X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

ফিদেলের দুনিয়া

শুভ কিবরিয়া
৩১ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৩:৩৪আপডেট : ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৩:৩৭

শুভ কিবরিয়া ফিদেল কাস্ত্রো (১৯২৬-২০১৬), এখন স্মৃতির গহিনে। ৪৯ বছরের একটানা কিউবা শাসন শেষে তার ৯০ বছরের জীবন শেষ হয়েছে। তার মৃত্যুর পর বিশ্বব্যাপী তিনি যে শ্রদ্ধা পেয়েছেন, যেভাবে স্মরণে এসেছেন তা খুব কম মানুষের ভাগ্যেই ঘটে। অবশ্য ফিদেলের কর্মও এমন যে, তাকে স্মরণ না করে উপায় নেই। খোদ আমেরিকার বুকের ওপর দাঁড়িয়ে পুঁজিবাদের ঘোর বিপরীতে একটি সমাজতান্ত্রিক মডেল আবিষ্কার এবং তাকে রাষ্ট্র রূপ দিয়ে টিকিয়ে রাখা কম বড় সাফল্যের কথা নয়। ফিদেলের তৈরি এই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রযাত্রা খুব সহজ ছিল না। অনেক বন্ধুর মতো তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে। অনেক শক্ত হাতেই প্রতিপক্ষ দমন করতে হয়েছে। পেন্ডুলামের মতো তার শাসক জীবন বহুবার মৃত্যু আর পতনের দোলায় দুলেছে কিন্তু ফিদেল শেষতক তা থেকে বের হয়ে এসেছেন নিজগুণে আর ভাগ্যের সহায়তায়।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর এই প্রশ্ন বারবার উঠেছে, তাহলে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার পতন কি আসন্ন। সমাজতন্ত্রের পতনই বা কেন হলো? এই প্রশ্নও তখন দুনিয়াজোড়া ঘুরপাক খাচ্ছে। একদল সাংবাদিক এই প্রশ্নে চেপে ধরলেন ফিদেল কাস্ত্রোকে। কিছুটা ক্ষেপে উঠলেন কাস্ত্রো। পাল্টা প্রশ্ন করলেন সাংবাদিকদের। রাশিয়ায় কমিউনিজম কেন ব্যর্থ হলো সেই প্রশ্ন আমাকে কেন করছেন। বরং সমাজতন্ত্র কেন কিউবাতে ব্যর্থ হয়নি সেই প্রশ্ন আমাকে করুন।
এটা সত্যি বিশ্বব্যাপী কমিউনিজম বড়  দোল খেলেও, কিউবায় এক অসাধারণ স্বাস্থ্যব্যবস্থা আর শিক্ষাব্যবস্থার মডেল নিয়ে সেখানকার সোশ্যাল জাস্টিস বা সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার নামে ফিদেলীয় কমিউনিজম বহু বৈরিতা সত্ত্বেও দাঁড়িয়ে গেছে।
১৯৬১ সালের এপ্রিলে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র প্ররোচনা ও মদদে মার্কিন নির্বাসিত কিউবান যারা কাস্ত্রোকে স্বৈরাশাসক ভাবতেন, তাদের ১৪০০ জনের একটা দল কাস্ত্রোকে সামরিক উৎখাতের চেষ্টা চালায়। সে অভিযান ব্যর্থ হয়। এরপর কাস্ত্রো শুধু আমেরিকান অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাই মোকাবিলা করেন নাই, দেশের অভ্যন্তরেও তাকে মোকাবিলা করতে হয়েছে বহু বৈরিতা ও মৃত্যুর চেষ্টা। রাশিয়ার সহায়তা ছিল ফিদেলের বড় আশ্রয়। তাই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন তাকে দুর্ভোগে ফেলে। কিউবার অর্থনৈতিক দুর্যোগ কাটাতে ফিদেল কাস্ত্রো সেদেশের পর্যটন খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করে অর্থনৈতিক দুঃখদিন উৎরাতে চান। তখন সেই ব্যবস্থাও কিউবার অভ্যন্তরে তৈরি করে নানান জটিলতা। সেই দুঃখ দিনেও কাস্ত্রোকে পড়তে হয় ‘সমাজতন্ত্র না মৃত্যু!- এই দ্বান্দ্বিক প্রশ্নে। কিন্তু জায়গা ছাড়েননি কাস্ত্রো।

দুই.

এই ফিদেলকে আমরা জানি। যে ফিদেল নীতির প্রশ্নে আপস করে মাথা নোয়াননি। কৌশল বদলেছেন কিন্তু বিপ্লবের লক্ষ্য থেকে সরেননি। প্রতিপক্ষকে আয়রন হ্যান্ডে দমন করেছেন কিন্তু বিপ্লবের আশাকে ধুলিস্যত হতে দেননি। মাথা না নোয়ানো এই ফিদেল কাস্ত্রো তৈরি হলেন কী করে? কিউবার জনগণ এই ফিদেলকে মানলেনই বা কেন? কিংবা প্রশ্নটা উল্টোভাবে করা যায়, কিউবার মানুষকে কিভাবে বুঝেছিলেন ফিদেল। ফিদেলের মনের দুনিয়া আসলে কেমন ছিল?

ফিদেলের মৃত্যুর পর, তাকে নিয়ে দুনিয়াজোড়া আলোচনা আর স্মরণের কারণে এসব প্রশ্ন আমাকেও তাড়িত করে। বহু বছর আগে পড়া ফিদেল কাস্ত্রোর একটা অসাধারণ সাক্ষাৎকার নতুন করে আবার পড়তে থাকি। পেয়ে যাই আমার অনেক প্রশ্নের উত্তরও।

ফিদেল কেমন করে কিউবার মানুষের মনে জায়গা পেলেন? সেদেশের কমিউনিস্ট পার্টি  সক্রিয় ছিল অনেক আগে থেকেই। তারা কেন মানুষের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে তখনও জায়গা পেলেন না। ফিদেল কিভাবে সেই জায়গাটা পেলেন? কী ছিল তার বিশেষ গুণ? এর উত্তর মেলে ফিদেলের সেই সাক্ষাৎকারে তার দেওয়া বিশ্লেষণে। তিনি বলছেন, ‘আমি তখন দেখেছি কিউবান কমিউনিস্টরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন। নানা প্রতিক্রিয়াশীলতা তাদের আচ্ছন্ন করে আছে। যত কিছুই করুক, তারা ছিল জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন। কিউবান শ্রমিকদের মধ্যে কমিউনিস্টরা যথেষ্ট কাজ করেছিল, কিন্তু আমি তাদের মধ্যে কোনও সম্ভাবনা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সুতরাং আমি নতুন একটি বৈপ্লবিক কৌশলের কথা ভাবতে লাগলাম। আমি চাইলাম, শুধু একটি শ্রেণি নয়, জনগণের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে থাকা সকল অতৃপ্ত, অসন্তুষ্ট মানুষকে এই বিপ্লবের সঙ্গে যুক্ত করে দিতে। যে মানুষগুলো হয়তো স্পষ্ট কোনও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নেই, কিন্তু যারা একটা পরিবর্তন চান  এবং বস্তুত যারা জনগণের সবচেয়ে বৃহৎ অংশ।’

ফিদেলের ভাষায়- আমি বলেছিলাম, ‘অকলঙ্কিত, বিদ্রোহী সাধারণ মানুষই হচ্ছে বিপ্লবের সবচেয়ে বড় শক্তি। তাদের অবশ্যই বিপ্লবের দিকে ধাবিত করে নিয়ে যেতে হবে, কিন্তু নিয়ে যেতে হবে ধাপে ধাপে।’ কিন্তু এক রাতে কিছু কথা দিয়েই তো আর জনগণের মধ্যে সচেতনতাকে জাগিয়ে তোলা যায় না। তবে আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত হলাম যে, সাধারণ মানুষই হচ্ছে আসল শক্তি। যদিও সে মানুষেরা তখন দ্বিধাগ্রস্ত বা সাম্যবাদের নামে ভীতসন্ত্রস্ত। তারা রেডিও, টিভি, সংবাদপত্র, চলচ্চিত্র, পত্রিকা, বইয়ের নানা ভ্রান্ত রাজনৈতিক প্রচারণায় বিভ্রান্ত।’

তিন.

সমাজতন্ত্রভাবনা সেই যুগে কোনও সুখের ভাবনা ছিল না। সমাজ এই সমতাবাদিভাবনাকে তখনও গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করেনি। সেই চ্যালেঞ্জের দিনের কথা ওঠে এসেছে ফিদেলের ভাবনায় । তিনি বলছেন, ‘সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদকে তখন মানবজাতির জন্য অভিশাপ হিসেবে প্রচার করা হত। ছোটবেলা থেকেই সবাই শুনত যে সমাজতন্ত্র ঘরবাড়িসহ ব্যক্তিগত যা-কিছু আছে সব কেড়ে নেয়, কৃষকদের নিজের জমি আর নিজের থাকে না, তারা পরিবার ভেঙে দেয় এমন আরও নানা কিছু। মার্কসের সময় বলা হত কমিউনিস্টরা মেয়েদের যৌথ সম্পত্তিতে পরিণত করে। এভাবে বিভিন্ন সময়েই মানুষকে কলুষিত করার জন্যই অদ্ভুত সব বিষয় তারা আবিষ্কার করেছে। কিউবাতেও বহু মানুষ কমিউনিজমের বিরোধী ছিল। তারা ঠিক জানতই না কমিউনিজম ব্যাপারটা আসলে কী। কিন্তু আমি দেখতাম, মানুষ অন্যায়, অত্যাচার, অসাম্য আর প্রচণ্ড দারিদ্র্যে ভুগছে। এই ভোগ শুধু বৈষয়িক অর্থে নয়, আত্মিক অর্থেও। একজন কষ্ট পাচ্ছে শুধু সেজন্য নয় যে তার প্রয়োজনীয় ৩ হাজার ক্যালরির বদলে সে পাচ্ছে মাত্র ১৫০০ ক্যালোরি। মানুষের আরও অন্য রকম কষ্ট রয়েছে। সেটা সামাজিক বৈষম্যের কষ্ট, এই কষ্ট মানুষকে ক্রমাগত হীন, ক্ষুদ্র করে তোলে। সে ভাবতে থাকে সে কিছু নয়, সে সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় নয়, তার যেন কোনও অস্তিত্বই নেই। সেই সঙ্গে আমি এও লক্ষ্য করি, সাধারণ মানুষ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ, অসন্তুষ্ট। সমস্যার সঠিক ব্যাথ্যা তাদের কাছে নেই, তারা বিভ্রান্ত’।

চার.

এই শতাব্দির রাজনৈতিক ইতিহাসে ফিদেল কাস্ত্রো এক অনন্য বিস্ময়ের নাম। এক শক্তিমান বিশ্বাসের নাম। ফিদেল ছাত্র অবস্থাতেই পাহাড়ের চুড়ায় উঠতে পছন্দ করতেন ভীষণ। বিপ্লবের প্রথম জমানায় একবার ধরা পড়েছিলেন বাতিস্তা সরকারের সেনাদের হাতে। তাকে গুলি করতে উদ্যত হয় এক সেনাসদস্য। সেই মুহূর্তে তাকে বাঁচিয়ে দেন এক সেনা কর্মকর্তা। সেই সেনা কর্তা ফিদেলকে হত্যায় উদ্যত সেনাসদস্যকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘গুলি কোরো না, বিশ্বাসকে হত্যা করা যায় না।’

ফিদেলের বিশ্বাসকে হত্যা করা যায়নি। ফিদেল ব্যক্তির উন্নয়নে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি ছিলেন কল্যাণের জননেতা। তাই ফিদেল অম্লান, জীবনে ও মরণে সর্বত্রই।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
এখনই হচ্ছে না হকির শিরোপা নিষ্পত্তি, তাহলে কবে?
এখনই হচ্ছে না হকির শিরোপা নিষ্পত্তি, তাহলে কবে?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ