X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

নামে কিছু যায় আসে, আবার যায় আসেও না

তসলিমা নাসরিন
২৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৭:৫৯আপডেট : ২৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৮:১৪

তসলিমা নাসরিন মানুষ বিচিত্র। শান্তি যেমন ভালোবাসে, অশান্তিও বাসে। সে কারণেই চারদিকে অশান্তি। সবাই যদি শান্তি ভালোবাসতো, তাহলে পৃথিবীটা শান্তিময় হত। আজও পৃথিবীতে থেকে থেকে অশান্তি উথলে ওঠে। চিরকালই এমন হয়েছে। কিছু লোক শান্তির জন্য চেষ্টা করে আর কিছু লোক অশান্তি সৃষ্টি করতে ছুটোছুটি করে। পৃথিবী ধ্বংস করার লোকের যেমন অভাব নেই, পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাবার লোকেরও অভাব নেই। পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে যারা বাঁচাচ্ছেন, তাদের প্রতি আমাদের, আমরা যারা বেঁচে আছি, কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
হিটলারের মানবতাবিরোধী মতবাদের বিরুদ্ধে আমরা শুভবুদ্ধির মানুষ দাঁড়িয়েছি। সবাই কিন্তু দাঁড়ায়নি। নানা দেশে, নানা অঞ্চলে দেখি হিটলারের সমর্থক। শুধু ইউরোপে নয়, এশিয়ায় আফ্রিকাতেও দেখি হিটলারের পক্ষে লোক কথা বলছে। মানবতা সবাই মানে না। হিংস্রতার প্রতি কিছু মানুষের আকর্ষণ দুর্দম্য।
অনেকে তাদের সন্তানের নাম রেখেছে হিটলার। অস্ট্রিয়ায় বা জার্মানিতে নয়, ঘটনা ঘটেছে ভারতবর্ষে। বাদামি অনার্যের নাম হিটলার। কালো মুখ কালো চুলের নাম হিটলার। ভারতবর্ষেই কারো কারো নাম শুনেছি স্টালিন। হিটলার আর স্টালিনের ভারতীয় ভক্তরা তাদের পুত্র সন্তানের নাম রেখেছে তাদের গুরুর নামে। বর্বরতাকে মহিমান্বিত করার লোক বিশ্ব সংসারে নেহাত কম নয়।
ইদানিং চিত্রতারকা কারিনা কাপুর আর তার স্বামী সাইফ আলী খান পতৌদি কেন তাদের পুত্রের  নাম তৈমুর রাখলেন, এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা হচ্ছে। ওদের বিয়েটা হিন্দু-মুসলমানের বিয়ে। যখন দুই ধর্মের লোকের মধ্যে বিয়ে হয়, আমি ভেবেই বসি ওরা ধর্ম মানেন না, ওরা আস্তিক নন, ধর্মের প্রতি ওদের মোহ বা বিশ্বাস কিছু নেই। কিন্তু একসময় দেখি স্বামী বা পুরুষ তার নিজের ধর্ম এবং বিশ্বাস তার স্ত্রী এবং সন্তানের ওপর চাপাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, আপাতদৃশ্যে নারীর অধিকারে তারা বিশ্বাস করেন বলে মনে হলেও বাস্তবে যে করেন না, তার প্রচুর প্রমাণ আছে।

কারিনা কাপুরকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়েছে, তার পুত্র সন্তানের নাম এখন তৈমুর আলী খান পতৌদি পিতৃতান্ত্রিক নিয়মকে মেনে নেয় শিক্ষিত স্বনির্ভর নারীরাও। সাইফ আলী খানের মা শর্মিলা ঠাকুরও মেনে নিয়েছিলেন। কারিনাও মেনে নিচ্ছেন। তৈমুরের নামে কেন আলী খান পতৌদি থাকবে, কেন কাপুর থাকবে না এই প্রশ্নটি ওঠা স্বাভাবিক। তৈমুর যতটা তার বাবার, ঠিক ততটাই তো তার মায়ের। অনেকে বলবে কারিনার 'কাপুর' উপাধিটি তো কারিনার বাবার থেকে পাওয়া, পিতৃতন্ত্র তো শুধু আলী খান পতৌদিতে নেই, কাপুরেও আছে। তা আছে বৈকি। কিন্তু কিছুটা কম আছে। বেশি থেকে কম, কম থেকে শূন্য – বিলুপ্ত হওয়ার প্রক্রিয়া এভাবে ধাপে ধাপে এগোতে পারে। আমি অবশ্য পারিবারিক নাম বা উপাধির একেবারেই পক্ষে নই। যে যার নামে পরিচিত হবে, এই তো চাই। যেমন আমি। আমার নাম। আমি আমার বাবা এবং মা’র সন্তান, কিন্তু আমি একজন পৃথক ব্যক্তি বটে। এই ব্যক্তিসত্তাই আমার পরিচয়। সবাই তো তাই। আইস্ল্যান্ডিক মানুষের নামে বাবা মা দুজনের  চিহ্নই থাকে, যেমন এরিক আর মারিয়ার মেয়ের নাম যদি হয় সুজান, তবে সুজানের ভালো নাম হবে সুজান এরিকডটির। এরিক আর মারিয়ার ছেলের নাম যদি জন হয়, তবে জনের ভালো নাম হবে জন এরিকসান। আজকাল বাবার মেয়ে বা বাবার ছেলে হিসেবে পরিচিত হতে চাইছে না অনেকে, মায়ের ছেলে বা মায়ের মেয়ে হিসেবে পরিচিত হতে চাইছে। সুজান বলছে তার নাম সুজান মারিয়াডটির, জন বলছে তার নাম জন মারিয়াসান। সুজান এবং জন দুজনই নিজেদের এরিকের পুত্র এবং কন্যা না বলে বলছে তারা মারিয়ার পুত্র এবং কন্যা। এরকমও হতে পারে-- সুজান এরিকমারিয়াডটির এবং জন এরিকমারিয়াসান। সমাজকে তো বদলাতে হবেই। একসময় পিতৃতন্ত্রের চেয়ে স্বাতন্ত্রই হয়ে উঠবে প্রয়োজনীয়। সায়েন্স ফিকশানে যা দেখি, তা-ই হয়তো ভবিষ্যতে ঘটবে, মানুষের নাম বলতে কিছু থাকবে না, যা থাকবে তা নাম্বার।

তৈমুর নামটি কেন রাখা হলো, তৈমুর তো ছিল এক বর্বর যুদ্ধবাজের নাম। এই অভিযোগ শুনে কেউ কেউ বলছে, নাম তো নামই, যে কেউ যে কোনও নামই রাখতে পারে। তৈমুর নামের অর্থ ইস্পাত, ব্যস। নামটি কোনও বদ লোকের ছিল কী না, সেটি দেখা অনুচিত। এক খারাপ লোকের নাম তৈমুর ছিল, প্রচুর ভালো লোকের নামও তৈমুর ছিল।

ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্র বলেছেন, 'কার নাম তৈমুর বা কংস রাখা হবে, সেটা তার বাবা মায়ের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এ নিয়ে বিতর্ক অর্থহীন। মধ্য এশিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে তৈমুর লঙ এক জন বড় শাসক। তার সুসংহত সাম্রাজ্য ছিল। এ কথা ঠিক, তিনি ভারতে এসেছিলেন লুঠপাট করতে। কিন্তু শাসনব্যবস্থা থেকে মনসবদারি প্রথা— অনেক বিষয়েই তার অবদান রয়েছে'।

আর এক ইতিহাসবিদ সুগত বসু বলেছেন, 'তৈমুর একটি সুন্দর নাম। ইসলামিক জগতে নামটির যথেষ্ট প্রচলন আছে। একজন তৈমুর মধ্য এশিয়ায় সাম্রাজ্য তৈরি করেছিলেন। দিল্লি আক্রমণও করেন। তার সঙ্গে নামের কী সম্পর্ক?' তুর্কি শব্দ ‘তৈমুর’-এর অর্থ লোহা।

সাইফ আলী খান নিজের ছেলের নাম তৈমুর রেখেছেন ইতিহাসের যুদ্ধবাজ সন্ত্রাসী তৈমুর লঙ-এর চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে? নাকি তৈমুর শব্দের অর্থটি তার ভালো লেগেছে? সাইফ আলী ইতিহাস ভালো জানেন, তাহলে হয়তো তৈমুর লঙ এর চরিত্রই তাকে মুগ্ধ করেছে। ১৩৯৮ সালে দিল্লি দখল করে লক্ষাধিক মানুষকে খুন করা, দেদার লুঠপাটে একাধিক শহর শ্মশান করে দেওয়া তুর্কি-মোঙ্গল শাসক তৈমুর লঙের কথা ভুলে যাননি সাইফ। তৈমুরের সাম্রাজ্য ছিল আফগানিস্তান, পারস্য, বাগদাদ সহ বিরাট অংশ জুড়ে। ১৩৯৮ সকালে সিন্ধু নদ পেরিয়ে মারাঠা হয়ে দিল্লি দখল করেছিলেন। অন্তত এক লক্ষ ভারতীয় বন্দিকে খুন করেছেন। ধুলোয় মিশিয়ে দেন দিল্লি, শোনায় যায়। ছিন্নমুণ্ডুগুলো স্তম্ভের আকারে সাজিয়ে দিয়েছিল তার সেনা, লুঠ হয় বিপুল সম্পদ।

অনেকে যেমন হিটলারের বর্বরতার কথা জেনেই হিটলারকে পছন্দ করে, অনেকে তেমন তৈমুর লঙের বর্বরতার কথা জেনেই তাকে পছন্দ করে। সাইফ আলী খান একবিংশ শতাব্দির মানুষ বলে, তিনি ভারতীয় বলে, হিন্দুর সঙ্গে পাশাপাশি বাস করেন বলে, তার মাতৃদেবী এককালে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন বলে তিনি তৈমুর লঙের হিন্দু হত্যাযজ্ঞ পছন্দ করবেন না, এ কোনও কথা নয়। পছন্দ করেই হয়তো ইতিহাস থেকে তৈমুর নামটি তুলে নিয়ে পুত্রকে দিয়েছেন। কারিনা তো বলেইছেন, সাইফ ইতিহাসবিদ। ইতিহাসবিদ হয়তো প্রার্থনা করেছেন-- তার পুত্র যেন তৈমুর লঙের মতো প্রভাবশালী হয়, ক্ষমতাশালী হয়, এ হতে গিয়ে তাকে যদি হিন্দু বিদ্বেষী হতে হয় হবে, বর্বর হতে হয়, নিষ্ঠুর হতে হয়, অমানবিক হতে হয় হবে।
আগেই বলেছি মানুষ বিচিত্র। তুমি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির লোক বলেই তুমি মানবতন্ত্রে বিশ্বাস করো, তা কোনও যুক্তির কথা নয়। চারদিকে তৈমুর নাম নিয়ে এত চিৎকার চেঁচামেচি, তারপরও আমি বিশ্বাস করতে চাই, সাইফের তৈমুর নামটি ভালো লাগে কারণ তৈমুর নামটির অর্থ ইস্পাত। সাইফ কোনও যুদ্ধবাজ খুনিকে পছন্দ করেন না। 

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মা হারালেন বেবী নাজনীন
মা হারালেন বেবী নাজনীন
এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের কল্যাণ ট্রাস্ট খাতে বছরে ঘাটতি ৫৬০ কোটি টাকা
নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ৬১ হাজারের বেশি আবেদনএমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের কল্যাণ ট্রাস্ট খাতে বছরে ঘাটতি ৫৬০ কোটি টাকা
দুই বাসের রেষারেষিতে ট্রাফিক কনস্টেবল আহত
দুই বাসের রেষারেষিতে ট্রাফিক কনস্টেবল আহত
কৃষি জমি রক্ষায় ভূমি জোনিং ও সুরক্ষা আইনের খসড়া চূড়ান্ত পর্যায়ে: ভূমিমন্ত্রী
কৃষি জমি রক্ষায় ভূমি জোনিং ও সুরক্ষা আইনের খসড়া চূড়ান্ত পর্যায়ে: ভূমিমন্ত্রী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ