X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

লুই কান বনাম কবরের রাজনীতি

আমীন আল রশীদ
১১ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৬:৩৯আপডেট : ১১ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৭:৩৮

আমীন আল রশীদ জাতীয় সংসদের স্থপতি কে? লুইস ইসাডোর কান বা সংক্ষেপে লুই আই কান। পাঠ্যবইয়ে আমাদের এটি পড়তে হয়েছে। ফলে কৈশোর থেকেই আমরা এই মার্কিন স্থপতির (জন্ম ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯০১, মৃত্যু ১৭ মার্চ, ১৯৭৪) নাম জানি—যার নকশা নিয়ে এখন রাজনীতির মাঠ গরম। যদিও এই তর্ক যতটা না লুই কানের নকশা নিয়ে, তার চেয়ে বেশি সংসদ ভবন এলাকা থেকে জিয়ার কবর সরানো হবে কিনা, তা নিয়ে। কেননা, জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পরে  চট্টগ্রাম থেকে তার ‘মরদেহ’ নিয়ে এসে সংসদ ভবনের উল্টো দিকে সমাহিত করা যেমন ছিল একটি সুদূরপ্রসারী রাজনীতির অংশ, তেমনি এখন এই কবর সরানোর সিদ্ধান্তও যদি সরকার শেষমেষ নেয়, তাহলেও বুঝতে হবে, এটিও রাজনীতির অংশ।
অনেকদিন ধরেই বিএনপির রাজনীতি এই সমাধিকেন্দ্রিক। অর্থাৎ জিয়াউর রহমানের জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী, বিএনপি বা দলের কোনও না কোনও অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অথবা জাতীয় দিবসে এই সমাধিতে ফুল দিতে আসেন নেতাকর্মীরা। স্বভাবতই সেখানে সাংবাদিকরাও হাজির হন। বিষয় যাই হোক, সাংবাদিকরা সমসাময়িক বিষয় নিয়েই নেতাদের প্রশ্ন করেন এবং সেখান থেকে কোনও না কোনও সংবাদ তৈরি হয়। অর্থাৎ সাম্প্রতিক ইস্যুতে বিএনপির অবস্থান বা বক্তব্য দেওয়ার সবচেয়ে ভালো প্ল্যাটফর্ম এখন জিয়ার সমাধি। হিসাব করলে দেখা যাবে, সারাবছর বিএনপির যেসব সংবাদ গণমাধ্যমে আসে, তার অধিকাংশেরই জন্ম এই সমাধিতে। ফলে এখান থেকে যদি জিয়াউর রহমানের সমাধি সত্যি-সত্যিই সরিয়ে নেওয়া হয়, সেটি বিএনপির রাজনীতির জন্য একটা বড় ধাক্কা হতে পারে।
১৯৮১ সালের ৩০ মে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের বিকাশ এবং নানা ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য তার যেমন প্রশংসা রয়েছে, তেমনি একজন বীর-উত্তম হওয়ার পরও স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসন এবং ক্ষমতার বলয়ে নিয়ে আসার কারণে তাকে নিয়ে সমালোচনার পাল্লাও ভারী।

মনে রাখা দরকার, জিয়াউর রহমানের নিহত হওয়ার ৫ বছর আগে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিরারে নিহত হন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিরুদ্ধ রাজনৈতিক স্রোতের কারণে তাকে দাফন করা হয় জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায়। অথচ বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে তার সমাধিটি রাজধানীতেই থাকার কথা ছিল। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসনকারী জিয়াউর রহমানের কবর চট্টগ্রাম থেকে নিয়ে এসে তার জন্মস্থান বগুড়ায় না নিয়ে, সেটি করা হয় দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান জাতীয় সংসদ ভবনের পাশে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী কয়েকজন রাজনীতিবিদকেও কবর দেওয়া হয় এই সংসদ ভবন এলাকায়। অথচ জেলখানায় শহীদ জাতীয় চারনেতাকেও সংসদ ভবন এলাকায় কবর দেওয়া হয়নি। মনে রাখা দরকার, এই ঘটনাগুলো ঘটেছে পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পরে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সংসদ ভবন এলাকায় জিয়া এবং অন্য বিতর্কিত ব্যক্তিদের কবর দেওয়া ছিল ওই সময়ের শাসকগোষ্ঠীর রাজনীতিরই অংশ। কী সেই রাজনীতি—তা বুঝতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বিরুদ্ধ রাজনৈতিক স্রোতের কারণে ওই সময়ে লুই কানের নকশা নিয়ে কেউ আলোচনা করেননি বা সঙ্গত কারণেই কয়েক দশক ধরে বিষয়টি আলোচনায়ও আসেনি।

ইতিহাস বলছে, জিয়াউর রহমানকে প্রথমে কবর দেওয়া হয় চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরা ইউনিয়নে। পরে সেখান থেকে দেহাবশেষ তুলে এনে ২ জুন ঢাকার চন্দ্রিমা উদ্যানে, অর্থাৎ সংসদ ভবনের পেছনের দিকে সমাহিত করা হয়। তখনও জাতীয় সংসদের এই ভবনটি উদ্বোধন হয়নি। কাজ ছিল শেষ পর্যায়ে এবং এই নান্দনিক ভবনের উদ্বোধন হয় জিয়াকে এখানে সমাহিত করার মাস ছয়েক পরে, ১৯৮২ সালের জানুয়ারিতে। ২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার কবরকে কেন্দ্র করে পাঁচ বিঘা জমিতে সমাধি কমপ্লেক্স গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়।

যদিও চট্টগ্রাম থেকে জিয়ার দেহাবশেষ আনা হলেও ওই কফিনে আসলেই জিয়ার দেহাবশেষ ছিল কিনা, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে শুরু থেকেই বিতর্ক ছিল। এছাড়া ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া মরদেহ সমাহিত করায় এ নিয়ে বিতর্ক পিছু ছাড়েনি। জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম একবার ওই কবরে থাকা দেহাবশেষের (যদি এখনও দেহাবশেষ বলে কিছু থাকে) ডিএনএ পরীক্ষার দাবি জানিয়েছিলেন।

জিয়ার কবর সরানোর বিতর্কের শুরু ২০১৪ সালের ১৭ জুন। ওইদিন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সংসদ ভবনের ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি লুই আই কানের নকশা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যদি কবরগুলো সরানোর দরকার হয়, তাহলে সরকার তাই করবে। এরপর এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব তৈরি করে ১৪ জুলাই গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়। সেখানে স্থপতি লুই আই কানের নকশায় শেরেবাংলা নগর এলাকায় কবরস্থানের জন্য কোনও জায়গা রাখা হয়নি উল্লেখ করে জিয়াউর রহমানের কবরসহ জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় অবস্থিত সব ক’টি কবর সরানোর পক্ষে মত দেয় গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিটেকচার আর্কাইভসে সংরক্ষিত লুই আই কানের মূল নকশার অনুলিপি আনারও উদ্যোগ নেওয়া হয়। সম্প্রতি সেই মূল নকশাও সরকার এনেছে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে যে, লুই কানের মূল নকশা বাস্তবায়নে সরকার ‘সিরিয়াস’।

শোনা যাচ্ছে, সংসদ ভবন এলাকা থেকে জিয়ার কবর সরিয়ে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সেক্টর কমান্ডারদের জন্য সংরক্ষিত এলাকায় প্রতিস্থাপন করা হবে। একইসঙ্গে সরিয়ে নেওয়া হবে সংসদ ভবনের দক্ষিণ চত্বরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় অবস্থিত জাতীয় কবরস্থানের সাতটি কবরও। তাদের কবর নিজ নিজ পারিবারিক কবরস্থানে বা কোনও সরকারি কবরস্থানে সরিয়ে নেওয়া হবে। যদিও লুই কানের মূল নকশা বাস্তবায়ন করতে হলে সংসদ ভবন এলাকা থেকে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবন এবং অদূরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রও সরিয়ে নিতে হবে। এমনকি সংসদ ভবনের চারিপাশে এখন নিরাপত্তার খাতিরে যে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়েছে, লুই কানের মূল নকশায় তাও নেই বলে জানা যায়।

জিয়ার কবর ইস্যুতে প্রধান দুই দলের নেতাদের কথাবার্তা বেশ আক্রমণাত্মক। আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব উল আলম হানিফ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, ওই সমাধিতে জিয়ার দেহাবশেষ নেই। তার দাবি, ১৯৮১ সালে জিয়ার মৃত্যুর পরে মরদেহ পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছিল। পরে একটি বাক্স নিয়ে এসে চন্দ্রিমা উদ্যানে মাটি দেওয়া হয়েছে। সেটির মধ্যে কী ছিল, তা কেউ জানে না। তার প্রশ্ন, যদি ওই কফিনে জিয়াউর রহমানের মরদেহ থাকতো, তাহলে ওই সময়ে সেটি তার স্ত্রী ও সন্তানরা কেন দেখেননি বা কেন ওই কফিন খোলা হয়নি? আবার বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভীর মতে, জিয়ার কবর সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকার দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

বাস্তবতা হলো, শেষ পর্যন্ত সংসদ ভবনের পেছন দিক থেকে জিয়ার কবর যদি সত্যি সত্যিই সরানোর সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে গৃহযুদ্ধ লাগবে না। দেশে হাজারও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু থাকতে একটা কবর সরানোর ঘটনায় দেশে গৃহযুদ্ধ লেগে যাবে—এমনটি বিশ্বাস করা লোকের সংখ্যা খুবই কম। বরং জিয়ার কবর সরিয়ে যদি মিরপুরে অথবা বনানী কবরস্থানে নেওয়া হয়, তাতেও বিএনপির মাজার/সমাধি/কবরকেন্দ্রিক রাজনীতি খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে হয় না। কারণ মিরপুরে হোক অথবা বনানীতে, নেতারা সেখানেও নানা উপলক্ষে ফুল দিতে যেতে পারবেন। এই ইস্যুতে কিছুদিন দেশের রাজনীতি তারা গরম করে রাখার উসিলা পাবেন। বিএনপির সমর্থক এবং আওয়ামী লীগ-বিএনপির মাঝামাঝি সুইং বা দোদুল্যমান নাগরিকদের কিছুটা সহানুভূতি পাবে বিএনপি।

লেখক:যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেলটোয়েন্টিফোর

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ