X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘সালাম বাংলাদেশ, সালাম’

আবদুল মান্নান
২৭ ডিসেম্বর ২০১৬, ১১:৪৭আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০১৬, ১১:৫৪

আবদুল মান্নান কলকাতায় বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশনে কর্মরত আমার ছাত্র বিপ্লব মনসুর ডিসেম্বরের ১০ তারিখ শনিবার যখন ফোন করে জানালো এ বছর তারা বেশ বড় করে বাংলাদেশের ৪৫তম বিজয় দিবস উপলক্ষ করে পাঁচদিন ব্যাপী এক বিজয় উৎসবের আয়োজন করেছে এবং সেই উৎসবের প্রধান অনুষ্ঠানে, ১৬ ডিসেম্বর, তারা আমাকে মূল বক্তা হিসেবে চায়; তখন বেশ একটা শিহরণ অনুভব করলেও পরমুহূর্তে বিপ্লবকে বলি এত কম সময়ে আমার পক্ষে কলকাতা আসা সম্ভব হবে কী না জানি না কারণ দেশের বাইরে যেতে হলে আমাকে প্রধানমন্ত্রী হতে ছুটি মঞ্জুর করাতে হয়। মাঝখানে আবার একদিন ঈদে মিলাদুন্নবীর ছুটি। একদিন প্রধানমন্ত্রী কেবিনেট মিটিং নিয়ে সচিবালয়ে ব্যস্ত থাকবেন। এই অল্প সময়ে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ সম্ভব হবে তা মনে হয় না। তবে আমার অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তা, শিক্ষা সচিব মো. সোহরাব হোসেন আর শিক্ষামন্ত্রীর সহায়তায় প্রধানমন্ত্রীর হতে ছুটি মঞ্জুর হলো ১৪ তারিখ। সরকারি আদেশ জারি হতে সন্ধ্যা। কলকাতায় খবর পাঠালাম আসছি বাংলাদেশের বিজয় দিবসে।
বিদেশের মাটিতে নিজের দেশের কথা বলতে কার না ভালো লাগে। শুনেছিলাম ভারতে ঘণ্টা কয়েকের নোটিশ দিয়ে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পাঁচশত ও একহাজার টাকার নোট বাতিল করাতে আপামর জনগণ বেজায় দুরাবস্থাতে পরেছে। কোন কোন রাজ্যে পণ্যবিনিময় অর্থাৎ সেই প্রাচীন যুগের বার্টার ব্যবস্থাও নাকি চালু হয়েছে। ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহারও সীমিত। বিপ্লবকে ফোনে বলি কলকাতায় আমার হাত খরচও কি বার্টার ব্যবস্থায় চলবে? বিপ্লব অভয় দেয় চিন্তা করবেন না স্যার। আমরা আছি না? আজীবন সারা বিশ্বে ছাত্রদের এমন অভয় আর ভালোবাসা পেয়েছি। অন্য কোনও পেশায় থাকলে তেমনটি আশা করা যায় না। বিপ্লবের কথায় আশ্বস্ত হই। মোদি সরকারের এই নোট বাতিলের আকস্মিক সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষকে যে কত ভোগান্তিতে ফেলেছে তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। এই ছুটির সময় বাংলাদেশের পর্যটকদেরতো বটেই অন্যান্য দেশের পর্যটকদের ভারত ভ্রমণও কমেছে আশঙ্কাজনক ভাবে। ভারতের অর্থনীতিবিদরা মনে করেন এর প্রভাব বেশ খারাপ ভাবেই পড়বে ভারতের অর্থনীতির ওপর। কেউ কেউ মনে করেন অর্থনীতিতে মন্দা এখন সময়ের ব্যাপার। ইতোমধ্যে ভারতীয় গণমাধ্যম খবর দিয়েছে বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগকারিরা শেয়ার মার্কেট হতে দ্রুত পুঁজি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে।  

কলকাতায় নেমেই দেখি আমার পূর্বের পরিচিত হাই কমিশনের প্রোটোকল অফিসার শামস দাঁড়িয়ে আছে আমাকে রিসিভ করতে। না থাকলেও অসুবিধা হত না কারণ কলকাতায় আমরা আসা যাওয়া সেই ১৯৭২ সাল হতে। শামসের সহায়তা আর আমার কূটনৈতিক পাসপোর্টের কল্যাণে ইমিগ্রেশন পার হতে কয়েক মিনিট সময় লাগলো। এমনিতে কলকাতার নেতাজি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আগের যে কোনও সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেশি কর্মদক্ষ হয়েছে। বিমানবন্দরেও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। সেই তুলনায় আমাদের ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিন দিন তার জৌলুস হারিয়েছে। অথচ শাহজালাল বিমানবন্দর একটি স্বাধীন দেশের রাজধানীর একমাত্র বিমানবন্দর। আগে টাউট বাটপারে ভরা থাকলেও এখন অবশ্য তাদের উৎপাত কিছুটা হলেও কমেছে। মাসুমের কাছ হতে জানা গেল বাংলাদেশের বিজয় উৎসবকে কেন্দ্র করে যেহেতু প্রতিদিন অনেক বক্তা আর শিল্পী দেশ হতে কলকাতা আসছেন সেহেতু আমাদের উপ-হাই কমিশনের তিনজন কর্মকর্তা বিমানবন্দরে পালা করে সার্বক্ষণিক ডিউটি করছেন। কলকাতায় যানজট আছে তবে তা সহনীয় পর্যায়ে। আর অনেকগুলো নতুন ফ্লাইওভার হওয়াতে যানজট পরিস্থিতির উন্নয়নে তা বড় ভূমিকা রেখেছে। আর পাতাল রেলতো আছেই। এই এক পাতাল রেলই কলকাতার চিরচেনা যানজটের কিছুটা হলেও অবসান ঘটিয়েছে। সব চেয়ে বড় কথা কলকাতার গাড়ির চালকরা ট্রাফিক আইন মেনে চলে যা বাংলাদেশের ড্রাইভারদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হবে। কলকাতা বিমানবন্দর হতে নিউমার্কেট এলাকায় অবস্থিত আমাদের থাকার হোটেলের দূরত্ব প্রায় সতের কিলোমিটার। অনেক জায়গায় পাতাল রেল সম্প্রসারণের কাজ চলছে বলে কিছুটা ঘুরে আসতে হলো। হোটেলে পৌঁছাতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগল। হোটেলটি গত দু’দশকে একাধিকবার হাত বদল হয়েছে। হোটেলটি নামে তারকাখচিত কিন্তু সেবার মান অনেকটা সাদামাটা। অবশ্য কলকাতার নিউমার্কেট এলাকায় যতগুলো হোটেল আছে সবগুলোর অবস্থা অনেকটা একই রকম। একমাত্র কিছু ব্যতিক্রম গ্রান্ড। রাতে আর কোথাও যাওয়া হলো না। শামস জানিয়ে গেল পরদিন সকাল নয়টা হতে আমার জন্য একটি সার্বক্ষণিক গাড়ি থাকবে যদিও তাকে বলি অনুষ্ঠানের আগে আসলেই হবে। সে জানালো গাড়ি কোম্পানির সাথে চুক্তি হয়েছে যে ক’দিন বাংলাদেশের অনুষ্ঠান থাকবে প্রতিজন অতিথির জন্য সার্বক্ষণিক একটি করে গাড়ি থাকবে। এসি গাড়ি। প্রতি ঘণ্টায় একশত আশি টাকায় ভাড়া করা হয়েছে। বাংলাদেশে তা চিন্তাও করা যায় না।

বিজয় দিবসের দিন মূল অনুষ্ঠান। আমি প্রধান বক্তা। ঘণ্টাখানেক আগে নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে হাজির হয়ে মনটা জুড়িয়ে গেল। প্রবেশ মুখে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের বিশাল পোস্টার। এক পাশে আবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেশ বড় একটা ছবি। বাংলাদেশের বিভিন্ন অর্জনের চিত্র তুলে ধরে বড় বড় ব্যানার। প্রকাশিত হয়েছে একটি চমৎকার স্মরণিকা। প্রথম দর্শনেই মনে হবে কলকাতার বুকে এক খণ্ড মিনি বাংলাদেশ। উপ-হাইকমিশনের কয়েকজন কমকর্তা এসে আমাকে প্রবেশ মুখে স্বাগতম জানালেন। কিছু পরে উপ-হাইকমিশনার জকি আহাদ এসে পরিচিত হলেন। আগে হতে পরিচয় না থাকলেও তার উষ্ণ অভ্যর্থনা আমাকে মুগ্ধ করেছে। স্থানীয় অনেকের কাছে জেনেছি জকি বেশ করিতকর্মা। স্থানীয় বাঙালিদের মধ্যেও বেশ জনপ্রিয়। এই বিজয় উৎসবের আয়োজন দেখে তার নতুন কিছু করার আগ্রহ বোঝা গেল। বেশ হাসিখুশি। নিজস্ব স্টাইলে চোখের চশমাটা কপালে পরেন। তাতে তাকে মানায় ভালো। অনুষ্ঠানে ঘণ্টা কয়েক অবস্থান করে মনে হলো জকি তার দফতরের কর্মকর্তা কর্মচারীদের নিয়ে একটি ভালো টিম গঠন করতে পেরেছে। বিজয় উৎসবের আয়োজন দেখে তা আরও নিশ্চিত হলাম।  

নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে বার হাজার দর্শক বসার ব্যবস্থা আছে। তবে বিজয় উৎসবের অনুষ্ঠান খেলার চত্বরে। হাজার দু’এক দর্শক শ্রোতা বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাইরে বসেছে বাংলাদেশি পণ্যের মেলা। ঢাকার কাচ্চি বিরিয়ানিও পাওয়া যাচ্ছে, যদিও তা কলকাতায় রান্না করা। আলোচনা অনুষ্ঠান শুরু হলো উপ-হাইকমিশনের কাউন্সিলর ওমর ফারুখের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে। একাত্তরে ওমর ফারুখ যখন মায়ের পেটে তখন পাকিস্তানি সেনা বাহিনী তার মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে গুলি করে হত্যা করে। বাবার স্নেহ বঞ্চিত ওমর ফারুখকে বড় করেছে তার মা। তার মা আর তার জীবনের কাহিনী শুনতে শুনতে অনেকের চোখ ছলছলিয়ে ওঠে। মঞ্চে আমার ডাক পড়লে মাইক হাতে নিয়ে বলি ওমর ফারুখের কাহিনী বাংলাদেশের হাজারো মানুষের কাহিনী। এই সব কাহিনী আমাদের একাত্তরের জীবন থেকে নেওয়া। ১৯৭১ সালে ভারত তথা পশ্চিম বঙ্গের মানুষের ভূমিকা আর আত্মত্যাগের জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে কলকাতায় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের শুরুর কথা বলি । তুলে ধরি পাকিস্তান আমলে বাঙালি আর বাংলাদেশের বঞ্চনা আর শোষণের কথা । এই শোষণের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ আর বঙ্গবন্ধুর প্রতিবাদী ভূমিকার কথা। প্রায় হাজার খানেক দর্শক শ্রোতাকে শোনাই পঁয়তাল্লিশ বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গৌরবময় অর্জনের কথা। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টার বক্তব্য উপস্থিত দর্শক শ্রোতা তন্ময় হয়ে শোনেন। এরপর দেখানো হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি প্রামাণ্য চিত্র ।

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয়ার্ধে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শুরুতে পশ্চিম বঙ্গে পড়ুয়া বাংলাদেশের নয়জন ছাত্রী দেশাত্মবোধক গানের একটি চমৎকার কোলাজ উপস্থাপন করে। এরপর মঞ্চে আসেন বাংলাদেশের লালন শিল্পী দিল আফরোজ রেবা আর দেশাত্মক বোধের গান নিয়ে অনুপমা মুক্তি। রেবার উদার কণ্ঠ নেতাজি ইনডোরের ভিতর গমগম করে ওঠে। বাংলাদেশের টিভিতে দিল আফরোজ রেবাদের উপস্থিতি তেমন একটা দেখা যায় না। মুক্তি যখন তার গান শেষ করে তখন অনুষ্ঠানস্থল কানায় কানায় পূর্ণ। আগেই ঘোষণা করা হয়েছে এ’দিনের মূল আকর্ষণ বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতের সুপারস্টার কুমার বিশ্বজিৎ। বিশ্বজিৎ-এর যন্ত্রপাতি সেট করতে প্রায় একঘণ্টা সময় লাগলো। দর্শক শ্রোতারা কিছুটা অধৈর্য্য। আমার পাশে বসা পূর্ব পরিচিত অনিমেষ কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করলে তাকে বলি সব দেশে কিন্তু সুপারস্টাররা মঞ্চে প্রবেশ করার আগে বেশ দীর্ঘ সময় ধরে তার সঙ্গী সাথীরা এ’রকম সময় নিয়েই থাকে। কিছু পরে কুমার বিশ্বজিৎ মঞ্চে প্রবেশ করেই বেশ উচ্চ স্বরে গেয়ে উঠেন ‘সালাম বাংলাদেশ, সালাম’। পেছনের ব্যাকগ্রাউন্ড স্লাইডে কক্সবাজার সমূদ্র সৈকতের একটি বড় চিত্র । এরপর একে একে কুমার বিশ্বজিৎ গেয়ে ওঠে ‘যেখানে সীমান্ত তোমার সেখানে বসন্ত আমার’, ‘তুমি রোজ বিকেলে আমার বাগানে ফুল নিতে আসতে’, ‘তোরে পুতুলের মতো করে সজিয়ে হৃদয়ের কোটায় রাখবো’ ইত্যাদি। দর্শকদের কুমার বিশ্বজিৎ-এর গানের সাথে সাথে নাচতে দেখে বুঝতে পারি শিল্পী উভয় বাংলায় বেশ জনপ্রিয়। দেখতে দেখতে কখন যে রাত দশটা বেজে গেছে বুঝতেই পারিনি। শিল্পী যখন তার শেষ গানটি করছিলেন তখনও হল ভর্তি দর্শক শ্রোতা। রাত দশটার মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ করতে হবে তেমন নির্দেশ ছিল কর্তৃপক্ষের। অনুষ্ঠান শেষে জকিকে ধন্যবাদ জানাই বিজয় দিবসকে কেন্দ্র করে বিদেশের মাটিতে এত চমৎকার ভাবে বাংলাদেশকে তুলে ধরার জন্য। শেষ দিনে সঙ্গীত পরিবেশন করতে গিয়েছিলেন সাবিনা ইয়াসমিন। ওই বাংলায় সাবিনা অসম্ভব জনপ্রিয় একজন শিল্পী। খোঁজ নিয়ে জেনেছি সে দিন নাকি বেশ আগেই হল ভরে গিয়েছিল। আসার সময় জকি আহাদকে বলি ২৬ মার্চ যেন এ’রকম আরও যেন একটি জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এ’রকম অনুষ্ঠান যেন প্রতি বছরই করা হয়। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দ্বারা একটি দেশকে অন্য দেশে তুলে ধরার বিকল্প কিছু হতে পারে না। শুধু কলকাতা কেন অন্য দেশেও সীমিত আকারে হলেও এই ধরনের অনুষ্ঠান হওয়া উচিৎ নিয়মিত। তাতে বাইরের মানুষ জানতে পারবে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের চাষ হয় না । এই দেশ গানের দেশ, বাউলের দেশ, এদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দেশ। এটি ত্রিশ লক্ষ শহীদেও রক্তে বিদৌতা বাংলাদেশ।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
নামাজ চলাকালে মসজিদের এসি বিস্ফোরণ, মুসল্লিদের মধ্যে আতঙ্ক
নামাজ চলাকালে মসজিদের এসি বিস্ফোরণ, মুসল্লিদের মধ্যে আতঙ্ক
জলপাইগুড়িতে বিজেপির ইস্যু বাংলাদেশের তেঁতুলিয়া করিডর
জলপাইগুড়িতে বিজেপির ইস্যু বাংলাদেশের তেঁতুলিয়া করিডর
নদীতে মাছ ধরার সময় জেলেদের ওপর ডাকাতের হামলা
নদীতে মাছ ধরার সময় জেলেদের ওপর ডাকাতের হামলা
ক্রিমিয়া উপকূলে রুশ সামরিক উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত
ক্রিমিয়া উপকূলে রুশ সামরিক উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ