X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

হিন্দি চলচ্চিত্র ও সুলতান সুলেমানের জনপ্রিয়তা

মো. হারিছুর রহমান
২৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ১২:৫১আপডেট : ২৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ১২:৫২

মো. হারিছুর রহমান নির্বাক চলচ্চিত্র যুগে আমেরিকান ও ইউরোপীয় সিনেমা অবিভক্ত ভারতবর্ষের বাজার দখল করে রেখেছিল। ভারতবর্ষে চলচ্চিত্র নির্মাণ নির্বাক যুগে শুরু হলেও ১৯৩০-এর দশকে সবাক চলচ্চিত্র আসার আগে ভারতীয় চলচ্চিত্র তেমন কোনও শক্ত অবস্থানে পৌঁছাতে পারেনি। তবে শব্দ সংযোজনের ফলে, দর্শকের কাছে চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে আরও অর্থবহ ও জীবনঘনিষ্ঠ। চলচ্চিত্রে শব্দ সংযোজন প্রযুক্তির ফলে অবিভক্ত ভারতবর্ষে চলচ্চিত্রের প্রসার লাভ করতে থাকে। সবাক চলচ্চিত্রের প্রথম দশকেই বিদেশি চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী প্রায় ১০% কমে যায়, এবং কোনও রকম রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই মুম্বাই, কলকাতা, মাদ্রাজ, লাহোর ও পুনেতে চলচ্চিত্র শিল্পের ব্যাপক প্রসার লাভ করতে থাকে। চলচ্চিত্রে শব্দ সংযোজন একদিকে যেমন একে আরও অর্থবহ করে তুলেছে, অন্যদিকে তা বিভিন্ন ভাষাভাষী দর্শকদের মাঝে বিভাজন টেনে দিয়েছে। যেহেতু ভারতবর্ষ ভাষাগত দিক থেকে বিভক্ত, চলচ্চিত্রের ভাষাও অঞ্চলভেদে বিবিধ হয়ে পড়ে। চলচ্চিত্রের নির্দিষ্ট ভাষাভাষীর এই সূত্র হিন্দি ছাড়া প্রায় সবভাষার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। হিন্দি ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী যেহেতু অন্য যেকোনও ভাষাভাষীর জনগোষ্ঠী থেকে সংখ্যায় বেশি, তাই ভারতবর্ষে প্রথম থেকেই হিন্দি ভাষার চলচ্চিত্র তৈরি হতো বেশি। সবাক চলচ্চিত্রের প্রথম বছরে অর্থাৎ ১৯৩১ সালে সারা ভারতবর্ষে ২২টি হিন্দি ভাষার চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, সেখানে মাত্র তিনটি বাংলা ও একটি তামিল ভাষার চলচ্চিত্র তৈরি হয়। কিন্তু কিভাবে হিন্দি সিনেমা ভারতবর্ষে এত আবেদন তৈরি করতে সক্ষম হয়, যা পরবর্তীকালে অন্য ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী ও সংস্কৃতির কাছে হেজেমনিক হয়ে ওঠে?
হেজিমনি প্রত্যয়টি মূলত জোর-জবরদস্তির পরিবর্তে অন্তঃস্থকরণ, অন্তর্ভুক্তিকরণ ও যৌথতার মধ্য দিয়ে অভিমত অর্জনকে বোঝায়। অন্য কথায় এটি বিবিধ প্রকার প্রতীকী উৎপাদনরীতি—যেমন, শিক্ষা ও আচারগত প্রক্রিয়া‌, সামাজিকীকরণের ধরন, রাজনৈতিক ও আইনি রীতিনীতি, জীবনাচারণের রীতিনীতি, আত্ম-পরিবেশন, গণ-যোগাযোগ, স্বাস্থ্য ও শারীরিক শৃঙ্খলা ইত্যাদির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপকে বোঝায়। শাসকশ্রেণি অথবা  বস্তুগত কর্তৃত্ব স্থাপন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক নেতৃত্ব স্থাপনের মধ্য দিয়ে হেজেমনিক হয়ে ওঠে। বস্তুগত কর্তৃত্ব এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক নেতৃত্বের কোনও একটিতে কোনও ধরনের পরিবর্তন হলে শাসকশ্রেণির হেজেমনি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়।

যাহোক, হিন্দির নিজস্ব বিশাল বাজারের পাশাপাশি হিন্দি সিনেমার ‘ইসলামিকেট’ প্রক্রিয়া হিন্দি-উর্দু চলচ্চিত্রকে ভারতবর্ষের অ-হিন্দি ভাষাভাষী অঞ্চল এবং মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল যেমন পূর্ববঙ্গ বা বর্তমান বাংলাদেশে মুসলিম জনগোষ্ঠীর মাঝে জনপ্রিয় করে তোলে। ‘ইসলামিকেট’ কথাটি সরাসরি ইসলামধর্মকে নির্দেশ করে না, এটি বরং একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমগ্রকে নির্দেশ করে, যা ইসলাম ও মুসলমানদের সঙ্গে সম্পর্কিত। ইসলামিকেট প্রত্যয়টি প্রথমে মার্শাল হগসন তার ‘ভেঞ্চার অব ইসলাম’ নামক বইয়ে উল্লেখ করেন। মুকুল কেশভন হগসনের প্রত্যয়টিকে বলিউড সিনেমায় ইসলামিকেটের ব্যবহার নিয়ে বলেন, ভারতবর্ষে বিশেষ করে উত্তর ভারতের অযোধ্যা ও লখনৌ নবাবদের ইসলামিকেট সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারা ঔপনিবেশিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে হেজিমনিক হিসেবে ধরা দিয়েছিল। যার ফলে, ঔপনিবেশিক ও ঔপনিবেশোত্তরকালে হিন্দি চলচ্চিত্র নির্মাতারা ইসলামিকেট সাম্রাজ্যের হেজিমনিক ভাষা থেকে শুরু করে নবাবদের জীবনধারা, হেরেমখানা ও তাওয়াইফদের কার্যকলাপ তুলে ধরেছেন। হিন্দি চলচ্চিত্রে ইসলামিকেট ভাষার ব্যবহার চলচ্চিত্রে শব্দ সংযোজনের শুরু থেকেই হয়ে আসছে এবং আজও তা চলমান। আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। বিভিন্ন আরবি-ফারসি শব্দ যেমন পেয়ার, ইশক, মোহাব্বাত, দিল, কানুন, ইনসাফ, ইজ্জত, ফারজ, খুন, যাজবাত, জুরম, দৌলত হিন্দি সিনেমার কেন্দ্রিয় প্রত্যয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

শুরু থেকেই হিন্দি চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মাঝে মধ্য প্রাচ্যের রুপকথা নির্ভর চলচ্চিত্র তৈরি করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তারই ধারাবাহিকতায় আলিবাবা ও চল্লিশ চোর (১৯০৩), গুলে বাকাওয়ালী (১৯২৪), হাতিম তাই (১৯২৯),আলম আরা (১৯৩১), শিরি ফরহাদ (১৯৩১), লায়লা মজনু (১৯৩১), চাহার দরবেশ (১৯৩৩)-এর মতো চলচ্চিত্র তৈরি হয়। এসব পারস্য-আরবীয় রূপকথা বাংলা অঞ্চলেও ছিল সমানভাবে জনপ্রিয়। অধিকাংশ গল্প এখানে যেমন অনূদিত হয়েছে, তেমনি গল্পগুলো স্থানিক রূপ ও চরিত্র লাভ করেছে। কাজেই ইসলামিকেট রূপকথানির্ভর হিন্দি চলচ্চিত্র এ অঞ্চলে সহজেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

ইসলামিকেট ঐতিহাসিক হিন্দি চলচ্চিত্র যেমন মির্জা গালিব (১৯৫৪), মোঘলে আজম (১৯৬০) ও হেরেমনির্ভর চলচ্চিত্র যেমন পাকিজা (১৯৭১), উমরাওজান (১৯৮১) সর্বভারতীয় আবেদন তৈরিতে সক্ষম হয়। চলচ্চিত্র যেমন মোঘলে আজমে ইসলামিকেট পোশাকি জাঁকজমক থেকে শুরু করে মোঘল স্থাপত্যের জৌলুস—সবই দর্শকের কাছে আবেদনময় হয়ে ওঠে। ইসলামিকেট কাহিনি ও সংস্কৃতির পাশাপাশি ইসলামিকেট সঙ্গীত যেমন গজল, কাওয়ালি হিন্দি চলচ্চিত্রকে অ-হিন্দিভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মাঝে জনপ্রিয় করে তোলে। কুন্দানলাল সায়গাল থেকে শুরু করে মেহেদি হাসান, গুলাম আলী, অনুপ জালোটা, পঙ্কজ উধাস, জগজিৎ সিং, চিত্রা সিং-এর গজলের জনপ্রিয়তা দেখে সহজেই ইসলামিকেট সঙ্গীতের আবেদন অনুভব করা যায়। হিন্দি চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তা ভারত ভাগোত্তর বিভিন্ন কলাকুশালীর মুম্বাইয়ে অভিবাসনের সঙ্গেও সম্পৃক্ত। অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হওয়ার অনেক গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে মুম্বাইয়ে পাড়ি জমান। হেমন্ত কুমার, এসডি বর্মন, সলীল চৌধুরীর মতো কলাকাররা ১৯৪০ ও ১৯৫০-এর দশকে কলকাতা থেকে মুম্বাইয়ে পাড়ি জমান এবং সঙ্গে করে তারা ফোক মিউজিকও নিয়ে যান। যা তারা হিন্দি সিনেমায় ব্যবহার করেন। ফলে হিন্দি সঙ্গীত বাংলা অঞ্চলের লোকজনের কাছে আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

কেশভনের মতে, ইসলামিকেট ভাষা, বিশেষ করে আরবি ফারসি মিশ্রিত সুরেলা উর্দু শব্দ, কাব্যিক রূপ, হিন্দি সিনেমাকে আরও আবেগঘন করেছে দর্শকদের কাছে। ভাষার চেয়েও নবাবদের ইসলামিকেট সাম্রাজ্য ও জীবনধারা সাধারণ মানুষের মনে বাস্তব এক সুখানুভূতি রূপে ধরা দেয়, যেখানে তারা সিনেমার বা সিরিয়ালের মাধ্যমে নবাবদের দুর্গ ভেদ করে, অন্দরহমলে উঁকি দেয়। যেখানে তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। যে জীবনে থাকে উত্থান-পতন, প্রেম, ভালোবাসা, অ্যাডভেঞ্চার, সাস্পেন্স, ক্ল্যাইম্যাস্ক।

নবাবি, সুলতানি সাম্রাজ্যে ইসলাম, মুসলিম ও ইসলামিকেট সংস্কৃতির বিভাজনকে অস্পষ্ট করে দেয়। যেখানে ধর্ম ও ইসলামিকেট সংস্কৃতি হাতধরাধরি করে চলে। এই ইসলামিকেট সাংস্কৃতিক চর্চাকেন্দ্র যেমন হেরেমখানা দর্শকদের কাছে আকর্ষণীয় রূপে ধরা দেয়। হেরেমখানা পাবলিক ও প্রাইভেট পরিসরের বিভাজনকেও অস্পষ্ট করে দেয়। দর্শক ইসলামিকেট সংস্কৃতির মাঝে খুঁজে পায় মুসলমানদের হারানো গৌরবগাথা, বিরত্বগাথা যা ইসলামকে ছড়িয়ে দিয়েছে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে। ভিজুয়্যালে দেখানো মোগল, নবাব কিংবা সুলতান সুলেমানের জীবনধারা, হেরেম, পোশাক-আশাক, নাম, চলন-বলন বাস্তবের চেয়ে আরও বাস্তব (অধিবাস্তব) রূপে ধরা দেয়। সাংস্কৃতিক হেজিমনির জন্য নবাবি কিংবা সুলিমানি ইতিহাস ঔতিহ্য হয়ে যায় আধুনিকতার স্মারক। তাই আমরা দেখি, বলিউডের ইসলামিকেট পোশাক আমাদের হাল ফ্যাশন হয়ে যায়। সে বিবেচনায় সামনের ঈদে হুররাম ড্রেস কিংবা সুলেমানি পাঞ্জাবিতে ঈদ বাজারের দেখা গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এ পোশাকি আধুনিকতার সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক বিরোধিতার নয় বরং সহযোগিতার।

লেখক: বাংলাদেশে ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রবাহ, জনপ্রিয়তা ও প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন।

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ