X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাল্যবিবাহ আইন ২০১৬ নিয়ে দু’টি কথা

জাহানারা নুরী
১০ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৪:৪০আপডেট : ১০ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৭:১৩

জাহানারা নুরী মন্ত্রিসভা সদ্য খসড়া বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৬ অনুমোদন করেছে। এই আইনে নবতর সংযোজন ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে’ বাল্যবিবাহ বৈধকরণ। তাতে বলা হয়েছে ‘এই আইনের অন্যান্য বিধানে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কোনও বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনো নারীর সর্বোত্তম স্বার্থে আদালতের নির্দেশনাক্রমে এবং মা-বাবার সম্মতিক্রমে বিধি দ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণ ক্রমে বিবাহ সম্পাদিত হইলে, উহা এই আইনের অধীন অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে না।’ বিয়ে প্রথা মেয়েশিশুর সর্বোত্তম কল্যাণ নিশ্চিত করার উপায় হতে পারে না। একটি স্বাধীন দেশে গণতন্ত্র ও তার অধীনস্ত সরকার ব্যবস্থা কায়েম আছে, অথচ সেখানেই নাগরিকের মানবাধিকার দিনে-দুপুরে লোপাট হচ্ছে। তা জায়েজ করতে রাষ্ট্রের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলছেন, ‘আমাদের দেশে তো ১০-১১ বছরেও পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়। এ সমস্যাগুলো তো সমাজে আছে, এ ধরনের বিয়ের বৈধতার জন্য এটা একটা ব্যবস্থা’। মন্ত্রিপরিষদ কি এ কারণেই বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের যে সুরক্ষা আমাদের কন্যারা সামান্য হলেও পেয়ে আসছিলেন- তা বাতিল করলো? পালিয়ে গিয়ে প্রেগন্যান্ট হয়ে যাওয়া ১০-১১ বছরের বালিকাদের সংখ্যা কত, তার কোনও জরিপ মাননীয় সচিবের কাছে আছে কিনা, সে উল্লেখ অবশ্য কোনও পত্রিকায় পেলাম না।

আমাদের পবিত্র শিশুরা বয়স্কদের জীবনযাপন করে। তাদের শৈশব পরিবার ও সমাজের হাতে ছিনতাই হয়ে যায়। এখন রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরা এই ছিনতাই কর্মকে আইনি বৈধতা দিয়েছেন। বিয়ের দায়দায়িত্ব কি বোঝে ১০-১১ বছরের মেয়েশিশু? যৌনতার জটিলতাইবা কতটুকু সে জানে? জানলেও তার অবিকশিত বুদ্ধিতে, দেহে ও মনে তা ধারণ করার সামর্থ্যই বা কতটুকু? না বুঝে যদি সে প্রেগন্যান্ট হয়ে যায় প্রায় সব ক্ষেত্রেই এ সিদ্ধান্ত তার নিজের নয়, তার সঙ্গের পুরুষটিরও এবং প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রে সে পুরুষের বয়স ১০-১১ নয়। সেক্ষেত্রে অসচেতনভাবে নিজ শরীর ব্যবহার হতে দেওয়ার কিংবা মা হওয়ার কাজটিতে মেয়েশিশুর সম্মতি দান ও সিদ্ধান্তগ্রহণের অধিকার থাকে না। পরিস্থিতির ও অজ্ঞান শৈশবের কৌতূহলের শিকার হয় সে। বাল্যমাতৃত্বের সমাধান খুঁজতে হবে- রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের উদার চেতনায়, পরিবার ও সমাজকে সহিষ্ণু আধুনিক জ্ঞান এবং মানবিকতার ভেতর, বিয়েতে নয়। যে বিশেষ প্রেক্ষাপটে ১০ বছরের মেয়েকে মা-বাবা বিয়ে দিতে চান, তা গুটিকয়েক ঘটনামাত্র, জাতীয় সমস্যা নয়; ওই সব বাস্তব প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে ওই মেয়েশিশুকে বিশেষ নিরাপত্তা এবং তার মা-বাবাকে বিশেষ সচেতনতা ও সুবিধা দেওয়াই সঙ্গত। অন্যথায় বিয়ে মেয়ে শিশুটিকে যৌনকর্মে নিয়োগের পথই প্রশস্ত করে মাত্র।


বাংলাদেশ এখন লড়ছে শুধু বাল্যবিবাহ নিয়েই নয়, অল্পবয়সে জন্ম দেওয়া শিশুর অটিজম ও খর্বতা, মায়ের স্বল্পায়ু ইত্যাদি সমস্যা নিয়েও। ভুলে গেলে চলবে না, এ দেশে সন্তান ধারণ ঠেকিয়ে জনসংখ্যা কম রাখার দায়ও নারী ও মেয়েদেরই। এসব সমস্যা সমাধানের পথে না গিয়ে মেয়েদের ১০-১১ বয়সেই ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে’ স্থায়ী যৌন সম্পর্কে ও আরও সন্তানের মা হওয়ার পথে যেতে বাধ্য করা কি ঠিক? শিশুর ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে পারেনি যে দেশ, সে দেশে বাল্যবিবাহ অনুমোদন করে একটি মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক বিধান পাস করা হলো। অথচ বলা হলো, এ আইন নাকি এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ!
আমরা পরিবার পরিকল্পনার বিজ্ঞাপনে দেখতাম- ‘বিশের আগে সন্তান নয়/আঠারোর আগে বিয়ে নয়’। বাল্য বিবাহ নিরোধ প্রচারণা সরকারিভাবে প্রায় দুই দশক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। শিশুদের জন্য অন্যতম আইনটি হচ্ছে শিশু অধিকার অ্যাক্ট ১৯৭৪ এর বাইরে শিশুর আইনি সুরক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জাতিসংঘের শিশু অধিকার চার্টার, রিয়াদ গাইড লাইন এবং হাভানা রুলস ইত্যাদি থেকে গা বাঁচিয়ে চলছে। অন্যপক্ষে সরকারি দলিল দস্তাবেজের শেলফে বেশ সাজিয়ে রাখা আছে মুসলিম পারিবারিক আইন, ডমেস্টিক ভায়োলেন্স (প্রটেকশন অ্যান্ড পিভেনশন) অ্যাক্ট ২০১০, হিউম্যান ট্রাফিকিং অর্ডিন্যান্স ২০১১।
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় নারী ও শিশু পাচারের একটি অন্যতম ‘ট্রানজিট রুট’। দেশের অভ্যন্তরে যৌনকর্মে নিয়োগে ৭-৮ বছরের মেয়েশিশু পাচার নিত্য ঘটনা। এ দেশে কমপক্ষে চারটি নীতি প্রণীত হয়েছে। পাচার বিষয়ক ২০১২-২০১৪ পরিকল্পনা, চাইল্ড রাইটস পলিসি ২০১১, নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ এবং শিশুশ্রম নির্মূলনীতি ২০১০ ইত্যাদি। সিডওতে স্বাক্ষরকারী প্রথম দশটি দেশের একটি হলেও বাংলাদেশ মৌলিক দুটো ধারা এড়িয়ে চলছে। ১৯৭২ এ ছিল দু’জন নারী মন্ত্রী, বর্তমানে রাজনীতিতে নারীর সংখ্যা বেড়েছে। উল্লেখযোগ্য আর্থিক খাতে নারীরা শ্রম দিচ্ছেন, ও আয় করছেন বৈদেশিক মুদ্রা। দেশের উন্নতিতে অবদান রাখতে তারা সহস্র বাধা ডিঙাচ্ছেন।
শেলফের আইন ও মেয়েশিশুর জীবনের বাস্তবতার মাঝে প্রকট বিরোধাভাস; শত প্রচারণার পরও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল এবং আইসিডিডিআরবি’র ২০১৩’র জরিপে দেখা যাচ্ছে, বাল্যবিবাহের সর্বোচ্চ হারযুক্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ অন্যতম। এর অর্থ এত এত আইনি এবং পরিবার পরিকল্পনার টার্গেট পূরণে বালিকাদের বিয়ে না দেওয়ার ব্যাপক প্রশাসনিক চাপ থাকার পরও শিশু নির্যাতন ও মেয়েশিশুর বাল্যবিবাহ বন্ধ হচ্ছে না। জরিপ মতে বর্তমান প্রজন্মে বিবাহিত নারীদের প্রতি তিনজনের দু’জনই আঠারো বছরের আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য হয়েছিলেন। নারী ও শিশুর সুরক্ষায় প্রণীত আইন এবং সেগুলোর বাস্তব প্রয়োগে ফারাক বিস্তর। আমাদের সিস্টেমের অধিকাংশই পিতৃতন্ত্রের মানসিকতার।
দু’টি পরিবার বিবাহের মাধ্যমে দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়ের শরীর বিনিময় ও সন্তান উৎপাদনকে অনুমোদন দেয়। এ সম্পর্ক পুরুষের সন্তানের পরিচয় নিশ্চিত করে এবং তার পরিবারের সম্পত্তির উত্তরাধিকার হিসেবে সে সন্তানকে (মূলত পুরুষ সন্তান) পরিবার ও সমাজে বরণ করে নেওয়া হয়। মূল চিন্তাটি হচ্ছে, মেয়েশিশুর জীবনের লক্ষ্য হবে- স্ত্রী ও মা হওয়া। তার জন্য পুঁজি বিনিয়োগ লাভজনক নয়, তাই মেয়ে শিশুর শারীরিক, মানসিক, চেতনা ও দক্ষতার উন্নয়নে অর্থ খরচে পরিবার অনিহা। মেয়েশিশু স্বামীর ঘরে চলে গেলে তাকে সুরক্ষা দেওয়ার দায় কমে, যদিও পিতৃগৃহের বাইরে মেয়েটি চরম নিরাপত্তাহীনতায় বাস করে। নারী ও মেয়ে শিশুর রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক শোষণমূলক; রাষ্ট্র তাদের না অগণতান্ত্রিক পারিবারিক ব্যবস্থায় সুরক্ষা দেয়, না মুক্ত করে ধর্মভিত্তিক পারিবারিক আইনের বৈষম্য থেকে। সমাজে ধর্ষণ, হত্যা নিত্য ঘটছে। এর জন্য মেয়েকেই দায়ী করে ও নিজেদের সামাজিক হেনস্তা নিয়ে পরিবার বিব্রত থাকে। এমন সমাজে রাষ্ট্রের দায়িত্ব মানবাধিকার প্রশ্নে শিশুর গার্ডিয়ান হওয়া; তাকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায় থেকে রাষ্ট্র ও সরকার হাত ধুয়ে ফেলতে পারে না। সরকারকে দেওয়া জনগণের শক্তিই রাষ্ট্রের মূল শক্তি। প্রজন্ম-যারা জনগণ ও আগামীর শ্রমশক্তি-রাষ্ট্রের নিজেরই স্বার্থে তাদের লালন করবে। দুর্বল গণতন্ত্রে রাষ্ট্র তার হাতে জনতার তুলে দেওয়া ক্ষমতা যখন স্থানীয় ও জাতীয় দুর্নীতিগ্রস্ত অপশক্তিগুলোর সঙ্গে বণ্টন করে নেয়। যার বলে এ সব অপশক্তি দরিদ্র, নারী ও শিশুদের শোষণ ও নিপীড়ন করে, তখন সরকারও তাদের অপরাধগুলোর অংশীদার বৈ কি!
২০১২ তে নারীদের দাবিতে আইন কমিশন বিয়ে, সেপারেশন, ডিভোর্স ইত্যাদি ব্যক্তিগত আইন পর্যালোচনা শেষে কিছু সুপারিশ করেছিল। দেশব্যাপী যে নারীদের যেসব দাবি ছিল সেগুলো ও কমিশনেরও সুপারিশ নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারতো। যেমন, সিডওর ধারা দু’টিতে স্বাক্ষর, বিরাজমান আইনি বৈষম্য বিলোপ, মেয়েদের পৈতৃক ও বৈবাহিক সম্পত্তির সম অধিকার নিশ্চিত করা, বিচারিক প্রক্রিয়া, আদালত ইত্যাদি নারী ও শিশুবান্ধব করা এবং বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে যে বিভৎস দারিদ্র্য নারী ও শিশুকে অপুষ্টি ও মানবেতর জীবনে ঠেলে দেয়, তার সমাধানে এগিয়ে আসা। নারীরা দেশ ও পরিবারকে যে বিপুল শ্রম দেয়, তার বিনিময়ে এটুকু খুব বেশি দাবি কি?
কিন্তু দেখা গেলো অনবরত আমরা একই আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছি। জাতি হিসেবে আমরা যূথ প্যারাডাইম তৈরি করছি না। বরং ব্যক্তির নানা ইচ্ছে, প্রতিযোগিতামূলক ক্ষীণদৃষ্টি, চেতনার কূপমণ্ডুকতা দিয়েই জাতীয় উন্নয়ন দেখছি। আমাদের আইন ও পরিকল্পনা প্রণয়নের মূল প্রণোদনা হলো, আগে যা হয়েছে তা উল্টে দেওয়া। নিজেদের ও প্রজন্মের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে মানবিক মহিমায় সংজ্ঞায়নের দক্ষতা ও সমাজকে মানবাধিকারের নৈতিক উন্নততর মানে উন্নিত করায় আমাদের বেদনাদায়ক সীমাবদ্ধতা ও অনীহা রয়েছে।
সর্বশেষ ২০১৩-তে মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলো নারীবিরোধী ১৩ দফা দাবি নিয়ে রাজপথে নামে। তারপর থেকেই ধর্ষণ, বাল্যবিবাহ, নারী নিপীড়ন ও কিশোরীর আত্মহত্যার খবর বেড়েছে। যেহেতু রাষ্ট্র নারী ও মেয়েশিশু ধর্ষণ ঠেকাতে অপারগ সেহেতু তিন চার বছরের মেয়েশিশুর ধর্ষণও বিয়ের দ্বারা জায়েজ হলে অবাক হব না।
বিশেষ প্রেক্ষাপটে ‘মেয়েশিশু’ বিয়ে দিয়ে পরিবার ও সমাজ অসংখ্য উপায়ে লাভবান হওয়ার লম্বা তালিকা করা যায়, কিন্তু বিষয়টি অরুচিকর। এই তো সেদিনের খবর, কোনও এক পরিবার তার মেয়ে প্রেম করেছে বলে পিটিয়ে মেরে ফেলে ঘরের মেঝেতে পুঁতে রাখে। নারী হত্যার খবর দিয়েই বিশ্বব্যাপী মৌলবাদী রাষ্ট্র পাকিস্তানের পরিচিতি। এই নৃশংসতা বাংলাদেশে শুরু হয়েছে। একটি ছোট্ট আইনের ধারা কিভাবে নারীর অধিকার সুরক্ষায় এ যাবৎ পাওয়া আমাদের সব অর্জনকে মিথ্যে করে দিতে পারে, তারই উদাহরণ এসব ঘটনা। সুতরাং ‘বাল্যবিবাহ আইন ২০১৬’-এর বিশেষ বিধান একটি বড় সমস্যার সূত্রপাত করতে পারে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সিলেটে আবারও শুরু হচ্ছে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম
সিলেটে আবারও শুরু হচ্ছে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম
ভ্রমণ শেষে ভারত থেকে তিন দিনে ফিরলেন ১৫ হাজার পর্যটক
ভ্রমণ শেষে ভারত থেকে তিন দিনে ফিরলেন ১৫ হাজার পর্যটক
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
মার্কেসের 'আনটিল আগস্ট'
মার্কেসের 'আনটিল আগস্ট'
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ