X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

আমাদের পুলিশ, আমাদের শের আলী

আমীন আল রশীদ
১৯ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৯:০২আপডেট : ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৯:০৪

আমীন আল রশীদ গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লীতে পুলিশের আগুন দেওয়ার ভিডিও যখন টেলিভিশনে প্রচারিত হয়, তখন দুর্ঘটনাকবলিত শিশু কোলে হাসপাতালে দৌড়ে যাওয়া একজন পুলিশ কনস্টেবলের হৃদয়স্পর্শী ছবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
তার নাম শের আলী। পুলিশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের যে  সাধারণ ধারণা, সেই জায়গায় শের আলী একদমই ব্যতিক্রমী চরিত্র। ফলে দুর্ঘটনাকবলিত একটি শিশুকে কোলে নিয়ে তার দৌড়ে হাসপাতালে ছুটে যাওয়ার হৃদয়স্পর্শী ছবি সবাইকেই আবেগাপ্লুত করেছে।
শের আলীর জবানি এ রকম—‘‘দুর্ঘটনাকবলিত বাসের যাত্রীদের উদ্ধার করার সময় ভেতর থেকে একটি বাচ্চার আওয়াজ শুনি। শিশুটি ভেতরে আটকে ছিল। কোনও রকমে তাকে উদ্ধার করি। বাসের বাইরে বের করার পর মেয়েটি ‘আব্বা, আব্বা আমাকে পানি দেন, পানি খাব’ বলতে থাকে। এতক্ষণ দায়িত্ব পালন করছিলাম। কিন্তু মেয়েটির চেহারা আর ডাক শুনে নিজের মেয়ের কথা মনে পড়ে গেলো। আর আবেগ ধরে রাখতে পারিনি।’’ তারপর মেয়েটিকে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে শের আলী দৌড় দেন হাসপাতালের দিকে। তখন পুলিশের খোলস থেকে বেরিয়ে শের আলী হয়ে ওঠেন একজন বাবা। তখন একজন পুলিশ কনস্টেবলই আমাদের সামনে হয়ে ওঠেন মানবতার এক মূর্ত প্রতীক। শের আলী হয়ে ওঠেন একজন দায়িত্ববান, একজন সংবেদনশীল, একজন মানবদরদি মানুষের প্রতিচ্ছবি। তখন তার পুলিশ পরিচয়টিকে আমরা আর মনে রাখি না।
কিন্তু আমরা মনে করতে পারি, এই ঘটনার  কয়েকদিন আগেই ময়মনসিংহেরর ফুলবাড়ীয়ায় কলেজ জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলনের সময় পুলিশের বেধড়ক পিটুনিতে নিহত হয়েছেন আবুল কালাম আজাদ নামে একজন শিক্ষক। তার কয়েকদিন আগে কিশোরগঞ্জে একজন আসামিকে ক্রসফয়ারের ভয় দেখিয়ে তার পরিবারের কাছে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন এক এসআই, সেই খবরও গণমাধ্যমে এসেছে। এর বাইরে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন স্থানে তথাকথিত ক্রসফায়ার বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ যারা নিহত হন, তাদের ক’জন সত্যিই অপরাধী আর কতজন নিরীহ—সেই হিসাব বের করা মুশকিল। অনেক সময় খুনের কূলকিনারাও করা যায় না। যেমন সম্প্রতি নাটোরের তিন যুবলীগ নেতার গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে দিনাজপুর থেকে। তাদের প্রত্যেকের পরিবার থেকেই অভিযোগ করা হয়েছে, তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়েছিল। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিষয়টি স্বীকার করেনি। ফলে এই তিন যুবক, তারা হোক অপরাধী কিংবা নিরপরাধ—তাদের খুনের রহস্য উন্মোচিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

আমরা মনে করতে পারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আব্দুল কাদেরে কথা, যাকে থানার ভেতরে নিয়ে চাপাতি দিয়ে কুপিয়েছিলেন ওসি। আমরা মনে করতে পারি, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম রাব্বির কথা, যাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে নির্মম নির্যাতন করেছিল পুলিশ। আমরা মনে করতে পারি, সিটি করপোরেশন কর্মকর্তা বিকাশের কথা, মধ্যরাতে বাসায় ফেরার পথে যাকে বেধড়ক পিটিয়েছিল পুলিশ। আমরা মনে করতে পারি সরকারি কর্মকর্তা এহসানুর রহমানের কথা, যিনি পকেটে পরিবারের সদস্যদের পাসপোর্ট নিয়ে বাসায় ফেরার পথে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে পুলিশের হাতে নাজেহালের শিকার হয়েছিলেন এবং উপস্থিত জনতার সহায়তায় সে যাত্রা বেঁচে যান।

বছরের পর বছর নাগরিকদের এ রকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়ায় পুলিশ সম্পর্কে তাদের যে সাধারণ ধারণা বদ্ধমূল হয়েছ, তা রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় এই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য মোটেও সুখকর নয়। জঙ্গি দমন থেকে শুরু করে অনেক ভালো কাজ করার পরও পুলিশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের গড়পরতা ধারণা খুবই খারাপ। মানুষ মনেই করে পুলিশ বিনা ধান্দায় কোনও অভিযানে যায় না; নিরীহ লোকদের থানায় ধরে নিয়ে যায় শুধু পয়সার জন্য; কোনও মামলায়ই তারা টাকা ছাড়া নেয় না; বাদী ও আসামিপক্ষের মধ্যে যাদের কাছ থেকে বেশি টাকা পায়, পুলিশ তার পক্ষেই মামলার চার্জশিট বা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়; রাজনৈতিক এবং স্থানীয় প্রভাবশালীদের চাপে কিছু কাজ করলেও তাদের মূল টার্গেট টাকা কামানো এবং সর্বোপরি পুলিশ সরকারের পেটোয়া বাহিনী হিসেবে কাজ করে। তবে যে বক্তব্যটি সব সময়ই শোনা যায়, তা হলো, মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে চাকরি নিতে হয় বলে  পুলিশ ঘুষ খেতে বাধ্য হয় অথবা পুলিশের সামগ্রিক সিস্টেমটাই এমন যে, সেখানে ঘুষ না খেয়ে থাকাটাই বরং চ্যালেঞ্জ।

বলা হয়, বাংলাদেশের পুলিশের যে আইনি ক্ষমতা এবং দক্ষতা, তাতে তারা যেকোনও অপরাধীকেই দ্রুত ধরে ফেলতে পারে। এ রকম কথাও প্রচলিত আছে—পুলিশ আন্তরিক হলে মসজিদ থেকে একটি জুতাও চুরি হবে না। রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের শিক্ষার্থী রিশা হত্যার পরে তার সহপাঠীদের আন্দোলনে গিয়ে রমনা জোনের সহকারী কমিশনার শিবলি নোমান ঘোষণা দিয়েছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীকে ধরা হবে। হয়েছেও তাই। ৪৮ ঘণ্টার আগেই নীলফামারী থেকে গ্রেপ্তার করা হয় অভিযুক্ত ওবায়দুলকে।

একটি বিস্ময়কর খবর জানা গেলো গত নভেম্বরে। পাবনার সাত উপজেলায় বিসিএসে উত্তীর্ণ ৩৭ জনের ভেরিফিকেশন করতে গিয়ে পুলিশ কোনও পয়সা নেওয়া তো দূরে থাক, উল্টো ফুল ও মিষ্টি নিয়ে গেছে প্রার্থীদের বাসায়। গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, ভেরিফিকেশনের ভয় কাটাতে পাবনার সহকারী পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) শেখ সেলিম ৩৫তম বিসিএসে উত্তীর্ণ পাবনার ৩৭ জন প্রার্থীর বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছেন ফুলের তোড়া ও মিষ্টি।  উপহার পাওয়া প্রার্থী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা জানান, পাসপোর্ট, চাকরি, বিদেশ যাওয়াসহ যেকোনও বিষয়ে পুলিশ ভেরিফিকেশন মানেই ঝামেলা। অধিকাংশ সময়ই প্রার্থীর পক্ষে ভালো কথা লেখার নামে পুলিশ টাকা দাবি করে। ফলে তাদের (পুলিশ) বিভিন্নভাবে খুশি করতে হয়। কিন্তু পাবনা পুলিশের এ উদ্যোগ প্রচলিত ধারণাকে কিছুটা হলেও পাল্টে দিয়েছে।

অর্থাৎ প্রতিদিন আমাদের সামনে পুলিশ যেমন মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়, তেমনি শের আলী বা শেখ  সেলিমরাও এই বাহিনীর ভেতরে রয়েছেন। হয়তো সেই সংখ্যাটা খুব কম। কিন্তু এই সংখ্যাটা যত বাড়বে, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা তত গতি পাবে। কারণ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে যেমন পুলিশ, তেমনি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় বাধাও এই পুলিশ। যার সবশেষ উদাহরণ গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ।

এরইমধ্যে দেশবাসী গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতাল পল্লীতে পুলিশের আগুন দেওয়ার যে ভয়াবহ ছবি দেখেছে, তা সত্যিই আতঙ্কের। রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, মানুষ বিপদে পড়লে প্রথমে যাদের কাছে ছুটে যায়, সেই বাহিনী  রাষ্ট্রের একটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে জমি থেকে উচ্ছেদ করতে যদি তাদের বাড়িঘরে আগুন দেয়, তাহলে একাত্তরে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে তাদের আর কী ফারাক থাকে? 

সাংবাদিক হারুন অর রশিদ তার একটি নিবন্ধে লিখেছেন, ‘সরকারের একটি ডিসিপ্লিনারি ফোর্স যে জঘন্য ঘটনা ঘটিয়েছে, তা কোনোভাবেই আইনের ভাষায় ব্যাখ্যা করা যায় না। এরসঙ্গে আত্মরক্ষার কোনও সম্পর্ক নেই। এর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কোনও সম্পর্ক নেই। এটি ক্রিমিনাল অফেন্স বললেও কম করে বলা হবে। এটি একটি জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করার জঘন্য-প্রক্রিয়া। যা আমরা একাত্তরে দেখেছি।’

যদিও এই ভিডিওর ব্যাপারে অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমানকে একাত্তর টিভিকে বলেছেন, ‘পুলিশ কেন মানুষের ঘরবাড়িতে আগুন দেবে? পুলিশ কোনও পক্ষ নয়। তারা ‍দু’টি বিবদমান পক্ষের মাঝখানে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে।’ প্রশ্ন হলো, গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতাল পল্লীতে আগুন দেওয়ার ওই ভিডিও কি তাহলে মেকিং বা তৈরি করা? উচ্চ আদালত এরইমধ্যে ঘটনাটি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। আদালত বলেছেন, ‘গণমাধ্যমে যেসব প্রচার হয়েছে, তা দেখে আমরা চোখ বন্ধ করে থাকতে পারি না।’

ফেসবুকে বন্ধু সাহেদ আলমের একটা স্ট্যাটাস উদ্ধৃত করে লেখাটি শেষ করি। তিনি লিখেছেন, ‘পুলিশের পোশাক পরা মানুষগুলো আমাদের মতোই মানুষ। পুলিশ যখন নিজ দায়িত্বে কাজ করে তখন তারা প্রতিজনই একেকজন শের আলী। আর পুলিশ যখন অন্য কারও হয়ে কাজ করে তখন পুলিশ, এই আগুন দেওয়া পুলিশ। বিষয়টা হলো আপনি কিভাবে এই বাহিনীকে ব্যবহার করছেন তার ওপর নির্ভর করছে।’

লেখক: যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আট বছর পর জাবিতে ডিন নির্বাচন
আট বছর পর জাবিতে ডিন নির্বাচন
তামাকে বিষ, তবুও ঝুঁকছেন কৃষক 
তামাকে বিষ, তবুও ঝুঁকছেন কৃষক 
এফএ কাপে হাল্যান্ডকে নিয়ে সংশয়ে সিটি
এফএ কাপে হাল্যান্ডকে নিয়ে সংশয়ে সিটি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ