X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুক্তিযুদ্ধ: স্বপ্ন ও বাস্তবতা

রুমীন ফারহানা
১৭ ডিসেম্বর ২০১৬, ১২:৩৪আপডেট : ১৭ ডিসেম্বর ২০১৬, ১২:৫১

রুমীন ফারহানা মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরবের ইতিহাস, অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে জেতার ইতিহাস। এ লড়াই শুধুমাত্র একটি স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ড লাভের লড়াই ছিল না, এ লড়াই ছিল অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং জাতিগত বৈষম্য আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার, লালন করার, চর্চা করার লড়াই। শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে হাজার মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত দুটি ভূখণ্ড মিলে যে একটি রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে না তার জ্বলন্ত উদাহরণ ছিল এই মুক্তিযুদ্ধ। ৭১ এর যুদ্ধ ছিল গণমানুষের যুদ্ধ, তাদের দ্বারাই রচিত হয়েছে গৌরবের অমরগাঁথা, বিশ্বের বুকে জন্ম নিয়েছে স্বাধীন, সার্বভৌম এক রাষ্ট্র। এমন গৌরবের ইতিহাস একটি জাতির ভাগ্যে বারবার রচিত হয় না। তাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে, বলা হয়েছে, গবেষণা হয়েছে তাও যেন বাকি রয়ে গেছে অনেকটুকু।
মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ একদিনে শুরু হয়নি। এর পেছনে আছে দীর্ঘদিনের শোষণ আর বঞ্চনার ইতিহাস, আছে দীর্ঘ সংগ্রামের পটভূমি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা যারা এবং যারা এর জন্য লড়াই করেছেন প্রাথমিকভাবে তারা হলেন বাঙালি ছাত্রসমাজ। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলন যা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং সর্বশেষ ৭০ এর নির্বাচন বারংবার এই ইঙ্গিতই দিয়ে যাচ্ছিল যে এত শোষণ, নিপীড়ন, বঞ্চনা আর বৈষম্য নিয়ে একটি রাষ্ট্র কোনও ভাবেই টিকে থাকতে পারে না। ১৯৪৮ থেকে শুরু হওয়া প্রতিটি আন্দোলন আর সংগ্রাম জাতির চিন্তায় নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে, তাকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে এবং ধীরে ধীরে জাতির সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বপ্ন। প্রথমে এটি ছিল স্বায়ত্ত্বশাসনের আন্দোলন, পরবর্তীতে দাবি উঠেছে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের এবং সর্বশেষ স্বাধীনতার।

৭০ এর নির্বাচনে মানুষ ভোট দিয়েছিল আওয়ামী লীগকে। ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে আওয়ামী লীগ ১৬০ টি আসনে জয়লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সাধারণ নির্বাচনের একই সঙ্গে প্রাদেশিক নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান অ্যাসেম্বলির ৩০০ টি আসনের মধ্যে ২৮৮ টিতে জয়লাভ করে। গনমানুষের এই রায় পাকিস্তানি শাসকরা স্বীকার করে নাই, জনরায়ের প্রতি অশ্রদ্ধা জানিয়েছে। নির্বাচনি ফলাফল মেনে না নেওয়ায় জনগণের দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ আর বিক্ষুদ্ধতার বিষ্ফোরণ ঘটেছিল যার স্বাভাবিক পরিণতি ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং আজকের বাংলাদেশ। বলে রাখা ভালো গুটিকয় রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাদে সাত কোটি বাঙালিই ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। সকলে হয়তো অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেনি কিংবা রক্ত দেয়নি কিন্তু প্রতিটি মানুষের প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ কিংবা নেপথ্যের আত্মত্যাগ দিয়েই রচিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।

আজকাল রাজনৈতিক বক্তৃতা, টকশো, গোলটেবিল বৈঠক, সভা সমাবেশ থেকে শুরু করে প্রায় সব আলোচনাতেই একটা কথা শোনা যায়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, বিপক্ষের শক্তি, স্বাধীনতার সপক্ষের বা বিপক্ষের শক্তি কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দল। আরও সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে আওয়ামী লীগ নানা ভাবে দাবি করে তারাই বাংলাদেশে একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের চেতনার ধারক ও বাহক। ভোটের হিসাবে (তাও বেশ আগের কথা বলছি কারণ বিগত কয়েক বছরে দেশ থেকে ভোটের সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়েছে) এই দলটির সমর্থক ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ। এই ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ মানুষ বাদ দিলে বাকি ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ কি তবে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী? তাহলে তো তা দেশের জন্য এক ভয়াবহ সংবাদ যা নতুন করে সবকিছু বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কিন্তু সত্যিই কি তাই নাকি এটি আওয়ামী লীগের শুধুমাত্র  রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে জাতিকে চিরতরে বিভাজিত করার এক ভয়ংকর খেলা? আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী? এটি কিন্তু আর দশটি অনুভূতির মতো কোনও অস্পষ্ট বা বায়বীয় বিষয় নয়। অনেকেই একে অস্পষ্ট রাখতে চায় যেন সময়, সুযোগ, ইচ্ছা আর সুবিধা মতো ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা আর সজ্ঞায় একে সজ্ঞায়িত করা যায়। যখন যেমন সুবিধা তখন তেমন রং লাগানো যায়।

স্বাধীনতার ইস্তেহার, ঘোষণাপত্র আর সংবিধানের প্রস্তাবনাটি দেখলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। স্পষ্ট হয়ে ওঠে বাংলাদেশের জন্মলগ্নে দেখা আমাদের স্বপ্নের কথা। স্বাধীনতার ইস্তেহারে বলা ছিল -

‘৫৪ হাজার ৫০৬ বর্গমাইল বিস্তৃত ভৌগলিক এলাকার সাত কোটি মানুষের জন্য আবাসভূমি হিসাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ। এই দেশ গঠন করে নিম্নলিখিত তিনটি লক্ষ্য অর্জন করতে হবে:-

১. স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করে পৃথিবীর বুকে একটি বলিষ্ঠ বাঙালি জাতি সৃষ্টি ও বাঙালির ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতির বিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।

২. স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করে অঞ্চলে অঞ্চলে, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্য নিরসন কল্পে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করে কৃষক শ্রমিক রাজনীতি কায়েম করতে হবে।

৩.  স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করে ব্যক্তি, বাক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ নির্ভেজাল গণতন্ত্র কায়েম করতে হবে।’

এক কথায় বলতে হলে বলতে হয় স্বাধীনতার ইস্তেহারের মূল কথাই ছিল বলিষ্ঠ বাঙালি জাতি গঠনের সাথে এর ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি বিকাশের ব্যবস্থা করা, বৈষম্যহীন সমাজ গঠন, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু, বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং নির্ভজাল গণতন্ত্র কায়েম। স্বাধীনতার ৪৫ বছরে এর কোনটি আমরা করতে পেরেছি সেই বিচারের ভার আমি পাঠকের হাতে ছেড়ে দিলাম। বিশেষ করে বিগত ৮ বছরে বৈষম্য, বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের যে ক্ষতবিক্ষত বিভৎস রূপ আমাদের দেখতে হয়েছে তাতে কোন কালে যে এ ধরনের একটি রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন জাতি দেখেছিল সেটিই একপ্রকার স্বপ্ন বলে মনে হয়।

৭১ এর মার্চ মাসে দেওয়া হয় এই ইস্তেহার। এরপর ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ ঘোষিত হয় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বা proclamation of independence যেখানে খুব স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছিল কেন এই যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধে জিতে কেমন দেশ তৈরির স্বপ্ন দেখেছিল এদেশের মানুষ। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে জায়গা করে নেয় মূলত তিনটি বিষয়:- সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। এমনই দুর্ভাগ্য জাতির যে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মূলমন্ত্রটিই স্থান পায়নি আমাদের সংবিধানে। যদিও এই তিন প্রতিশ্রুতি ছিল রাষ্ট্রের সঙ্গে এর স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রথম চুক্তি। যতদিন বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলেছে ততদিন প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের অন্তবর্তীকালীন সংবিধান হিসাবে এই ঘোষণাপত্র কাজ করেছে। প্রকৃতপক্ষে যতদিন পর্যন্ত না ৭২ এর সংবিধান প্রণীত হয় ততদিন পর্যন্ত এটিই ছিল বাংলাদেশের সংবিধান । সেই অর্থে বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান ছিল এই ঘোষণাপত্র। পেরেছি কি আমরা সাম্য, মানবিক মর্যাদা বা সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে? সময় তো কম পার হলো না।

জাতির আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক যে সংবিধান তার প্রস্তাবনায় পরিষ্কার বলা আছে এই সংবিধানের মূলনীতি চারটি- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপক্ষতা। সমাজতন্ত্র কোনকালেই কায়েম হয় নাই আর গণতন্ত্রের এখন যে হাল সেটা নিয়ে কথা বলাও একপ্রকার সময় নষ্ট। আওয়ামী লীগ খুব বেশি লাজলজ্জার ধার ধারেনি, স্পষ্টই বলেছে, ‘আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র’, ‘সীমিত গণতন্ত্র’, ‘বেশি উন্নয়ন কম গণতন্ত্র’। কথা কাজের মিলও তারা রেখেছে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন এবং এর পরে ঘটে যাওয়া সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে। সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আইয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্রেসি ফর্মুলায় হতে যাচ্ছে জেলা পরিষদ নির্বাচন। স্বাধীনতা কালীন প্রতিটি অঙ্গীকার ভঙ্গ করে চেতনা এখন এসে ঠেকেছে রাজনীতির সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হিসাবে। এর চেয়ে বড় অসম্মান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আর কী হতে পারে? রাজনীতিকদের জন্য চেতনা এখন আর মুক্তিযুদ্ধকালীন দেওয়া রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি নয়, সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের নূন্যতম চেষ্টাও নয়, চেতনা হলো এখন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার মোক্ষম হাতিয়ার। আর আমজনতার চেতনা বাস করে একদিনের দেশাত্মবোধক গানে, লাল সবুজ শাড়ির ভাঁজে কিংবা এক সপ্তাহের জন্য পতাকা রঙে রাঙানো অস্থায়ী প্রফাইল পিকচারে। একটি জাতির চিন্তা করবার, বিচার বিবেচনা করবার এবং সেই মতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ক্রমশই সংকুচিত হয়ে না আসলে এই বিচ্যুতি কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

শেষ একটা কথা স্মরণ করিয়ে আজকের লেখার ইতি টানি। সংবিধানের প্রস্তাবনার তৃতীয় প্যারায় বলা আছে আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতন্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হবে। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় খুব অবাস্তব আর কেতাবি শোনায় কথাগুলো, তাই না? অথচ এগুলোকে বাস্তবে রূপ দেওয়াই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। চেতনার কুৎসিত রাজনৈতিক ব্যবহার দেখে আতঙ্ক হয় পরবর্তী প্রজন্মের জন্য না জানি চেতনা অর্থ শুধুই একটি মতের মানুষের নিরঙ্কুশ আধিপত্য, শোষণ, নিপীড়ন আর স্বৈরতন্ত্র হয়ে ধরা দেয়। যে মুক্তিযুদ্ধ একদিন একতাবদ্ধ করেছিল ৭ কোটি মানুষকে, রাজনীতির ঘৃণ্য চক্রে তা আজ স্পষ্টভাবে বিভাজিত করেছে ১৬ কোটি মানুষকে।

লেখক: আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিন-রামাফোসার ফোনালাপ
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিন-রামাফোসার ফোনালাপ
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ