X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

হেফাজতের সঙ্গে বাংলা একাডেমির ফারাক কোথায়?

আমীন আল রশীদ
২৭ ডিসেম্বর ২০১৬, ১২:৪৪আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৮:১১

আমীন আল রশীদ ‘কী লিখবেন সেটি জরুরি, কিন্তু কী লিখবেন না- সেটি আরও জরুরি’— সৈয়দ শামসুল হকের এই কথা ধার করে বলা যায়, লেখক তার অভিজ্ঞতা ও কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে লেখেন। পাঠক সেটি পছন্দ হলে পড়বে, না হলে পড়বে না। যে কারণে হাজারও লেখকের মধ্যে পাঠক অল্প কিছুকেই বেছে নেয়। খুব সামান্য লেখকই জনপ্রিয় হন। কাল ও শিল্পের মানদণ্ডে টিকে থাকেন আরও সামান্য। সুতরাং কোনও প্রতিষ্ঠানের এরকম নিয়ম করে দেওয়ার প্রয়োজন নেই যে, এটা লিখবেন বা ওটা লিখবেন না। কারণ আখেরে পাঠকই বিচারক।
অতএব ‘আপনি কুৎসিত বই প্রকাশ করেছেন’ বা ‘আপনি অমুক লোকের পক্ষে কথা বলেছেন’, এই অজুহাতে বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠান—যাকে আমরা বলি মেধা ও মননের প্রতীক; যে প্রতিষ্ঠানটি বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি, বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত—তারা প্রগতিশীল ধারার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বলে পরিচিত ‘শ্রাবণ’কে আগামী দুই বছরের জন্য একুশে বইমেলায় নিষিদ্ধ করে এমন একটি বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো যে, এখন থেকে বাক স্বাধীনতা, ভাষা ও সংস্কৃতি বিকাশের পথে অন্তরায় হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানটিকেও দায়ী করা হবে।
বাংলা একাডেমি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সংস্থা হলেও এর আইন প্রণয়নের কোনও ক্ষমতা নেই। সুতরাং তারা কোনও বই কিংবা প্রকাশনা সংস্থাকে বাজেয়াপ্ত কিংবা নিষিদ্ধ করার অধিকার রাখে না। সুতরাং শ্রাবণ প্রকাশনীকে নিষিদ্ধ করে তারা মূলত বেআইনি কাজ করেছে। এই ইস্যুতে বাংলা একাডেমির বিরুদ্ধেই বরং মামলা হতে পারে।
স্মরণ করা যেতে পারে, বছর কয়েক আগে ‘ইসলাম বিতর্ক’ নামে একটি বই প্রকাশ করে ‘বদ্বীপ’ প্রকাশনী। কিন্তু গতবার হঠাৎ বইটি আলোচনায় আসে এবং গ্রেফতার করা হয় বদ্বীপ প্রকাশনীর মালিক শামসুজ্জোহা মানিককে। সেইসাথে একুশে গ্রন্থমেলায় বদ্বীপ প্রকাশনীর স্টলও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে অন্যান্য লেখক-পাঠক ও প্রকাশকের সঙ্গে সোচ্চার ছিলেন শ্রাবণ প্রকাশনীর প্রধান রবিন আহসান। এই ইস্যুতে বিভিন্ন টেলিভিশনের টকশোতেও তিনি বাংলা একাডেমির সমালোচনা করেছেন। আর এর মাশুল হিসেবে তাকে আগামী দুই বছরের জন্য একুশে বইমেলায় নিষিদ্ধ করে বাংলা একাডেমি। সম্প্রতি একাডেমির বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। যদিও রবিন আহসান বিষয়টি জানতে পারেন ২৬ ডিসেম্বর; আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হতে যাওয়া বইমেলায় স্টল বরাদ্দ পাওয়ার আবেদন করতে গিয়ে। বিষয়টি স্বীকারও করেছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকা প্রবীণ লেখক ও গবেষক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান।

গণমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, ‘গত বছরের বই মেলায় মহানবী (স.) সম্পর্কে একটি কুৎসিত বই বের হয়েছিলো। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেই বইটি বাতিল ও বাজেয়াপ্ত করে। ওই বইয়ের লেখক-প্রকাশককে গ্রেফতার করা হয়। ওই বই বাতিল করা যাবে না—এমন দাবিতে প্ল্যাকার্ড হাতে সমাবেশ করে শ্রাবণ। সেজন্যই শ্রাবণকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।’ বেশ সরল স্বীকারোক্তি। একজন অধ্যাপক এবং বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তি একটি বইকে ‘কুৎসিত’ বলে সনদপত্র দিয়ে দিলেন এবং সেই কুৎসিত বইয়ের প্রকাশের পক্ষে দাঁড়ানোয় আরেকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে নিষিদ্ধ করে দিলেন। এই না হলে বাক স্বাধীনতা, এই না হলে ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা, এই না হলে গণতন্ত্রের চর্চা!

মহাপরিচালক মহোদয় গতবার বইমেলার শুরুতে লেখক-প্রকাশকদের ছবক দিয়েছিলেন যেন উস্কানিমূলক কিছু লেখা বা প্রকাশ করা না হয়। যদিও উস্কানির মানদণ্ড কী, তা তিনি উল্লেখ করেননি। এর আগের বছর ‘নবী মুহাম্মদের ২৩ বছর’ নামে একটি বই প্রকাশের অভিযোগে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ‘রোদেলা’ প্রকাশনীর স্টল।

বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলায় অংশগ্রহণের যে নীতিমালা রয়েছে, তার ১৩ অনুচ্ছেদে আছে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনও কথা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, সামাজিক নিরাপত্তা ধ্বংস বিঘ্নিত করতে পারে, এই ধরনের কর্মকাণ্ড উপলক্ষে কোনও বই প্রকাশিত হলে, সেই বই মেলায় আনা যাবে না। প্রশ্ন হলো, এ ধরনের নীতিমালা করার কোনও এখতিয়ারও বাংলা একাডেমির থাকা উচিত কী না? কারণ, বাংলা একাডেমি কোনও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নয়।

যদি কোনও বই সত্যি সত্যিই রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে বা সাম্প্রদায়িক উস্কানি তৈরি করে—তাহলে সেই বই বাজার তুলে নেওয়া বা নিষিদ্ধ করার এখতিয়ার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। বাংলা একাডেমির বরং দায়িত্ব লেখক-পাঠক ও প্রকাশকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কোনও বইয়ের বিরুদ্ধে ফেসবুকে কোনও একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অথবা হেফাজতে ইসলামের মতো চরমপন্থী কোনও সংগঠন আপত্তি তুললো আর বাংলা একাডেমিক সেই বইয়ের স্টল বন্ধ করে দেবে— এটি সম্পূর্ণই স্বৈরতান্ত্রিক এবং এই যদি হয় বাস্তবতা, তাহলে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে বাংলা একাডেমির কোনও ফারাক থাকে না। বরং বাংলা একাডেমির নাম পরিবর্তন করে ‘হেফাজতে বাংলা একাডেমি’ রাখলেই ভালো হয়। কিংবা প্রশ্ন তোলা যেতে পারে হেফাজতের সঙ্গে বাংলা একাডেমির ফারাক কোথায়?

বাংলা একাডেমির মেলায় অংশ নিতে হলে অবশ্যই কিছু শর্ত থাকবে। যেমন এত বছর না হলে বা এতগুলো বই না থাকলে কোনও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মেলায় অংশ নিতে পারবে না। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, কোনও অভিযোগ পেলেই কোনও স্টল বন্ধ করে দেওয়া হবে বা নিষিদ্ধ করা হবে। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় আইনের বিপরীতে গিয়ে বাংলা একাডেমি কোনও আলাদা আইন তৈরি করতে পারে না।

শ্রাবণ প্রকাশনীর মালিক রবিন আহসানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি টিভি টকশোতে বাংলা একাডেমির বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন। এটি একজন লেখকের বা নাগরিকের বাকস্বাধীনতার প্রশ্ন। প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলা একাডেমি সমালোচনা বা বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। সুতরাং কোনও লেখক বা পাঠক অথবা প্রকাশক যদি এর কোনও সিদ্ধান্ত বা কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেন—বাংলা একাডেমির উচিত সেটিকে শ্রদ্ধা জানানো। কারণ ভিন্নমতই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য্য। লেখকরা সব সময়ই এই ভিন্নমতের কথাই বলেন। সুতরাং বাংলা একাডেমির উচিত সমালোচনার মধ্য থেকে গঠনমূলক অংশটুকু নিয়ে আত্মসমালোচনা করা। কিন্তু দেখা গেলো, লেখক-পাঠক-প্রকাশকের বাকস্বাধীনতার অধিকার রক্ষার দায়িত্ব যে প্রতিষ্ঠানের—তারাই একজন প্রকাশকের বাকস্বাধীনতার শাস্তিস্বরূপ তাকে বইমেলায় নিষিদ্ধ করলো। এটি শুধু দুঃখজনকই নয়, বরং লজ্জারও।

শুধু বইমেলায় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে নিষিদ্ধ করাই নয়;  কিছুদিন আগে লেখক রতনতনু ঘোষের মরদেহ বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ঢুকতে না দিয়েও বেশ সমালোচনার শিকার হয় কর্তৃপক্ষ। তাদের যুক্তি, রতনতনু ঘোষ বিশিষ্ট লেখক নন। ৭০ টির মতো বইয়ের লেখক বিশিষ্ট নন। কিন্তু অনেক ছাইপাশ লিখেও এদেশে বিশিষ্ট হওয়া যায়। বাংলা একাডেমির উচিত বিশিষ্ট লেখকের একটা সংজ্ঞা তৈরি করা এবং বিশিষ্ট লেখকদের একটি তালিকা করা। তাহলে আর লেখকের মৃতদেহ একাডেমির গেট থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে না।

একজন লেখককে তার মৃত্যুর পরে এরকম অপমান করা বা তথাকথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগ কিংবা একাডেমির বিরুদ্ধে কথা বলায় কোনও প্রকাশনা স্টল নিষিদ্ধ করার মতো ঘটনাগুলো আখেরে প্রতিক্রিয়াশীলদেরই উৎসাহিত করছে কী না, তা প্রগতিশীল সংস্কৃতিমন্ত্রী (আমাদের কৈশোরের স্বপ্নের নায়ক বাকের ভাই) আশা করি ভেবে দেখবেন।

লেখক: যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
লাগাতার তাপদাহে যশোরে জনজীবন দুর্ভোগে
লাগাতার তাপদাহে যশোরে জনজীবন দুর্ভোগে
জেলেনস্কিকে হত্যার পরিকল্পনায় জড়িত অভিযোগে পোলিশ নাগরিক গ্রেফতার
জেলেনস্কিকে হত্যার পরিকল্পনায় জড়িত অভিযোগে পোলিশ নাগরিক গ্রেফতার
বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিলেন মিয়ানমারের আরও ১৩ সীমান্তরক্ষী
বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিলেন মিয়ানমারের আরও ১৩ সীমান্তরক্ষী
ভাসানটেকে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ: ঝরে গেলো আরেকটি প্রাণ
ভাসানটেকে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ: ঝরে গেলো আরেকটি প্রাণ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ