X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

রাজনীতির এমন ক্ষতি সামরিক শাসকরাও করেননি

গোলাম মোর্তোজা
২৮ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৫:২৩আপডেট : ২৮ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৫:৩২

গোলাম মোর্তোজা কিনতে চাইল বা লোভ দেখালো, লোভে পড়ে বিক্রি হয়ে গেলেন।
দায়টা কার?
যিনি লোভ দেখালেন, না যিনি লোভে পড়লেন?
যিনি কিনতে চাইলেন, লোভ যিনি দেখালেন, দায়টা সাধারণত তার ওপরই চাপানো হয়। আমরা বিশ্লেষণ করি দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, নির্মোহভাবে নয়। লোভ দেখানোওয়ালার চেয়ে, লোভে পড়াওয়ালাদের দায় যে কোনও অংশে কম নয় ক্ষেত্র বিশেষে বেশি, তা আমরা স্বীকার করতে চাই না। বলছি রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের কথা।
সামরিক শাসকরা রাজনীতিবিদদের চরিত্র নষ্ট করে দিয়েছেন। রাজনীতিকে করেছেন কলুষিত। কথাগুলো অসত্য নয়। সম্পূর্ণ সত্য হলো এই যে, ‘নষ্ট’ এবং ‘কলুষিত’ হওয়ার পেছনে বড় দায় রাজনীতিবিদেরই। তারা লোভে পড়ে বিক্রি না হলে, এতটা ‘নষ্ট’ ‘কলুষিত’ হওয়ার দায়ভার রাজনীতি-রাজনীতিবিদদের বহন করতে হত না।
১৯৭০ সালে পাকিস্তানি সামরিক শোষকদের অধীনে নির্বাচন করে বিজয়ী হওয়ার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করল। সেই রাজনৈতিক দলটির অধীনে ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় নির্বাচনে পরাজিত খন্দকার মোশতাককে জেতানোর জন্যে ব্যালট বাক্স হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় নিয়ে আসা হলো। অবিশ্বাস্য মনে হলেও, অসত্য তো নয়!
স্বাধীন দেশের প্রথম নির্বাচন থেকেই রাজনীতিবিদরা নিজেদের চরিত্র নষ্ট এবং রাজনীতি কলুষিত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। তার আগেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে অসততার সাগরে নিজেদের নিমজ্জিত করেছিলেন। রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে জাতির জনককে হত্যা করা হয়েছে। সামরিক বাহিনী ‘প্রিয় দেশবাসী’ বলে ক্ষমতায় আসার সুযোগ পেয়েছে। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান রাজনীতিবিদদের কেনা শুরু করেছেন। এরশাদ সেই ধারা অব্যাহত রেখেছেন। কেনার দায় জিয়া-এরশাদের। বিক্রি হওয়ার দায় রাজনীতিবিদদের। পরিণতিতে সামরিক শোষণের যাতাকলে নিষ্পেশিত হয়েছেন জনমানুষ।

এভাবে ভাবার কোনও কারণ নেই যে, রাজনীতিবিদরা ব্যর্থ হয়েছেন এবং সেই সুযোগে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল অনিবার্য ছিল। রাজনীতির ব্যর্থতার সুযোগে ক্ষমতা দখল করে, সামরিক বাহিনী বা শাসকরা ভুল বা অন্যায় করেননি- এমন বিশ্লেষণও করার চেষ্টা করেন অনেকে। না, বিষয়টি মোটেই তেমন নয়। রাজনীতিবিদরা ব্যর্থ হলেও, সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করতে পারে না। দেশের কোনও আইন তাদের সেই অধিকার দেয়নি। রাজনীতিবিদরা ব্যর্থ হবেন, একজনের পরিবর্তে আরেকজন দেশ পরিচালনা করবেন। এক দলের পরিবর্তে আরেক দল ক্ষমতায় আসবে। রাজনীতিবিদ বা রাজনৈতিক দলের পরিবর্তে সামরিক বাহিনী দেশ পরিচালনায় আসবে না। কোনও অবস্থাতেই নয়।

প্রশ্ন হলো, এক দল ব্যর্থ হলে আরেক দল ক্ষমতায় আসবে- কোন প্রক্রিয়ায়? অবশ্যই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, জনগণের ভোটের মাধ্যমে।

বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা এটাই যে, তারা আজ পর্যন্ত সেই কাজটি অর্থাৎ একটি সুষ্ঠু নির্বাচনি প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি।
২.

যখন একথা লিখছি, তার কয়েক দিন আগে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়ে গেল। একটি সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখলেন দেশবাসী। যে নির্বাচনে ভোটাররা ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি সেলিনা হায়াৎ আইভীকে মেয়র নির্বাচিত করলেন।

আজ ২৮ ডিসেম্বর, আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। জেলা পরিষদ নির্বাচন। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন যতটা আশাবাদী করে, তারচেয়ে হাজার গুণ বেশি হতাশায় ডোবায় জেলা পরিষদ নির্বাচন।

প্রথমে আসি নারায়ণগঞ্জ নির্বাচন প্রসঙ্গে।

জনগণ যদি বিশ্বাস করেন যে, প্রার্থী সৎ এবং যোগ্য, তাকে ভোট দিয়ে সম্মানিত করেন। সেলিনা হায়াৎ আইভী যার প্রমাণ। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। সরকারের নেতিবাচক ইমেজ তার সঙ্গী ছিল। বিএনপির চেয়েও ওসমান পরিবার ছিল তার অদৃশ্য বড় প্রতিপক্ষ। এসব কিছুকে অতিক্রম করে আইভী জনগণের ভালোবাসা অর্জন করেছেন। এই নির্বাচনটির মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছে, আদর্শবান যোগ্য দক্ষ রাজনৈতিক প্রার্থী হলে, ক্ষমতায় থেকে সুষ্ঠু নির্বাচন করেও বিজয়ী হওয়া যায়।

বলে রাখি, নির্বাচনটি সুষ্ঠু হয়েছে সরকার চেয়েছে বলে। কৃতিত্ব সরকারের প্রাপ্য, অযোগ্য-অদক্ষ বর্তমান নির্বাচন কমিশনের নয়। সেলিনা হায়াৎ আইভীর মতো প্রার্থী থাকার কারণেই সরকার সুষ্ঠু নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ নিতে পেরেছে।

এবার আসি জেলা পরিষদ নির্বাচন প্রসঙ্গে। জেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোটার, ইউনিয়ন পরিষদ এ উপজেলায় ‘নির্বাচিত’ প্রতিনিধিরা। এই ‘নির্বাচিত’রা প্রায় কেউই সঠিক নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত নন। যারা নিজেরা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় ‘নির্বাচিত’ তারা ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর। এটা জঘণ্য-নিন্দিত, বাঙালি হত্যাকারী আইয়ুব খানের ‘বেসিক ডেমোক্রেসি’ ফর্মুলা। এই ফর্মুলায় প্রকাশ্যে ভোট কেনা-বেচা হয়। আইয়ুব খানের পাকিস্তানে হয়েছিল, শেখ হাসিনার বাংলাদেশেও হচ্ছে। জেলা পরিষদের প্রার্থীরা নগদ অর্থ বা মোটরসাইকেলের বিনিময়ে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলায় ‘নির্বাচিত’ প্রতিনিধিদের কিনছেন। সাধারণ জনমানুষ এবং প্রশাসনের সবাই দেখছেন-জানছেন, এই কেনা-বেচার কাহিনী। জনগণ জানছেন, তাদের প্রতিনিধিরা অর্থের কাছে বিক্রি হচ্ছেন। মোটরসাইকেলের বিনিময়ে ভোট দিচ্ছেন। সুস্থ মস্তিষ্কে একবার চিন্তা করুন, গণতন্ত্র বা নৈতিকতা কোন পর্যায়ে নামিয়ে আনছেন রাজনীতিবিদরা। এই অধপতন কোনও সামরিক শাসক বা তাদের গড়া রাজনৈতিক দল সংগঠিত করছে না। করছে বঙ্গবন্ধুর গড়া রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। যে দলটি সারাজীবন সংগ্রাম করেছে ভোটের বা জনগণের অধিকারের জন্যে।

আপনি বলতেই পারেন, এখন ভোটের অধিকারের চেয়ে ‘উন্নয়ন’ বেশি জরুরি। না জনাব, ‘উন্নয়ন’ জরুরি, তারচেয়ে জরুরি মানুষের অধিকার। মানুষের অধিকার ছাড়া যে ‘উন্নয়ন’ তা উন্নয়ন নয়, লুটপাট। ‘উন্নয়ন’র নামে ৩০০ কোটি টাকার কাজ ১৫০০ কোটি টাকায় করে, ১২০০ কোটি টাকা লুটপাট বা পাচারের নাম ‘উন্নয়ন’ নয়। জনগণের নামে ঋণ করে আনা অর্থ, 'উন্নয়ন'র নামে পাচার! মানুষের ভোটের অধিকার থাকলে এই লুটপাট বা পাচার হয় না বা কম হয়। গণতন্ত্র না উন্নয়ন, এটা চাতুরতা। উন্নয়ন এবং গণতন্ত্র পরস্পর সাংঘর্ষিক নয়। সত্যিকারের উন্নয়ন ও গণতন্ত্র একে অপরের পরিপূরক।

৩.
সামরিক শাসকরা রাজনীতিবিদ এবং রাজনীতির চরিত্র-ইমেজ ধ্বংস করেছেন। ধরন ভিন্ন হলেও, গত আট নয় বছর ধরে রাজনীতিবিদরাই রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের ইমেজ ধ্বংস করছেন। ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যা ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। যেহেতু জনগণের ভোট দেওয়ার দরকার হয়নি, নির্বাচন কমিশন টেবিলে বসে ৫% ভোটকে ৪০% করে দিয়েছে। ফলে সৎ রাজনীতিবিদ বা যোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি আওয়ামী লীগ। অসৎ-অদক্ষ-অযোগ্য, শতভাগ অনুগত প্রশ্নহীন, মেধাহীন প্রার্থী মনোনয়নে অগ্রাধিকার পেয়েছে। যার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার যোগ্যতা নেই, তিনি এমপি ‘নির্বাচিত’ হয়ে গেছেন। যাদের উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার যোগ্যতা নেই, তেমন অনেককে মন্ত্রী বানানো হয়েছে। ফলে প্রশাসন পরিচালনা থেকে রাজনীতিবিদরা বহুদূরে সরে গেছেন। কর্তৃত্ব বেড়েছে আমলাতন্ত্রের। গণতন্ত্রের আবরণে রাজনীতিবিদদের এত বড় ক্ষতি সম্ভবত সামরিক শাসকরাও করেননি বা করতে পারেননি। সামরিক শাসকরাও রাজনীতিবিদ হিসেবে যোগ্য, প্রশাসন পরিচালনায় দক্ষদেরই কিনেছিলেন। তারা প্রশাসন পরিচালনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন, আমলাতন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। কোনও মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রীকে নিয়ে প্রশাসনে হাসাহাসি করার ঘটনা কখনও ঘটেনি। সচিব উড়োজাহাজের বিজনেস ক্লাসে বসে আছেন, মন্ত্রী উঠে গিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে নিচু হয়ে কথা বলছেন- এমন দৃশ্য কোনও সামরিক শাসনামলেও দেখা যায়নি। গত আট নয় বছরে এমন নজীরও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

প্রশাসন পরিচালনায় অদক্ষ তো বটেই, রাজনীতিবিদ হিসেবেও অদক্ষরা দায়িত্ব পেয়ে তা পালন করতে পারেননি। অনিয়ম-অনৈতিকতা-দুর্নীতি অন্য যে কোনও সময়ের চেয়ে বেড়ে গেছে, সীমাহীনভাবে বেড়ে গেছে। সবই হয়েছে ‘উন্নয়ন’র নামে।
৪.
জনগণের ভোটের অধিকার না থাকলে, অযোগ্যদের সামনে আনা যায়। যোগ্যদের দূরে সরিয়ে দেওয়া যায়। যোগ্যরা প্রশ্ন করেন, অযোগ্যরা ‘জি হুজুর’ নীতি মেনে চলেন। বাংলাদেশে ‘জি হুজুর’ নীতি প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে, প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন ধ্বংস প্রক্রিয়া সামনের দিকে আছে। সুতরাং ক্ষমতাসীনদের নীতিতে পরিবর্তন না আসলে, নারায়ণগঞ্জের একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে কোনও কিছু প্রমাণ হচ্ছে না। নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনকে মানদণ্ড হিসেবে ধরার কোনও সুযোগ থাকছে না। বর্তমান বাংলাদেশে অনৈতিক ধারার রাজনীতি আরও বিকশিত হবে। নির্বাচন-নির্বাচন কমিশন নিয়ে অনেক কথা হবে, কূ-তর্ক হবে। শেষ পর্যন্ত জনগণ আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনই দেখবেন।

ভোটের অধিকার তো থাকবেই না, জনগণের কথা বলার অধিকারও দিন দিন আরও কমবে। অধিকার খর্ব করে ‘দেশ এগিয়ে যাচ্ছে’ জাতীয় গল্প আরও বেশি বেশি শোনানো হবে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে জনগণের শক্তিতে, সরকারের শক্তিতে নয়।

সরকারের অদক্ষতা দুর্নীতিকে উৎসাহী করার নীতিতে দেশ ততটা এগুতে পারছে না, জনগণের শক্তিতে যতটা এগোনো সম্ভব ছিল। লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা অর্থাৎ পুঁজি পাচার করেছেন- করছেন সরকার সংশ্লিষ্টরা। যা আয় করেছিলেন জনগণ। এখন নিজেদেরকে ধরা-ছোঁয়ার উর্ধ্বে ভাবলেও, এই হিসেব একদিন জনগণ চাইবেন এবং দিতে বাধ্যও হবেন।

জনগণের নামে শত শত কোটি ডলার ঋণ নিয়ে উদ্ভট প্রকল্পে অপচয় ( ব্যয় নয়) করছেন। এই হিসেবও জনগণকে দিতে হবে। রাজনীতিবিদরা নিজেরা নিজেদের কৃতকর্ম দিয়ে, জনগণের সামনে নিজেদেরকে আসামী হিসেবে উপস্থাপন করছেন।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ