X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

৪৫ বছরের বাংলাদেশ এবং ভবিষ্যৎ নির্ধারণী আগামী ৩০ বছর

গোলাম মোর্তোজা
১৪ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৪:৫৯আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৫:০১

গোলাম মোর্তোজা
‘যদি বাংলাদেশ স্বাধীন হয়, চলতে পারবে, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারবে?’
এই প্রশ্ন, ১৯৭১ সালে আলোচনায় এসেছিল। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদসহ আরও অনেকে যখন ইউরোপে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছিলেন, তখন এই প্রশ্নের মুখে তাদের পড়তে হয়েছিল। ডেনমার্কসহ অনেক দেশ এই প্রশ্ন করেছিল। তথ্য যুক্তি দিয়ে বোঝানোর পর, তারা সমর্থন জোরালো করেছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে।
স্বাধীনতার পর সেই বাংলাদেশকে পৃথিবী জেনেছিল ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে। অনেক প্রতিকূলতা অতিক্রম করে এখন বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে মোটামুটিভাবে স্বাবলম্বী। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশ আক্রান্ত হয়নি। স্বচ্ছলভাবে চলছে বাংলাদেশ। ৪৫ বছরের পরিণত বাংলাদেশের এই চলা কতটা পরিণত, কতটা টেকসই, এই প্রশ্ন বা আশঙ্কা আছে। তার প্রেক্ষিতে সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ।


১. স্বাধীনতার পরের বাংলাদেশ। যুদ্ধ বিধ্বস্ত, অর্থনীতি বিপর্যস্ত, রাজনীতি টালমাটাল। অবকাঠামো নেই, নেই খাদ্য। বাড়ছে জনসংখ্যা। কয়েক বছরের মধ্যে জনসংখ্যা পরিণত হলো আতঙ্কে। এত ছোট দেশ, এত জনসংখ্যা, কীভাবে বাঁচবে মানুষ?
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রচারণা জোরালো হলো, সুফলও মিলল। ততদিনে জনসংখ্যা যদিও বেড়ে গেছে আশঙ্কাজনক পর্যায়ে। আজকের বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সেই জনসংখ্যারই সুফল।
২. একটি দেশের উন্নয়ন বা সমৃদ্ধি তখনই হয়, যখন তার মোট জনসংখ্যার বেশির ভাগ কর্মক্ষম থাকে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী জনসংখ্যাকে বলা হয় কর্মক্ষম। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৬৬% কর্মক্ষম। ২০৩০ সালে যা বেড়ে দাঁড়াবে ৭০%-এ।
৬০ বছরের বেশি বয়স্ক মানুষ আস্তে আস্তে কর্মক্ষমতা হারাতে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশে এমন মানুষের সংখ্যা ৭%। ২০৩০ সালে যা ১২% হবে, ২০৫০ সালে হবে ২২%। অর্থাৎ ২০৫০ সালে মোট জনসংখ্যার ২২% কর্মক্ষম থাকবে না।
৩. আগামী ৩০ বা ৩৫ বছর বাংলাদেশের সুবর্ণ সময় বা গোল্ডেন পিরিয়ড। আগামী ৩০ বছর যদি বাংলাদেশ সঠিক ‘নীতি-পরিকল্পনা’ অনুযায়ী তার কর্মক্ষম জনসংখ্যাকে ব্যবহার করতে পারে, উন্নতি কেউ ঠেকাতে পারবে না। যদি ‘নীতি-পরিকল্পনা’ ভালো কিছু নাও হয়, তবুও বাংলাদেশ সামনের দিকেই এগুবে, অন্তত যে নীতিতে চলছে সেভাবেও যদি চলে। নিশ্চিত করে বলা যায় তাতেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি বাড়বে, সামাজিক উন্নয়ন দৃশ্যমান হবে। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, সেই উন্নয়ন কতটা হবে, স্থায়ী বা টেকসই হবে কিনা? কর্মক্ষম জনসংখ্যা কমার পরে, সেই অর্থনৈতিক-সামাজিক উন্নয়ন ধরে রাখার সক্ষমতা এই সময়কালে তৈরি হবে কিনা? যদি না হয়, তবে কি ঘটবে? এসব প্রশ্নের বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে একটি তথ্য দেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী ২০১৪-১৫ দুই বছরে কর্মসংস্থানের প্রয়োজন ছিল কমপক্ষে ১৩ লাখ। এই দুই বছরে কর্মসংস্থান হয়েছে ৬ লাখ। ৭ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়নি। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব বলছে, গত দেড় দশকের মধ্যে বর্তমানে বেকারের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এই বেকারের মধ্যে ৭৪% শিক্ষিত তরুণ-তরুণী। অর্থাৎ জনসংখ্যার সবচেয়ে কর্মক্ষম অংশ, যাদেরকে বাংলাদেশ কাজ দিতে পারছে না বা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছে না। সেই কারণেই ওপরের প্রশ্নগুলো সামনে আসছে, আসছে সঠিক ‘নীতি-পরিকল্পনা’র প্রসঙ্গ।
একথা সত্যি যে নিজস্ব উদ্যোগ কিছু কর্মসংস্থান হয়েছে বা হচ্ছে, তা হয়তো পরিসংখ্যানে সেভাবে আসেনি। তা সত্ত্বেও বিষয়টি আশঙ্কার। বিশেষ করে কাজ করতে পারা বা কাজ করতে চাওয়া মানুষকে যখন কাজ দেওয়া যায় না, তা খুব সুখকর ভবিষ্যতের চিত্র বহন করে না।
৪. আজকে বাংলাদেশের জনসংখ্যার যে চিত্র, ৪০ বা ৫০ বছর আগে আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়ার জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার চিত্র এমনই বা কাছাকাছি ছিল। কর্মক্ষম জনসংখ্যাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পেরেছিল বলেই, এসব দেশ উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছে। আবার আফ্রিকার নাইজেরিয়া বা ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশ একই রকম জনসংখ্যার সুবিধা নিয়ে, প্রাকৃতিক সম্পদের বাড়তি সুবিধা সত্ত্বেও উন্নতি করতে পারেনি। শুধু তাই নয় অবনতি হয়েছে, অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে কিছু দেশ।
সঠিক ‘নীতি-পরিকল্পনা’য় যেসব দেশ উন্নতি করেছিল তাদের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত ১৩টি দেশ ‘প্রবীণ দেশে’ পরিণত হবে ২০২০ সাল নাগাদ। জাপান, জার্মানি, ইতালি ইতোমধ্যে ‘প্রবীণ দেশে’ পরিণত হয়েছে। আগামী ২০ বছরের মধ্যে ইউরোপের প্রবীণ দেশের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়বে।
২০৩০ সাল নাগাদ সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া প্রবীণ দেশে পরিণত হবে।
মোট জনসংখ্যার ৭% যখন ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী হয়, তখন সেই দেশকে ‘প্রবীণ দেশ’ বলা হয়।
৫. বর্তমানে জাপানের মোট জনসংখ্যার ১২.৮% মানুষের বয়স ৭৫ বছর বা তার চেয়ে বেশি। প্রতি ৮ জন জাপানিজের মধ্যে ১ জনের বয়স ৭৫ বছরের বেশি। প্রতি ৪ জনে ১ জন ৬৫ বছরের বেশি বয়সী। কর্মক্ষমতাহীন মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে, বেড়ে যাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি তো নেই-ই, ৪ বছরে কমেছে প্রায় ১০ লাখ জনসংখ্যা। জাপানের অর্থনীতির গতি যে আর আগের মতো নেই, তার অনেক কারণের মধ্যে এটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ। কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে বয়স্কদের পেছনে জাপানের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়।
উন্নতির সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর পরও এখন জাপানকে তা ধরে রাখার জন্যে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এশিয়া তথা বিশ্বের বর্তমান অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ার চীনে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমছে। ২০১৪ সালের হিসাব অনুযায়ী, চীনের মোট জনসংখ্যার ১৫.৫%-এর বয়স ৬০ বছরের বেশি। ৬৫ বছর বয়সী জনসংখ্যা ১০.১%। ২০২০ সালে চীনের প্রবীণ জনসংখ্যা যারা কাজ করতে অক্ষম এমন মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে ১৭%।
চীনের এই অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধরে রাখা বা এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আগামী সময়ে এই জনসংখ্যা হবে বিশাল বড় চ্যালেঞ্জ।
জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করে যেসব দেশ উন্নতি করেছে, তাদের কিছু ‘নীতি-পরিকল্পনা’ অনুসরণ করতে হয়েছে। সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে শিক্ষা এবং মানব সম্পদ উন্নয়ন। সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতি হ্রাসে দৃঢ়তা দেখাতে হয়েছে। সর্বাপরি সবগুলো দেশই শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে।
৬. জনসংখ্যার সুবিধা-অসুবিধার দু’টি চিত্রই আমাদের সামনে দৃশ্যমান। এই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ কীভাবে কাজে লাগাবে? বাংলাদেশ কি আফ্রিকার কিছু দেশ যেমন নাইজেরিয়া বা ল্যাটিন আমেরিকান কিছু দেশের উদাহরণ তৈরি করবে, না মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডের মতো অবস্থায় পৌঁছবে?
এমন অবস্থায় পৌঁছানোর ক্ষেত্রে জরুরি বিষয় সুশাসন। সেক্ষেত্রে বিতর্কহীনভাবে বলা যায় বাংলাদেশের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। পরিস্থিতি উন্নয়নের কোনও পরিকল্পনা দৃশ্যমান নয়। যা সবচেয়ে হতাশার। ধর্মীয় বা রাজনৈতিক জঙ্গিবাদ সুশাসনের সঙ্গে সম্পর্ককৃত।
দুর্নীতির রূপ ভয়ঙ্কর। দুর্নীতি কম-বেশি অনেক দেশেই ছিল, আছে। তাদের অনেকে ব্যবস্থা বা উদ্যোগ নিয়ে দুর্নীতি কমিয়েছে। বাংলাদেশের নীতি দুর্নীতি কমানো তো দূরের কথা, রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্নীতিবাজদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়াটা এখানে দৃশ্যমান। ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ মোটেই দৃশ্যমান নয়। ফলশ্রুতিতে পুঁজি বা সম্পদ পাচার হয়ে যাচ্ছে আশঙ্কাজনকভাবে।
সুশাসন, দুর্নীতির চেয়েও বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর চিত্র মানব সম্পদের উন্নয়ন না হওয়া। শিক্ষা ব্যবস্থা বিশেষ করে সাধারণ জনমানুষের যে শিক্ষা, তা গত বিশ পঁচিশ বছরে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। গত আট দশ বছরে শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদের হাত দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা, সর্বত্র অবনতি হয়েছে, হচ্ছে টর্নেডো গতিতে। এমন দুর্বল শিক্ষা ব্যবস্থার ফলাফলটা পাওয়া যাবে আগামী ১৫ বছর পর থেকে। যোগ্য-দক্ষ মানব সম্পদের একটা আকাল দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এখনও বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সক্ষমতার চিত্র অত্যন্ত করুণ। দশ টাকার কাজ দশ হাজার টাকায় করার রীতি স্থায়ী রূপ পেয়ে গেছে। সাত দিনের কাজ এক বছরেও শেষ হয় না। রাষ্ট্রের কোনও ক্ষেত্রে দক্ষ লোকবল এবং ব্যবস্থাপনা নেই। একদা সবল রাষ্ট্রীয় এমনকি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল করা হয়েছে, হচ্ছে।
সরকারের সামগ্রিক ‘নীতি-পরিকল্পনা’ যার ওপর ভিত্তি করে দেশের উন্নয়ন হবে, যে উন্নয়ন স্থায়ী বা টেকসই হবে, তা অত্যন্ত দুর্বল। যেমন দেশে বেকার জনসংখ্যার ৭০% শিক্ষিত কর্মক্ষম তরুণ-তরুণী হওয়া সত্ত্বেও, ৫ লাখ ভারতীয়সহ প্রায় ১০ লাখ বিদেশি কাজ করছে বাংলাদেশে। যার মধ্যে বিশ পঁচিশ হাজারের বেশি বিশেষ দক্ষ জনশক্তি ছাড়া অন্যদের কোনও প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ তাদের কাজ দেশের তরুণ-তরুণীরাই করতে সক্ষম। সরকারের নীতিহীন নীতির কারণে তা হচ্ছে না, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী বসিয়ে রেখে বিদেশিদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে।
কর্মক্ষম জনসংখ্যার কাজ না থাকায়, দুঃশাসন-দুর্নীতির সুযোগে সামাজিক অবক্ষয় প্রকট আকার ধারণ করছে। মাদকের বিস্তার অবিশ্বাস্যরকমভাবে বেড়ে গেছে, শহর-প্রত্যন্ত গ্রাম সর্বত্র। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের সঠিক বা পরিকল্পিত ব্যবহার হচ্ছে না।
বাংলাদেশের ‘গোল্ডেন পিরিয়ড’ আগামী ৩০ বছর পরে, এখন যে জনসংখ্যা সম্পদ তা পরিণত হবে দায়ে। জনসংখ্যার এই দায় বহন করে উন্নয়ন বা সমৃদ্ধি ধরে রাখা অত্যন্ত কঠিন হবে।
এত প্রতিকূলতা বিশেষ করে সরকারি সঠিক ‘নীতি-পরিকল্পনা’ ছাড়া উন্নয়নের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে হয়তো ওঠা যাবে। শিখরে পৌঁছানো যাবে কিনা তা অনিশ্চিত। মাঝখানে আটকে গেলে নিচে পড়ে যেতে হবে।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘মাঠে আমার শরীর কেউ স্পর্শ করতে পারেনি’
‘মাঠে আমার শরীর কেউ স্পর্শ করতে পারেনি’
দোকান সাজাতে গিয়ে গানচিত্র নির্মাণ!
দোকান সাজাতে গিয়ে গানচিত্র নির্মাণ!
বিতর্কিত দ্বীপ নিয়ে জাপানের কূটনীতিককে তলব দ. কোরিয়ার
বিতর্কিত দ্বীপ নিয়ে জাপানের কূটনীতিককে তলব দ. কোরিয়ার
সন্তানদের উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে চা বিক্রেতা মনিরুজ্জামানের
সন্তানদের উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে চা বিক্রেতা মনিরুজ্জামানের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ