বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর স্থগিত হলো। ডিসেম্বর মাসের মধ্যভাগে এ সফরে যাওয়ার কথা ছিল। উত্তরবঙ্গের মানুষ বুকভরা আশা নিয়ে বসেছিল প্রধানমন্ত্রীর এ সফরের সময় তিস্তার পানি বণ্টনের চুক্তি হবে আর তারা পানি পাবে। এ মৌসুমে চাষাবাদে কোনও দুঃখ পোহাতে হবে না।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে তিস্তার ডালিয়া পয়েন্টে পানির প্রবাহ ছিল পাঁচশত কিউসেক এবারও হয়তো পানির প্রবাহ তাই হবে অথচ একটা নদীকে বাঁচাতে হলে কমপক্ষে প্রবাহে ১২০০ কিউসেক পানি থাকতে হবে। উত্তরবঙ্গের মানুষ কি চেয়ে চেয়ে দেখবে যে তাদের চাষাবাদের জন্য তো প্রয়োজনীয় পানি পাচ্ছেই না বরঞ্চ তাদের প্রবাহমান নদীটা ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে।
ভারতের শাসনতন্ত্র রয়েছে কোনও রাজ্যের কোনও বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার কোনও চুক্তি করতে চাইলে সে রাজ্যের সম্মতির প্রয়োজন হবে। তিস্তাতো আন্তর্জাতিক নদী। তার সম্পর্কে তো আন্তর্জাতিক বিধিবিধান রয়েছে। ভারতের শাসনতন্ত্র কি আন্তর্জাতিক বিধিবিধান রহিত করে দিতে পারে?
গঙ্গা চুক্তি নিয়েও বাংলাদেশের ভোগান্তির পরিমাণ কম ছিল না। গঙ্গার পানি চুক্তির বৈঠকে ভারত বারবার বাংলাদেশকে প্রস্তাব দিতো পদ্মার প্রবাহ ঠিক রাখার জন্য যেন বাংলাদেশ ব্রক্ষ্মপুত্র থেকে সংযোগ খাল কেটে পানি পদ্মায় নিয়ে যায়। এমন সংযোগ খাল যদি কোনাকুনি কেটে লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম থেকে শুরু করে নীলফামারী জেলার ডিমলা দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর, সৈয়দপুর, ফুলবাড়ী, বিরামপুর, ঘোড়াঘাট, জয়পুর হাট জেলার পাঁচ বিবি, ক্ষেত লাল নওগাঁ জেলার বদলগাছী, মহাদেবপুর, নিয়ামতপুর, চাপাইনওয়াবগঞ্জ জেলার নাচোল, শিবগঞ্জ হয়ে পদ্মায় ফেলা হত তাতে যে ভূমি বিনষ্ট হত তার পরিমাণ ছিল সাবেক বৃহত্তম কুষ্টিয়া জেলার সমান।
কোটি কোটি লোকের ছোট একটা দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। তার পক্ষে কি এতো জমি বিনষ্ট করা সম্ভব ছিল? কিন্তু গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে যে বৈঠক হতো ভারতের প্রতিনিধিরা এমন প্রস্তাবই বার বার উত্থাপন করতেন। এ ছিল ভারতীয়দের ছোট প্রতিবেশীর সঙ্গে এক বিরাট রসিকতা। কলকাতা বন্দর রক্ষার জন্য ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে এটা ছিল ভারতের বক্তব্য। পাকিস্তান সরকার তার কোনও প্রতিবাদ করেনি। বরঞ্চ তারা সিন্ধু নদীর পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে ব্যস্ত ছিল।
কলকাতা বন্দর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৭০ সালের ১৭ অক্টোবর কলকাতা পোর্ট কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে। কলকাতা বন্দরকে গেটওয়ে অব ইস্ট ইন্ডিয়া বলা হত। কলকাতা বন্দর হচ্ছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন ১২টি বৃহত্তর বন্দরের মাঝে একমাত্র নদী বন্দর। কলকাতা বন্দর গঙ্গার শাখা নদী হুগলীর বাম তীরে অবস্থিত। বিশ্বের অন্যান্য নদী বন্দরের মতো কলকাতা বন্দরও প্রতিষ্ঠার পর থেকে নাব্যতার সংকটে ভুগছে।
কলকাতা বন্দরের নাব্যতা ঠিক রাখার জন্য ১৯২০ সাল থেকেই শুরু হয় ড্রেজিং। ১৯২০ সালেই পলি তোলা হত বার্ষিক ৬০ লক্ষ ঘন মিটার। কলকাতা বন্দর মোহনা থেকে ২৩২ কিলোমিটার অভ্যন্তরে অবস্থিত। এ সুদীর্ঘ নেভিগেশন্যাল চ্যানেলে রয়েছে ধনুকের মতো অসংখ্য বাঁক এবং ১৮টির মতো চর। মি. আর্থার কটন কলকাতা বন্দর প্রতিষ্ঠার পর গঙ্গায় ব্যারেজ নির্মাণ করে হুগলিতে পানি এনে নাব্যতা সংকট দূর করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
১৯৫৭ সালে ভারত সরকার নদী বিশেষজ্ঞ হেনসনকে কলকাতা বন্দর রক্ষার বিষয়ে পরামর্শক নিয়োগ করেছিলেন। তিনিও মি. আর্থার কটনের অভিমত সমর্থন করে গঙ্গায় ব্যারেজ নির্মাণের পরামর্শই দিয়েছিলেন। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে জাহাজ পরিবহনের ক্ষেত্রে যখন বড় বড় জাহাজ এর আবির্ভাব ঘটল তখন কলকাতা বন্দর প্রায় অচল হয়ে পড়ার উপক্রম হলো কারণ তখন কলকাতা বন্দরে ড্রাফট হয়ে গেল ৬/৭ মিটার। ১০ মিটার ড্রাফট এর হলদিয়ায় তখন নতুন বন্দর ব্যবস্থার পত্তন করা হলো। ৬০ হাজার টন পর্যন্ত কার্গো নিয়ে জাহাজ হলদিয়ায় আসতে পারতো। আর কলকাতা বন্দরে জাহাজ আসতো ১৫ হাজার টন কার্গো নিয়ে।
এমন পরিস্থিতিতে ১৯৬২ সালে ভারত সরকার ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করল আর কাজ শেষ হলো ১৯৭৪ সালে। গঙ্গার পানি হুগলিতে এনেছে কিন্তু নাব্যতা সংকট দূর হয়নি। সমুদ্র থেকে ২৩২ কিলোমিটার অভ্যন্তরে যে বন্দরের অবস্থান তাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা যে অবান্তর সে কথাটা পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার তখন বলেনি। এই বাঁধের ফল হয়েছে উজান থেকে প্রচুর পানি উত্তর ভারতে সরানোর সুবিধা হয়েছে আর বর্ষা মৌসুমে বিহারে বন্যার প্রাদুর্ভাব হচ্ছে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী গত বর্ষায় দীর্ঘস্থায়ী বন্যার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারস্থ হয়েছিলো এবং গঙ্গা বাঁধ ভেঙে দেওয়ার প্রস্তাবও করেছিলেন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন প্রথম ক্ষমতায় আসে তখন ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গা চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। চুক্তিটি সম্পাদনের বিষয়ে তৎকালীন পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু সহায়তা প্রদান করেছিলেন খুবই আন্তরিকভাবে। এ চুক্তির মূখ্য কথা ছিল শুস্ক মৌসুমে গঙ্গার প্রবাহমান পানি সমান ভিত্তিতে উভয় দেশ পাবে। এ চুক্তিটি সম্পাদন করা হয়েছে বিশ বছর অতীত হয়েছে কিন্তু বাংলাদেশের যে পানি পাচ্ছে তা দিয়ে বাংলাদেশের প্রয়োজন মিটছে না। পদ্মায় চর পড়েছে আর ভাটি অঞ্চলের নদীগুলোতেও পলিতে জমে তার স্বাভাবিক গতি ক্ষীণ হয়ে আসছে এবং সমুদ্রের লোনা পানি দ্রুত উজানের দিকে চলে আসছে।
খুলনা অঞ্চলের ভৈরব নদী আর পশুর নদীতে তার প্রতিক্রিয়ায় হয়েছে খুবই বেশি। মংলাকে সচল রাখতে নিয়মিত মেনটেন্যান্স ড্রেজিং এবং মাঝে মাঝে ক্যাপটাল ড্রেজিং এর প্রয়োজন হচ্ছে। ফারাক্কা চুক্তিতে বাঁধের কথা বলা হয়েছে বাংলাদেশ যদি পদ্মায় বাঁধের ব্যবস্থা করে পানির সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী না হয় তবে পশুর নদীর নাব্যতা রক্ষার কাজ ১৫/২০ বছরের মাঝে খুবই ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়াবে। তখন মংলা বন্দর বিরাট লোকসানী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। তার আয় দিয়ে তার ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে না। ড্রেজিং খুবই ব্যয়বহুল বিষয়।
বাংলাদেশ সরকার চীনের সঙ্গে চীনের রাষ্ট্রপতির বাংলাদেশে সফরের সময় স্ট্যাটেজিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট করেছেন। ভারতের গত কিছুদিনের তৎপরতায় মনে হচ্ছে ভারত সরকার এতে বিচলিত হয়েছে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে কোনও একটা ভারসাম্যহীন এগ্রিমেন্ট করতে তৎপর হচ্ছে। যে কারণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সফর স্থগিত করাতে তারা আরও উদ্বিগ্ন হয়েছেন।
আমার ধারণা যদি সঠিক হয় তবে তিস্তার পানি চুক্তি আরও কঠিন হয়ে যাবে মমতার বিরোধিতার উসিলার সঙ্গে মোদি সরকারের উপেক্ষা করতে প্রয়াস সংযুক্ত হবে। এমন পরিস্থিতিতে মনে হয় বাংলাদেশ সরকারকে আরও বেশি কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। ভারত আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু। বাংলাদেশ সরকার এখন এমন কিছু নেই ভারতের স্বার্থে করছে না। তৃতীয় চ্যানেলেও ভারতকে সেটা অনুধাবনের উদ্যোগ নিতে হবে। এতেও যদি কাজ না হয় বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক ফোরামে, সংস্থায় বিষয়টির সমাধান নিয়ে তৎপর হওয়া, যেভাবে সমুদ্রসীমা নিয়ে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে সমাধান পেয়েছে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং কলাম লেখক