X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

থার্টি ফার্স্ট নাইট: উভয়সংকটের উৎসব

ইকরাম কবীর
২৯ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৫:৪৬আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৮:০৩

ইকরাম কবীর সময় চলে এলো। এক বছর পর। ইংরেজি নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর সময়।
বাংলাদেশের প্রায় সব শহুরে বাঙালি এ সময় কোনও না কোনোভাবে পুরনো ইংরেজি বছরকে বিদায় জানান এবং একই সঙ্গে নতুনকে স্বাগত জানান। বাংলা নতুন বছরকে আমরা যেমনটি করে স্বাগত জানাই, ইংরেজিকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি ঠিক সে রকম নয়। একেবারেই অন্যরকম। বাংলা বছর এলে আমরা উৎসব করি দেশীয় ধাঁচে; ইংরেজি বছর এলে ‘পার্টির’ আয়োজন করি। সবার মধ্যে কেমন যেন এক ধরনের পার্টি-পার্টি ভাব সংক্রমিত হয়। এমন পার্টির কথা সবাই ভাবতে থাকেন, যা নিজের বাড়িতে সব সময় সম্ভব হয় না। আর এ ধরনের পার্টি বাড়ির বাইরেই বেশি মানায় বলেই সবাই মনে করেন।
এ ধরনের পার্টি আয়োজন করতে হলে বাড়ি থেকে বেরুতে হয়। হয় কোনও পার্টি-সেন্টারে, রেস্তোরাঁয় বা কোনও ক্লাবে। হয় কোনও বন্ধুর বাড়ির ছাদে অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে। ইংরেজি এই নতুন বছর উপলক্ষে আনন্দ করতে সারাবিশ্বে সব মানুষ তাই’ই করেন। তারা শহরের বা গ্রামের উল্লেখযোগ্য কোনও এক স্থানে সমাবেত হন এবং নতুন বছরকে স্বাগত জানান। কোনও কোনও দেশে সরকারি উদ্যোগেই স্বাগত জানানোর আয়োজনটি করা হয়। সরকার প্রধানসহ সবাই সেখানে সানন্দে অংশ নেন।
তবে আমাদের দেশে এ ব্যাপারটি একটু অন্যরকম। একটু বললে বোধ হয় ভুল হবে, একেবারেই অন্যরকম। প্রথমত আমাদের জনগণের যাওয়ার কোনও স্থান নেই। যেসব স্থানে যাওয়া যায়, যেমন পার্টি-সেন্টার বা ক্লাব, সে স্থানগুলোতে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার নেই। হাতেগোনা কিছু মানুষ সেখানে যেতে পারেন কারণ সে সব স্থান যেতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। ক্লাবগুলোতে শুধু মেম্বাররা যেতে পারেন। বাকি সবার আনন্দের জন্য রাস্তা বেছে নেওয়া ছাড়া আর কোনও গতি থাকে না। কেউ-কেউ একসঙ্গে হন কোনও এক বন্ধুর বাসায়। তাও আবার সম্ভব হয় না, কারণ আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রতিবছর এ সময় সবাইকে বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় না আসার জন্য সতর্ক করে দেন। আর যাই হোক, রাস্তায় নেমে আনন্দ করা যাবে না। 

বেচারা বাঙালি! আমাদের নামি-দামি ক্লাবেও স্থান হয় না; আবার রাস্তায় আসাও নিষেধ। মাঝে-মাঝে মনে হয় আমরা একটি  অতি-শাসিত জাতি। আনন্দের সময় আমরা আনন্দ করতে পারি না।
তবে আশাহত হওয়ার কোনও কারণ নেই। সবক্ষেত্রেই একটি বিকল্প ব্যবস্থা থাকে। যাদের কোথাও যাওয়ার স্থান নেই, বিশেষ করে তরুণরা, তারা সবাই মিলে কোনও এক বন্ধুর বাড়িতে সমবেত হন পার্টি করার জন্য। কেউ-কেউ বাড়ির ছাদে সঙ্গীত ও নাচের আয়োজন করেন। যে যাই বলুক, সেখানে কিছু পানিয়ের আয়োজনও থাকে; সে সব না হলে চলেই না। পানীয় না থাকলে পার্টি জমে? কেউ কেউ পানীয় জোগাড় করতে পারে, বেশিরভাগই পারে না; কিন্তু সবাই পান করতে চান।
কর্তৃপক্ষের কঠোর নির্দেশ: ‘বাবারা; থার্টি ফার্স্ট নাইটে যা করবে বাড়ির ভেতরে থেকেই করো’।
বাড়ির ভেতরে থাকা সত্ত্বেও পরদিন পয়লা জানুয়ারি–কিছু খবরা-খবর পত্রিকায় ছাপা হয় যে, অনেক স্থানে বা বাড়িতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান করতে গিয়ে আনন্দরত কিছু মানুষকে গ্রেফতার করেছেন। এটাই প্রতি বছরের প্রথম দিনের খবর। গণমাধ্যমে গ্রেফতার হওয়ার খবর ও পার্টি থেকে গ্রেফতারকৃত ক’জন নারীর ছবিও ছাপা হয়। এ চিত্রের আবার উল্টোটাও পাওয়া যায়। এ ধরনের উৎসব আয়োজনে বোধ হয় আমরা অভ্যস্ত নই। থার্টি ফার্স্ট নাইট বা ইংরেজি নতুন বছরের প্রাক্কালে পার্টি করতে গিয়ে আমরা প্রায়ই বেশি-বেশি করে ফেলি; হুঁশ থাকে না। আমরা প্রায়ই ভদ্রতার মাত্রা অতিক্রম করে যাই, যা কর্তৃপক্ষকে কঠোর হতে বাধ্য করে। থার্টি ফার্স্ট নাইট আমরা কেন যেন হজম করতে পারি না। এমন অনেক উদাহরণ আছে। মনে আছে প্রায় পনেরো-কুড়ি বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ঘটনা? টিএসসি’র সামনে। একদল ছেলে একটি মেয়েকে যারপরনাই হেনস্তা করেছিল! এমন একটি ঘটনাই আমাদের অভ্যাসের পরিচয় দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। আর যাই পারি থার্টি ফার্স্ট নাইট বোধ হয় উৎযাপন করতে পারি না!
আমরা যদি এহেন ব্যবহার অব্যাহত রাখি, তাহলে সরকারের পক্ষে আমাদের থার্টি ফার্স্ট-এর আনন্দ করতে দেওয়া বোধ হয় সম্ভব নয়। নতুন বছরের প্রাক্কালে যদি আমরা একটু বেশি পাগলামি করে ফেলি, তাহলে সরকারকে দোষ দেওয়া যায় না। আমাদের এসব পাগলামি আমাদের দেশের জন্য বদনাম বয়ে আনতে পারে। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও বোঝা প্রয়োজন যে মানুষের জীবনে আনন্দেরও প্রয়োজন আছে। যখন সারাবিশ্ব আনন্দ করছে, তখন শুধু বাঙালিরা মুখ গোমরা করে বাড়িতে বসে থাকতে পারে? জীবনে কোনও আনন্দ না থাকলে তো আমাদের মগজ ভোঁতা হয়ে যেতে পারে। ইংরেজিতে যেমন বলে–অল ওয়ার্ক অ্যান্ড নো প্লে মেইক জন আ ডাল বয়!
একটা কাজ করলে কেমন হয়? সিটি করপোরেশন অথবা সব জেলার সদর পৌরসভাগুলো এই থার্টি ফার্স্ট নাইটে গানের কনসার্ট আয়োজন করতে পারে। সাধারণ জনগণ টিকিট করেই এসব অনুষ্ঠান দেখবে, আনন্দ করবে। সরকার এই অর্জিত অর্থ দিয়ে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
বহু বছর আগে এমন একটা সময় ছিল যখন মানুষ বাসায় বসে বিদেশি টেলিভিশনে অন্য দেশের থার্টি ফার্স্ট-এর অনুষ্ঠান দেখতো আর বড়-বড় নিঃশ্বাস ফেলতো। সেইসব খবর এবং ছবি আমাদের মনেও থার্টি ফার্স্ট উৎযাপন করার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়েছে। তারপর অনেক সময় গড়িয়েছে। এখন আমরাও নতুন বছরেকে স্বাগত জানিয়ে আনন্দ করতে চাই। আমাদের সমাজও বদলে গেছে তা বোঝার সময় এসেছে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমাদের জীবনে ও জীবন-যাপনে অনেক বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এই বদলে যাওয়াকে দূরে ঠেলে দেওয়া ঠিক হবে কিনা, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। সরকারের উভয়সংকট আমরা বুঝি। আমরাও আমাদের বাঙালি সত্তা বজিয়ে রেখে বিশ্ববাসী হতে পারি।
নতুন বছরের প্রাক্কালে তেমন কিছুই চাই না। শুধু একটু আনন্দ করতে চাই। আনন্দময় সময় কাটাতে চাই যা আমরা সচরাচর কাটাই না।

লেখক: গল্পকার।

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ