X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন: শেখার আছে অনেক কিছু

চিররঞ্জন সরকার
২৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৩:১০আপডেট : ২৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৩:১২

চিররঞ্জন বন্ধুর বাড়িতে দাওয়াত খেতে গেছেন এক পেশাদার সমালোচক। বন্ধুর বউয়ের রান্নার হাত খুব ভালো। মেহমান খাওয়াবেন বলে তিনি আরও গভীর মনোযোগ দিয়ে রান্না করলেন। অতিথিকে নিয়ে খেতে বসলেন। খেতে খেতে গৃহকর্তা অতিথিকে জিজ্ঞেস করলেন, কিরে রান্না কেমন হয়েছে? অতিথি সমালোচক মানুষ, তিনি বললেন, ভালো, তবে তরকারিতে লবণটা বেশি হলে খারাপ হতো। আরেকটি কথা, এত ভালো ভালো নয়!
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে বিএনপির প্রতিক্রিয়া দেখে উল্লিখিত গল্পটার কথাই মনে হচ্ছে। এমন নির্বাচনকেও তারা কোনও সমালোচনা ছাড়া মেনে নিতে পারলো না! পরাজয় মেনে নেওয়া, বিজয়ীকে অভিনন্দন জানানোর মানসিকতা ছাড়া আমরা কিভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করব?
তবে বিএনপি যাই বলুক, ইচ্ছে ও আন্তরিকতা থাকলে যে একটি ভালো নির্বাচন করা যায়, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আমরা আবারও তা দেখলাম। প্রকৃতপক্ষে এই নির্বাচন নিয়ে বিএনপিও তেমন কোনও খুঁত ধরতে পারেনি। পারেনি বলেই ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’ নামক এক বায়োবীয় শব্দের কাছে আশ্রয় নিতে হয়েছে। সেই সরকার, সেই প্রশাসন, সেই নির্বাচন কমিশনের দ্বারাই এটা সম্ভব হলো। একটি নির্বাচন কতটা অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হবে—তার অনেকখানি নির্ভর করে সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষতার ওপর। নারায়ণগঞ্জে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা পক্ষপাতমূলক ছিল না এবং সেখানে নির্বাচনি কর্মকাণ্ডে দায়িত্বপ্রাপ্তরাও চাপমুক্তভাবে দায়িত্ব পালন করতে পেরেছেন। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের এটিই সবশেষ বড় নির্বাচন। ফলে তারাও চায়নি শেষ মুহূর্তে এসে কোনও বিতর্কে জড়াতে। কেননা আগের অনেক নির্বাচনেই এই কমিশন বিতর্কিত ও সমালোচিত হয়েছে। আওয়ামী লীগও এই সময়ে আর বিতর্কিত হতে চায়নি। ফলে তারাও সর্বোচ্চ সংযম, সচেতন ও সতর্ক থেকেছে। বিএনপিও এই নির্বাচনে ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে অংশ  নিয়েছে। তারা ‘অবৈধ’ সরকারের ‘নির্লজ্জ’ ও ‘পুতুল’ নির্বাচন কমিশনের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুক্ত থেকেছে।
অনেকে মনে করছেন, বিএনপিকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নির্বাচনি মাঠে নিয়ে-আসার জন্যই ‘নারায়ণগঞ্জ মডেলের’ নির্বাচন ক্ষমতাসীনদের একটি রাজনৈতিক কৌশল মাত্র। আগামী নির্বাচনে বিএনপি মাঠে এলেই শুরু হবে ‘ফাউল গেম।’ যেহেতেু তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামক ‘রেফারি’ আর নেই, কাজেই ‘ফাউল’ করেও জয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে তেমন কোনও বাধা থাকবে না। এখানে একটা কথা বলা ভালো, আওয়ামী লীগ অবশ্য আইভীর জনপ্রিয়তা ও বিজয় সম্পর্কেও নিশ্চিত ছিল। অন্য কোনও প্রার্থী হলে তারা এই ঝুঁকি নিতো বলে মনে হয় না। কারণ এই নির্বাচনে হারলে সবাই বলত, সরকারের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। বিরোধীদলও এতে চাঙ্গা হয়ে ওঠার সুযোগ পেতো। এখন অন্তত কেউ আর ক্ষমতাসীন দল সম্পর্কে এমন কথা বলতে পারবে না।
যা হোক, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশেনের নির্বাচন আমাদের দেশে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতিধারায় কতটুকু কী প্রভাব ফেলে, সেটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। এ ব্যাপারে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার মতো উপাদান সত্যিই কি আছে? তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের চেয়ে আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলের মানসিকতা পরিবর্তন করা দরকার। নির্বাচনের রায়কে মেনে নেওয়ার মানসিকতায় সবার আগে সৃষ্টি করা দরকার। যে জিনিসটা আমাদের মধ্যে নেই বললেই চলে। মূল সমস্যা আমাদের মানসিকতায়। আমরা সব কিছুর সমালোচনা করি। নিজের পক্ষে না এলে কোনও কিছুই গ্রহণ করি না। অজপাড়া-গাঁয়ের সেই একরোখা লোকটার সালিশি মানার গল্পটার মতোই আমাদের দেশের রাজনীতিকদের মানসিকতা। সিদ্ধান্তটা আগেই নির্ধারণ করে সালিশের মজলিশে যান তিনি। তারপর বলেন, সবই মানি, স্বীকারও করি কিন্তু তালগাছটা আমার! আমাদের রাজনীতিতেও সেই প্রথাই চলছে। এখানে নির্বাচনকে তখনই সুষ্ঠু হিসেবে মানা হয়, যখন তারা বিজয়ী হন। তাদের নির্বাচনটা হারের জন্য নয়, বিজয়ের জন্য। নির্বাচনের আগের দিন, এমনকি নির্বাচনের দিনও নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। কিন্তু বিজয়ী হলে সুর বদলে যায়। তখন বলা হয়, নির্বাচনের ফল পাল্টে দেওয়ার একটা গভীর চক্রান্ত হয়েছিল বটে, তবে ভোটাররা তা রুখে দিয়েছে!

এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কথা। বরিশালের আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী শওকত হোসেন হিরন। রাত দু’টায় তিনি বরিশাল রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, প্রশাসন উদ্দেশ্যমূলকভাবে তার  ফল ছিনতাইয়ের চেষ্টা করছে। তাই ঘোষণার আগেই তিনি ফল প্রত্যাখ্যান করলেন। এর পর দেখা গেল তিনি জিতে গেছেন। ব্যস, রাত পেরিয়ে সকাল হতে না হতেই প্রত্যাখ্যাত ফল সাদরে গ্রহণ করে হিরন প্রমাণ করলেন, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।

প্রথমে কারচুপির অভিযোগ ও পরে বিজয়ের পর তা মেনে নেওয়ার ইতিহাস আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়।
’৯১ সালে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে যাওয়ায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন অভিযোগ করেছিলেন যে, নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে। এরপর ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ জিতে যখন ক্ষমতায় গেল তখন আর কারচুপির অভিযোগ করলেন না জননেত্রী। কিন্তু সমস্যা হলো ২০০১ সালের নির্বাচনে। নির্বাচনের দিন বিকেলে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া আলাদা আলাদাভাবে সংবাদ সম্মেলন ডেকে পরস্পরের বিরুদ্ধে কারচুপির অভিযোগ আনলেন। নির্বাচনে যখন চার দলের বিপুল বিজয় হলো তখন খালেদার অভিযোগ আর নেই। তবে শেখ হাসিনা বললেন। স্থূল কারচুপি হয়েছে নির্বাচনে। অর্থাৎ নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার প্রথম শর্ত হলো নির্বাচনে জয়লাভ করা। জিতলে সুষ্ঠু আর হারলে কারচুপি, আঁতাত কিংবা নীলনকশা।

আমাদের দেশে বড় রাজনৈতিক দলগুলোতে ক্ষমতার লোভ বেশি। নিজেদের স্বার্থ হাসিলে, রাজনৈতিক ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার দিকেই তাদের নজর থাকে বেশি। এ কারণে নির্বাচনে কোনও পক্ষ পরাজিত হলে সূক্ষ্ম কারচুপি, ঢালাও কারচুপির কথা আসে। সংসদ বয়কট করে সংসদীয় গণতন্ত্রকে অকার্যকর করে রাখা, গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক পথ এড়িয়ে লাগাতার হরতাল, জ্বালাও পোড়াও রাজনৈতিক-সহিংসতা-সন্ত্রাস-এসবের আশ্রয় নিয়ে থাকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষগুলো। যে দল সরকারে থাকে, তারা দমন-নিপীড়ন, মামলা ইত্যাদির মাধ্যমে বিরোধী পক্ষকে দাবিয়ে রাখতে চায়। ফলে গণতন্ত্র, সুশাসন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় উভয় দিক থেকেই প্রতিবন্ধকতা আসে।

আমাদের দেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞতা হলো শিক্ষা না নেওয়ার শিক্ষা। আমরা ভুল থেকে শিক্ষা নেই না। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেই না। অভিজ্ঞতা থেকেও নয়। আমরা কেবল শিক্ষা দিতে চাই। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরশন নির্বাচনের সবচেয়ে শিক্ষা হলো, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ। প্রধান দলগুলোর অংশ নেওয়ার মাধ্যমেই সম্ভব কার্যকর নির্বাচন। এতে প্রাণ থাকে, আনন্দ থাকে, থাকে উৎসবের সমারোহ। এর বাইরে নির্বাচন পরিণত হয় প্রহসনে। কাজেই আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রধান সব দলের অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি জরুরি।

নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনে ভোটাররা তাৎপর্যপূর্ণ একটি বার্তা দিয়েছে দেশের জন্য, রাজনীতিকদের জন্য। সাধারণভাবে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি মানুষের নানা ক্ষোভ বিক্ষোভ থাকে, থাকে নানা সমালোচনা। কিন্তু আইভীর পরিচ্ছন্ন, দুর্নীতিমুক্ত ইমেজ সেই সব ক্ষোভ-বিক্ষোভকে বড় করে তোলেনি। আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো এই বার্তাটুকু বিবেচনায় নিতে পারে।

নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনে সুস্থ রাজনীতির প্রতি মানুষের সমর্থন প্রকাশ পেয়েছে। কেউ কেউ সেখানে ‘ভাঁড়ের মতো’ আচরণ করে আলোচনায় থাকার চেষ্টা করলেও চূড়ান্ত বিচারে নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন আসলে পরিচ্ছন্ন, সৎ রাজনীতিকদের জন্য একটা গ্রিন সিগন্যাল।  

বিএনপিরও এই নির্বাচন থেকে শিক্ষা নেওয়ার আছে। রাজনীতির ইতিবাচক ধারায় অবশ্যই তাদের ফিরে আসতে হবে। বর্জন-প্রতিরোধ কিংবা জ্বালাও-পোড়াওয়ের ইমেজ থেকে তাদের বের হয়ে আসতে হবে। গণতন্ত্রে ক্ষমতা পরিবর্তন বা নিজের পছন্দের ব্যক্তির মাথায় মুকুট পড়াতে কিংবা অপছন্দের ব্যক্তিকে প্রত্যাখান বা জব্দ করতে নির্বাচন বা ভোটই হচ্ছে একমাত্র লাগসই অস্ত্র। এর কোনও বিকল্প নেই। কোনও, শর্টকাটও নেই।

ভোটারবিহীন নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সুযোগ কাউকেই দেওয়া যাবে না। নির্বাচনে অংশ নিয়েই নির্বাচন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার প্রক্রিয়া চালাতে হবে। দোষ-ত্রুটি-গলদগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে হবে। তাহলে জনগণও গায়ের জোরে টিকে থাকা অপশক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে।

প্রশ্ন হলো, আমাদের প্রিয় নেতানেত্রীরা এই শিক্ষাগুলো কাজে লাগাবেন কি?

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দুবাই হয়ে ট্রানজিট ফ্লাইট স্থগিত করলো এমিরেটস
দুবাই হয়ে ট্রানজিট ফ্লাইট স্থগিত করলো এমিরেটস
ঢাকা শিশু হাসপাতালে আগুন
ঢাকা শিশু হাসপাতালে আগুন
রাজশাহীতে বইছে তাপদাহ, হাসপাতালে বাড়ছে রোগী
রাজশাহীতে বইছে তাপদাহ, হাসপাতালে বাড়ছে রোগী
থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে বিমানবন্দরে বাস, প্রকৌশলী নিহত
থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে বিমানবন্দরে বাস, প্রকৌশলী নিহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ