X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাংলা একাডেমির ভূমিকা

তসলিমা নাসরিন
০১ জানুয়ারি ২০১৭, ১৬:২৮আপডেট : ০১ জানুয়ারি ২০১৭, ১৬:৩২

তসলিমা নাসরিন কারা বলে তোমার মত যদি আমার মতের মতো না হয় তাহলে চুপ থাকবে, কথা বলবে না? বলে স্বৈরাচারী শাসক। বলে মূর্খ ধর্মান্ধ। কারা স্বৈরাচারি শাসক আর মূর্খ ধর্মান্ধর ফতোয়ার আর নিষেধাজ্ঞার নিন্দে করে? করে বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাহিত্যিক। করে ভাষা ও সাহিত্যের সেবা করার জন্য যে একাডেমি থাকে, সেই একাডেমি। বাংলাদেশে বড় বড় বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে তৈরি বাংলা একাডেমিরও তাই কাজ। কিন্তু সরকার বা ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা যখন লেখকদের হত্যা করে, জেলে পাঠায়, নির্বাসন দণ্ড দেয়, বই বাজেয়াপ্ত করে, তখন বাংলা একাডেমি চুপ থাকে, লেখক বুদ্ধিজীবীরাও বাংলা একাডেমির পদাংক অনুসরণ করেন, চুপ থাকেন। চুপ থাকার রাজনীতিতে সক্কলে বেশ পারদর্শী।
সম্প্রতি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শ্রাবণ নামের একটি প্রকাশনীকে বই মেলায় বই এর স্টল করতে দেবেন না এরকম একটি ফতোয়া দিয়েছেন। ওই নিষেধাজ্ঞার নিন্দে হয় প্রচুর। মহাপরিচালকের পদত্যাগেরও দাবি ওঠে।
এরপর বাংলা একাডেমি একটা সমঝোতায় আসতে চায়, মোদ্দা কথা আপোস করতে চায়। কী রকম? চারদিকে জানিয়ে দেয়, ‘গ্রন্থমেলার নীতিমালা পরিপন্থী কোনও কার্যক্রম করবে না এবং ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত হানে এমন বই প্রকাশ করবে না - এই শর্তে অঙ্গীকারনামা পাঠালে বাংলা একাডেমি শ্রাবণ প্রকাশনীর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেবে।’
মনে হচ্ছে জামাতি ইসলামির বা কোনও ইসলামি মৌলবাদী-সন্ত্রাসি দলের বাণী শুনছি। তারাই তো আপোসের কথা বলে এইভাবে। আমার সম্পর্কেও বলেছিল, ‘তসলিমা যদি আর ইসলাম নিয়ে কোনও কটুক্তি না করে, তওবা করে নামাজ রোজা শুরু করে, তাহলে তাকে ক্ষমা করে দেব’।
শ্রাবণ প্রকাশনীর দোষ কী ছিল? কেন এই প্রকাশনীকে দু’বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছিল বাংলা একাডেমি? করেছিল কারণ   শ্রাবণ প্রকাশনীর মালিক রবিন আহসান লেখকদের মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে কথা বলেছিলেন। গত বইমেলায় তিনি ব-দ্বীপ প্রকাশনীর একটি বই নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, বইটি প্রকাশের দায়ে গ্রেফতার হওয়া প্রকাশক শামসুজ্জামান মানিকের মুক্তির আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন। রবিন আহসানের এত প্রতিবাদ-আন্দোলন বাংলা একাডেমির সয়নি। তাই নিষেধাজ্ঞা।

যখন দেশ জুড়ে মৌলবাদিদের তাণ্ডব নৃত্য; ব্লগারদের, প্রগতিবাদীদের দিনের আলোয় কুপিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে, যখন মুক্তচিন্তকদের জেলে ভরছে সরকার, তাদের বই বাজেয়াপ্ত করছে, তখন কিনা বাংলা একাডেমি ওই প্রতিক্রিয়াশীলদের সুরেই সুর মেলাচ্ছে!

ছোটবেলায় অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূরের ভক্ত ছিলাম। ভালো মানুষের, সৎ মানুষের, আদর্শবান মানুষের চরিত্রে অভিনয় করতেন নূর। এখন মনে হয়, ওগুলো হয়তো কেবল অভিনয়ই ছিল। যারা থিয়েটার করে, গান গায়, কবিতা লেখে, সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে থাকে, তাদের, আমরা ভেবেই নিই, প্রগতির পক্ষের লোক, ভেবেই নিই তারা গণতন্ত্রে, মুক্ত চিন্তায়, মত প্রকাশের অধিকারে বিশ্বাস করে। কিন্তু আমাদের ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে, শুনেছি, নূর দল বল নিয়ে বসে বই নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। বই নিষিদ্ধ করেন। বাংলাদেশের কবি লেখকরাও একই কাণ্ড করছেন। যে সরকারই আসুক, সেই সরকারের গুণগান গাওয়া অধিকাংশ শিল্পী সাহিত্যিকদের স্বভাব। পদ এবং পদকের লোভ তাদের এতই বেশি যে দেখলে লজ্জা হয়।

খারাপ লাগছে রবিনের হেরে যাওয়া দেখে। রবিন আহসান বলেছেন, বইমেলার গঠনতন্ত্রে এমন নীতিমালা থাকায় তার স্বাক্ষর করতে ‘আপত্তি নেই’। ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত হানে এমন কোনও বই শ্রাবণ থেকে প্রকাশিত হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতেও হবে না’। আমি অনুমান করছি রবিন আপোস করতে বাধ্য হয়েছেন। বই বিক্রি করে তিনি সংসার চালান। বাংলাদেশে বই বিক্রি হয় মূলত ফেব্রুয়ারির মেলায়। এই মেলায় বই বিক্রি করার জন্য বাংলা একাডেমির দেওয়া শর্ত মেনে নিতে রবিন বাধ্য হয়েছেন। বলা যেতে পারে, প্রকাশককে বিপদে ফেলে বাংলা একাডেমি বাধ্য করেছে রবিনকে আপোস করতে। দোষটা রবিনের নয়, দোষ বাংলা একাডেমির।

এতটা শর্ত মানতে রবিনের নিশ্চয়ই ইচ্ছে হচ্ছিল না, শেষ অবধি নিজের শেষ সম্মানটুকু এই বলে রক্ষা করতে চেয়েছেন, ‘তবে একজন স্বতন্ত্র লেখক হিসেবে আদর্শিক কারণে বাংলা একাডেমির বাইরে যদি কোনও প্রতিবাদী কর্মসূচি পালিত হয়, আমি অবশ্যই অংশগ্রহণ করব।’

বাঙালি লেখক প্রকাশকরা যেন মেরুদণ্ড সোজা রেখে, মান- সম্মান অক্ষত রেখে চলতে পারেন। দেখবে কে? বাংলা একাডেমি। বাংলা একাডেমিই তো তাদের দেবে সাহস, শুভাশিস। তা না, উল্টো বাংলা একাডেমিই লেখক প্রকাশকদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিচ্ছে, মনোবল নষ্ট করে দিচ্ছে। মৌলবাদির ভয়, সরকারের ভয়, এখন ভয় বাংলা একাডেমির ভয়। ধর্ম নিয়ে কথা বলা যাবে না, সরকারের সমালোচনা করা যাবে না। তবে যাবেটা কী? কী যাবে, এক সময় তাও বলে দেওয়া হবে। হয়তো কোনও একদিন কোনও এক তালিকা ধরিয়ে দেওয়া হবে হাতে। এই বিষয়গুলো ছাড়া অন্য কোনও বিষয় নিয়ে লেখা চলবে না। বিষয়ের সংখ্যাও ধীরে ধীরে কমতে থাকবে। কাকে ভরসা করবে কে? গণতন্ত্র শুধু কাগজে কলমে, ভেতরে ভেতরে প্রায় সবাই স্বৈরাচারি।

যদি এমন হত, বাংলাদেশের সব প্রকাশক বর্জন করতো বইমেলা, বর্জন করতো বাংলা একাডেমির আধিপত্য!  যদি এমন হয়, বাংলাদেশের সব লেখক-- তাদের যা ইচ্ছে করে লিখতে—তার সব কিছু লেখার স্বাধীনতার জন্য, বাংলাদেশের সব প্রকাশক যা কিছু তাদের ছাপাতে ইচ্ছে করে, তা ছাপানোর অধিকারের জন্য--- মত প্রকাশের অধিকারের বিরুদ্ধে সরকারের, মৌলবাদিদের, বাংলা একাডেমির ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ করছে, তবে বুঝবো বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার ভবিষ্যত বলে কিছু আছে। আর তা না হলে যেভাবে সবাই নেশাগ্রস্তের মতো ধর্ম রক্ষা করে চলেছে তাতে ভয় হয় ধর্ম বলে শেষ অবধি কিছু অবশিষ্ট  থাকে কি না।

লেখক: কলামিস্ট

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ