X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘ইসলামিক টেরোরিস্ট’ এবং নবীর শিক্ষা

আনিস আলমগীর
১৩ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৭:১০আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৭:১০

আনিস আলমগীর হযরত মুহাম্মদ সাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম-এর ওপর ব্যাপক আলোচনা প্রয়োজন। কারণ তাঁর জীবনটাই ইসলাম, তাঁর জীবনটাই কোরান, তাঁর জীবনটাই হাদিস। প্রতি মঙ্গলবার বাংলা ট্রিবিউন- এ লেখি। এবার বোধহয় আমার সৌভাগ্য যে, এ মঙ্গলবার নবী দিবস। সুতরাং মনস্থির করেছি, আজ (মঙ্গলবার) হযরত মুহাম্মদ (স.)এর  শিক্ষা ও দীক্ষা নিয়ে লেখব। বিশ্বের দেশে দেশে ‘ইসলামিক টেরোরিস্টরা’ যা করছে, এর পরিপ্রেক্ষিতে উনার জীবনী নিয়ে আলোচনা আজকের দিনে খুবই প্রাসঙ্গিক।
আজকে সমগ্র বিশ্বের মাঝে ইসলামকে নিয়ে যে কর্মকাণ্ড চলছে, তাতে মুসলিম বিশ্ব বিপদগ্রস্ত হয়েছে। কিছু পণ্ডিতব্যক্তি মুসলমান কিছু যুবককে ভুলপথে পরিচালিত করে, চাপাতি হাতে ইসলাম কায়েম করার জন্য বের করে দিয়েছে। আর এ যুবকেরা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে।অথচ ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ (স.) –এর শিক্ষায় চাপাতির কোপ বলে কিছু নেই।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে খারেজিরাও এমন কর্মকাণ্ড করেছিল।তারা বলতো, তারা যা বলে তাই প্রকৃত ইসলাম, অন্যসব বাতেন ফেরকা। খারেজিদের বাড়াবাড়িতে ইসলামি জগতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল। সেই বিশৃঙ্খলা থেকে ইসলামি জগতকে রক্ষা করতে বহু গুণীজনকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে। অবশ্য খারেজিদেরকে শেষ পর্যন্ত ক্ষান্ত হতে হয়েছিল।
এখন যা চলছে তা সে ধারারই পুনরুত্থান।চাপাতি হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তারা চাপাতি দিয়ে কেন হত্যাকাণ্ড চালায়? জবাবে তারা বলেছে, চাপাতি দিয়ে হত্যা করলে নাকি পুণ্য বেশি হয়।অর্থাৎ প্রাথমিক যুগে ফিরে যাওয়া।

ভারত উপ-মহাদেশে কোনও মুসলমান শাসক ইসলাম প্রচার করেননি, এমনকি আওরঙ্গজেবও নন, যেটি অনেকে ধারণা করেন। এখানে ইসলাম প্রচার করেছিলেন ফকিরেরা। সুতরাং কলেমা গ্রহণের পর অনেকে হয়তো পরিপূর্ণ তালিম লাভ করেননি বলে কিছু অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড তাদের মাঝে অব্যাহত ছিল। যেমন দিল্লির আশপাশের মুসলমানেরা নামাজও আদায় করতো, আবার ধনদৌলতের আশায় লক্ষ্মীর পূজাও দিত।

তবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হযরত ইলিয়াস (রা.) এই অবস্থা দেখে কিছু সাধারণ মুসলমানকে ট্রেনিং দিয়ে বের করে দিয়েছিলেন। তারাই দিল্লির আশপাশে বসবাসরত মুসলমানদের মাঝে প্রকৃত দ্বীন কী তা মেহনত করে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন।আদর করে কথা বললে সবাই কান পেতে শুনে।জোরজবরদস্তি করলে রক্তপাত হয়। এখন তারা আর লক্ষ্মীর পূজা করে না। এখান থেকে তবলীগ জামাতের সৃষ্টি।

মেহনত ছাড়া কোনও কিছু প্রত্যাশা করা হটকারিতা। সুদীর্ঘকালব্যাপী তবলীগ জমাতের মেহনতের ফলে এদেশের মানুষ শিরিক বেদায়াৎ মুক্ত হচ্ছে। চাপাতি হাতে বের হলে তা সম্ভব হতো না। যারা চাপাতি নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছেন, তাদের বলব মুসলমানদের মাঝে যদি দোষত্রুটি থাকে, তবে তা যেন তাদের সম্মুখে প্রকৃত দ্বীন তুলে ধরে সংশোধনের চেষ্টা করেন। চাপাতি দিয়ে নয়।

হযরত মুহাম্মদ (স.) ধর্ম কখনও কারও ওপর চাপিয়ে দিতেন না। ধর্মের দাওয়াত পেশ করতেন মাত্র। দাওয়াতের কাজে অগ্রগতি না হলে রাসুল (স.) পেরেশান হয়েছেন। তখন কোরানে করিমায় আয়াত নাজেল করে আল্লাহ্তালা বলেছেন, তোমার কাজ দাওয়াত দেওয়া, আমার কাজ হেদায়েত করা।

হযরত মুহাম্মদ (স.) তার বিদায় হজের ভাষণে বলেছেন। “ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না”। মানুষকে ভালবাসাই ধর্ম। একদিন হযরত মুহাম্মদ (স.) তাঁর চাদর বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। অর্ধেকটা চাদরে একটা বিড়ালও এসে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম থেকে উঠে রাসুলপাক (স.) বিড়ালটার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটালেন না।নিজের চাদরের অর্ধেকটা কেটে তিনি নামাজ পড়তে চলে গেলেন। একটি প্রাণির প্রতি প্রেমও ধর্ম।

“ইনসান” শব্দটি এসেছে “উনস” ধাতু থেকে। “উনস” মানে প্রেম। আল্লাহতায়ালা রাসুল পাককে বলেছেন, হে রাসুল আপনি বলুন “আমি বিভ্রান্ত হলে বিভ্রান্তির পরিণাম আমারই’’ ( সূরা সাবা ৫০)। সুতরাং চাপাতি ওয়ালাদেরকে বলব, চাপাতির পথ বিভ্রান্তির পথ। বিভ্রান্ত হওয়া এবং করার পরিণাম আপনাদেরকেই বহন করতে হবে। আপনারা চাপাতির পথ ত্যাগ করে ভালোবাসার পথে আসেন। আপনাদের কারণে সমস্ত বিশ্বে মুসলমানেরা অপমানিত হচ্ছে। তাদের জান মাল হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। আপনারা যেপথে চলেছেন, সেপথে জাতিরও মুক্তি নেই। আপনাদের আত্মত্যাগেরও কোনও উত্তম প্রতিদান আশা করতে পারেন না।

আপনাদের মনে রাখা উচিত, আল্লাহর রাসুল (স.) কখনও কোনও জনপথে হাঙ্গামা সৃষ্টিতে কোনও উৎসাহ প্রদান করেননি। বরঞ্চ তা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। রাসুলুল্লাহ (স.) হচ্ছেন উত্তম আদর্শ। আজকে নবী মুহাম্মদ (স.) এর জন্ম দিবসে বিভ্রান্তদের আহ্বান জানাব, নবী (স.) এর উত্তম আদর্শের অনুসারী হওয়ার জন্য।

যুদ্ধ ভিন্ন মানুষ হত্যা উত্তম আদর্শ নয়। মক্কা বিজয়ের পর রাসুল্লাহ (স.) সাধারণভাবে সবাইকে ক্ষমা করেছিলেন। কারও প্রতি পূর্বের শত্রুতার কথা বা কোরাইশদের অনাচারের কথা স্মরণ করে হত্যাযজ্ঞ চালানোর কোনও অনুমতি প্রদান করেননি।

কোরান, ইঞ্জিল, তৌরাত এই তিন গ্রন্থে “আদম” শব্দটি  আছে। তিন ভাষাতেই এ শব্দটির অর্থ এক। “আদম” অর্থ সভ্যতা। আল্লাহ্ আদমকে দিয়ে মানবসভ্যতা শুরু করেছিলেন। আল্লাহর মনে প্রেম জন্মে ছিল বলেই আহসান তাকমীম বা মাটির পুতুল সৃষ্টি করেছিলেন।আল্লাহর প্রেমে সিক্ত মানবজাতি। তাকে নির্বিচারে হত্যার অনুমতি আল্লাহ কাউকেও প্রদান করেননি।

রাসুল (স.) বলেছেন, দুনিয়ার যে প্রান্তেই হত্যা সংঘটিত হোক না কেন, অপর প্রান্তের কেউ যদি তাতে আনন্দ প্রকাশ করে, তবে সেও হত্যা অপরাধে অপরাধী। আল্লাহর ফিতরত পরিপূর্ণভাবে হৃদয়ঙ্গম করলে আজ যারা চাপাতি নিয়ে ঘুরছেন, তারা তার থেকে বিরত থাকতেন। তাদেরকে আল্লাহ্ তৌফিক দিতো ভালো-মন্দ, উত্তম-অধম বিবেচনা করার। আল্লাহ্তালা বলেন,  “তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করো হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং ওদের সঙ্গে আলোচনা কর সদ্ভাবে।” এখানেতো কোনও জবরদস্তির কথা বলেননি। এখানেতো চাপাতি নিয়ে আল্লাহর পথে আহ্বানের কথা বলেননি আল্লাহ।

মক্কা বিজয়ের পর রাসুল্লাহ্ (স.) তায়েফ অভিযানে গিয়েছিলেন। তায়েফ হচ্ছে “হুবল” দেবতার বাসভূমি। হুনায়ন নামক স্থানে উভয় বাহিনীর সাক্ষাৎ হয়। হুনায়নের যুদ্ধে মুসলিম পক্ষের সেনানায়ক ছিলেন রাসুল (স.)। অবিরাম যুদ্ধের পর তায়েফবাসী পরাজিত হয়। এ যুদ্ধে রাসুল (স.) আহত হয়েছিলেন। পরাজিত তায়েফবাসীর সঙ্গে রাসুল (স.) এত মধুর ব্যবহার করেছিলেন যে, তার অনুসারী আনসাররা পর্যন্ত ব্যথিত হয়েছিলেন। ইসলামের শুরুতে মুহাম্মদ (স.) যখন তায়েফে ধর্ম প্রচারে গিয়েছিলেন, তখন তায়েফবাসী এত নির্মমভাবে তাকে আঘাতের পর আঘাত করেছিল যে, এক পর্যায়ে তারা মুহাম্মদ (স.) এর মৃত্যু হয়েছে ভেবে দ্রাক্ষাকুঞ্জে ফেলে দিয়েছিলেন। তায়েফ বিজয়ের পর তিনি সবই বিস্মৃত হয়েছিলেন।

মুহাম্মুদুর রাসুল্লাহ (স.) শুধু মানুষের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়েছেন তা নয়, এমনকি তিনি পশুর কথা বিবেচনা করেও আইন করেছিলেন। যত্নের সঙ্গে পশু পালনের কথা বলা হয়েছে। অধিক বোঝা চাপানো নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এসব আইন কেউ অমান্য করলে তাকে পশুর মালিকানা থেকে বঞ্চিত করার ক্ষমতা বিচারককে দেওয়া হয়েছিল। হাদীস শরিফে আছে কোনও পশুর ওপর তিন ব্যক্তি আরোহণ করলে এক ব্যক্তি না নামা পর্যন্ত তাদের প্রতি পাথর ছুঁড়তে।

হযরত ওমর (রা.) যখন জেরুজালেমে প্রবেশ করেন তখন তিনি নামাজ পড়তে চেয়েছিলেন। খ্রিস্টানেরা গির্জায় নামাজ পড়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু তিনি এই বলে গির্জায় নামাজ পড়েননি-  কখনও মুসলমানেরা তার নামাজ পড়ার অজুহাতে ওই গির্জাটাকে হয়তো মসজিদ বানিয়ে ফেলবে।

আমি আজকের লেখাটা লিখেছি শুধু চাপাতিওয়ালাদের হেদায়েতের জন্য। কারণ তাদের আধ্যাত্মিক গুরু বা রাহাবররা তাদেরকে ভুল পথে পরিচালিত করছেন। অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি ঠিক নয়। বাড়াবাড়ি চলতে থাকলে, জার্মানিরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যেমন ৬০ লাখ ইহুদিকে গ্যাস চেম্বারে হত্যা করেছিল, ঠিক তেমনি অন্য ধর্মের লোকেরাও আত্মরক্ষার জন্য দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গায় গ্যাস চেম্বার তৈরি করবে মুসলমান হত্যা করার জন্য।

কবি  সৈয়দ রসিদ আহমেদ জৈনপুরীর একটা কবিতার লাইন দিয়ে শেষ করব।

‘হামারা ঘারমে আগ লাগগিয়া

হামারা চেরাগ চে।’

[আমার ঘরে আগুন লেগেছে, আমার প্রদীপ থেকে।]

আমরা যদি সাবধান না হই তা হলে মুসলিম জাতির বিনাশ অবধারিত।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ