X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তচিন্তার সীমানা কতদূর

মোস্তফা হোসেইন
৩০ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৪:৫৬আপডেট : ০৭ মে ২০১৮, ১৭:৪৬

মোস্তফা হোসেইন বাংলা একাডেমির একুশে গ্রন্থমেলার বাকি আছে মাসকালেরও বেশি। এরমধ্যেই শ্রাবণ প্রকাশনাকে মেলায় নিষিদ্ধ করা ও কিছু লেখকের প্রতিবাদের পর গণমাধ্যমে সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেতো তোলপাড়ই শুরু হয়েছে এ নিয়ে।

বাংলা একাডেমির গ্রন্থমেলা জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠান হিসেবে মান্য। আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সঙ্গে রয়েছে এর যোগসূত্র। যে কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনও ঘটনাকেই কেউ সহজে মেনে নিতে চায় না। গত মেলা চলাকালে রোদেলা প্রকাশনার বরাদ্দ বাতিলকে কেন্দ্র করে অনাকাঙ্ক্ষিত একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। রোদেলা প্রকাশিত বইটি ছিল মহানবী ( সা.) সম্পর্কে কটূক্তিপূর্ণ এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার দায়ে অভিযুক্ত। এ ধরনের বই মেলায় বিক্রি করা, প্রদর্শন করা মেলার নীতিমালার বিরোধী। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনেরও বিপক্ষে। অন্যদিকে বাংলা একাডেমি ও প্রকাশকরা মিলিতভাবে যে নীতিমালা তৈরি করেছে, সেই নীতিমালা মেনে নেওয়ার শর্তসাপেক্ষেই প্রকাশকরা মেলায় অংশগ্রহণ করে। সেই অবস্থায় নীতিমালা বিরোধী কাজ করার দায়ে রোদেলাকে বরাদ্দ বাতিল করার অধিকার বাংলা একাডেমি আইনানুগভাবেই রাখে। সেই কাজটিই তারা করেছে। কিন্তু গত মেলা চলাকালে কিছু ব্যক্তি বাংলা একাডেমির এই পদক্ষেপকে স্বাধীন মত প্রকাশ তথা চিন্তার স্বাধীনতার পরিপন্থী বলে মন্তব্য করে। বাংলা একাডেমির ভাষ্য থেকে জানা যায়, শ্রাবণ প্রকাশনীর সত্বাধিকারী রবিন আহসানও তেমনি একজন, যিনি রোদেলার পক্ষ হয়ে বাংলা একাডেমির বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখে মেলার শৃঙ্খলা ভঙ্গ করার দায়ে অভিযুক্ত হতে পারেন। প্রায় এক বছর পর ২০১৭ সালে অনুষ্ঠেয় মেলার জন্য যখন বাংলা একাডেমি বরাদ্দের আবেদন আহ্বান করে তখন বিষয়টি আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ইতোমধ্যে বাংলা একাডেমি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে শ্রাবণ প্রকাশনীসহ মোট তিনটি প্রকাশনীকে আসন্ন মেলায়  নিষিদ্ধ করা হবে। বাকি দুটি প্রকাশনার বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে- পাইরেটেড বই মেলায় বিক্রি করা।

সম্প্রতি শ্রাবণ প্রকাশনীর পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্য ছিল- তারা ব-দ্বীপ প্রকাশনীর সত্বাধিকারীকে গ্রেফতারের প্রতিবাদ ছাড়া আর কিছুই করেনি এবং বাংলা একাডেমি তাদের প্রতি অন্যায় আচরণ করেছে। একইসঙ্গে ২৭ ডিসেম্বর তারা বাংলা একাডেমির সামনে কিছু সমমনা ব্যক্তিকে নিয়ে অবস্থান ধর্মঘটও করেছে। সেখানে তাদের বক্তব্যগুলোও প্রকারান্তরে রোদেলা প্রকাশনী ও ব-দ্বীপ প্রকাশনী থেকে ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে, এমন গ্রন্থটির পক্ষেই বলে প্রতিয়মান হয়। যদিও উপলক্ষ ছিল শ্রাবণ প্রকাশনীকে নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে আয়োজিত অবস্থানগ্রহণ।
শ্রাবণ প্রকাশনার সত্বাধিকারী বলেছেন, তারা একজন প্রকাশককে দড়িতে  বেঁধে  ধরে নিয়ে যাওয়ার প্রতিবাদ করেছেন। বাংলা একাডেমির কোনও কাজে কেউ ক্ষুব্ধ হলে অবশ্যই তিনি প্রতিবাদ করতে পারেন। এটা তার অধিকার হিসেবেও গণ্য হতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি গত মেলা চলাকালে এবং এখনও যে পদ্ধতিতে প্রতিবাদ করে চলেছেন তা নিয়ে।

মেলা চলাকালে টিএসসি চত্বরে সমাবেশের মাধ্যমে তিনি রোদেলা প্রকাশনী এবং ব-দ্বীপ স্টল বরাদ্দ বাতিলকে স্বাধীন চিন্তার ওপর হস্তক্ষেপ বলে আখ্যায়িত করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে।  মহানবী (সা.) সম্পর্কে চরম আপত্তিকর বক্তব্য নিয়ে একটি প্রকাশনা সংস্থা বই প্রকাশ করবে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করাকে কি স্বাধীন চিন্তার প্রতিবন্ধক হিসেবে গণ্য করা যায়? হযরত মোহাম্মদ ( সা.)ই নয় একজন সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত জীবনকে কলুষিত করা হলেও কি তাকে স্বাধীন চিন্তা বলে মনে করতে হবে? আর আমাদের দেশের আইন ও সংবিধান কি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে এমন মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেয়?

এমনকি ২৭ ডিসেম্বর যখন শ্রাবণ প্রকাশনীর পক্ষে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে অবস্থান করে প্রতিবাদ জানানো হয়, সেখানেও বক্তারা মুক্তচিন্তায় বাংলা একাডেমি প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে বলে অভিযোগ করেছে। তার মানে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় তারা স্পষ্টতই রোদেলা এবং ব-দ্বীপের ওই অন্যায় কাজকেই মুক্তচিন্তা বলে চালিয়ে দেওয়ার পক্ষে।  এমন পরিস্থিতে কিছু প্রশ্নের জন্ম দেওয়াই স্বাভাবিক।

রাসুলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে বিতর্কিত বক্তব্য নিয়ে বই প্রকাশ করা রোদেলা প্রকাশনী এবং ব-দ্বীপকে নিষিদ্ধ করার পর রবিন আহসান কি মুক্তচিন্তা প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়েছে বলে বক্তব্য দেননি?

বইমেলা শৃঙ্খলা ভঙ্গ হওয়ার মতো উস্কানিমূলক কার্যক্রমে লিপ্ত থাকার অভিযোগে যখন শ্রাবণ প্রকাশনাকে সাময়িক শাস্তি দেওয়া হয়, তখন উপস্থিত প্রকাশনা সংস্থার প্রতিনিধিরা কি সেটা মেনে  নেননি?

বাংলা একাডেমির সিদ্ধান্তকে যেহেতু তিনি অন্যায় মনে করেছেন, তখন তিনি কি বাংলা একাডেমিকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন? শ্রাবণ প্রকাশনাকে মেলায় সাময়িক নিষিদ্ধ করার পর কিছু ব্যক্তি যখন বাংলা একাডেমিকে ‘পাকিস্তান একাডেমি’আখ্যায়িত করে তখন কি বাঙালির জাতীয় মূল্যবোধে আঘাত হানা হয়নি? তার ও তার পক্ষের কিছু লোক সরাসরি বাংলা একাডেমির বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে কি এটাই প্রমাণ করছেন না, তারা বাংলা একাডেমি বিরোধী। ফেসবুকে তার কর্মকাণ্ডের সূত্রে যখন বাংলা একাডেমির লোগোকে গাধার মুখের অবয়বে বিকৃত করা হয়, সেটা কি সরাসরি জাতির মননে আঘাত করার মতো নয়?

তিনি লিখিতভাবে বাংলা একাডেমিকে জানাতে পারতেন, সংস্কৃতি সচিব কিংবা সংস্কৃতিমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারতেন। তিনি মামলাও করতে পারতেন। তা না করে রাজপথে নেমে কি সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের পথ  বেছে  নিয়েছেন?

রাজনৈতিক দলের অনুকরণে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বিষয়কে রাজপথে নামিয়ে এনে আগামী মেলায়ও অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চেষ্টা করছেন কি?

বাংলা একাডেমি নীতিমালার বিরুদ্ধে শ্রাবণ প্রকাশনীকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, এমন বক্তব্য তার পক্ষ  থেকে আসেনি। তাই আমরা কি ধরে নেব- নীতিমালা অনুসরণ করেই শ্রাবণকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে?

শ্রাবণ প্রকাশনাকে যদি অন্যায়ভাবে শাস্তি দেওয়া হয়ে থাকে তাহলে প্রকাশকদের সংগঠন থেকে কেন তার প্রতিবাদ করা হয়নি। বাংলা একাডেমিতে তাদের সংগঠনই তাদের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। শ্রাবণ প্রকাশনী কি মনে করে তাদের সংগঠনের ভূমিকাই ঠিক?

অন্যদিকে বাংলা একাডেমি হয়তো বলতে পারে, তারা যা করেছে সবই নীতিমালার আলোকে এবং মেলার স্বার্থে করেছে। হয়তো ঠিক, কিন্তু তারপরও গত মেলার পর তারা শ্রাবণ প্রকাশনীকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিতে পারতো। সেক্ষেত্রে শ্রাবণ প্রকাশনী যদি মনে করতো যে আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ আছে কিংবা তারা বাংলা একাডেমিকে বলবে যে, তারা মেলার স্বার্থপরিপন্থী কোনও কাজ করবে না। তখনতো আর এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশ তৈরি হতো না। আবারও বলা দরকার নীতিমালায় যদি কোনও প্রকাশককে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ নাও দেওয়া হয়, কিন্তু দিলেতো নীতিমালা বাধা হয়ে দাঁড়াতো না। সবকিছু কি শাস্তি দিয়েই সংশোধন হয়?

এখন বাংলা একাডেমিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে মেলাকে নিরাপদ ও সুষ্ঠু করতে কোন পদক্ষেপ তারা গ্রহণ করবে। বাংলা একাডেমির নীতিমালা ভঙ্গ করে কেউ যদি পার পেয়ে যায় তাহলে আগামীতে এর পরিণতি কী হতে পারে, সেটাও নিশ্চয়ই তারা চিন্তা করবে। অন্যদিকে জাতীয় পর্যায়ের এই মেলায় একটি প্রকাশনা অংশ নিতে পারবে না এটাও দৃষ্টিকটু ঠেকে। এ পরিস্থিতিতে এমন কোনও ব্যবস্থা কী নেওয়া যায়, যাতে করে নীতিমালাও ভঙ্গ না হয়, আবার প্রকাশনা সংস্থাটিও সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়।

 লেখক- সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক।

 

.

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বাঘ ছাড়া হবে জঙ্গলে, তাই শেষবার ভোট দিলেন বাসিন্দারা!
বাঘ ছাড়া হবে জঙ্গলে, তাই শেষবার ভোট দিলেন বাসিন্দারা!
তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে যশোর, জনশূন্য রাস্তাঘাট
তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে যশোর, জনশূন্য রাস্তাঘাট
মুখোমুখি ইরান-ইসরায়েল, পরীক্ষার মুখে মার্কিন সামরিক কৌশল
মুখোমুখি ইরান-ইসরায়েল, পরীক্ষার মুখে মার্কিন সামরিক কৌশল
শহীদ মিনারে বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাসের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা
শহীদ মিনারে বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাসের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ