয়ে নামতে হয়েছে জীবিকার সন্ধানে। পাওনাদারদের তাগাদায় অস্থির ভদ্রলোকের অসহায় স্ত্রী। এদের মধ্যে কতজন সত্যিকার পাওনাদার তাও নিশ্চিত নন তিনি। একদিকে অসহায় আকুল প্রতীক্ষা অন্যদিকে কঠিন জীবন সংগ্রাম। আর মন্ত্রী বলেন তারা আত্মগোপনে রয়েছেন। কী নির্মম রসিকতা, যা কেবল মসনদে বসলেই করা যায়।
প্রতি মাসে মানবাধিকার সংস্থাগুলো রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাতে খুনের হিসাব থাকে, গুমের হিসাব থাকে, হিসাব থাকে কতজনের পায়ে গুলি করে পঙ্গু করলো পুলিশ, হিসাব থাকে ধর্ষণ, এসিড সন্ত্রাস আর সীমান্তে হত্যার। গুমের শিকার হওয়া পরিবারগুলোর ডাকা সংবাদ সম্মেলনে মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের পরিচালক বলেন, ‘বিগত কয়েক বছরে গুমের শিকারের সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়েছে। গুমের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা দায়মুক্তি ভোগ করছেন। কিন্তু যারা এসব করছেন, তাদের বোঝা উচিত যে বিচার একদিন হবেই।’
আরেক মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান প্রথম আলোকে বলেন ‘পাঁচ ছয় বছর ধরে গুমের ঘটনা অস্বাভাবিক মাত্রা পেয়েছে। এর মধ্যে গুমের শিকার পরিবারগুলো এবং যারা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, তাদের কাছ থেকে একই রকম বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। তাদের যে বর্ণনা, তাতে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে এ ঘটনার সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা আছে। নারায়ণগজ্ঞের সাত খুনের ঘটনা প্রমাণ করে, এ ধরনের গুমের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। রাষ্ট্র এর দায় এড়াতে পারে না।’
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের প্রতিবেদনে বলেছে গুমের ঘটনাগুলো তদন্তের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আর প্রায় সব গুমের ক্ষেত্রেই অভিযোগ উঠেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে। এমন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে হারিয়ে যাওয়া মানুষ যায় কোথায়?
রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, প্রতি মূহুর্তে নিরাপত্তা হরণ করা নয়। যদি ধরেও নেই এইসব গুমের ঘটনার কোনটির সঙ্গেই রাষ্ট্রীয় বাহিনী জড়িত নয় তাহলেও হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো খুঁজে বার করবার দায়িত্ব তাদের। এই দায়িত্ব রাষ্ট্র কিছুতেই এড়াতে পারে না।
লেখক: আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
দক্ষিণখানে ভবনের চার তলা থেকে পড়ে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু
দক্ষিণখানে ভবনের চার তলা থেকে পড়ে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট হলেন ১৯ জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট হলেন ১৯ জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ