X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে গবেষণা!

সুমন রহমান
০২ জানুয়ারি ২০১৭, ১৩:০৬আপডেট : ০২ জানুয়ারি ২০১৭, ১৩:০৮

সুমন রহমান সম্প্রতি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে অন্তত দু’টি গবেষণার খোঁজ জেনেছি। একটির খবর ছাপা হয়েছে জনপ্রিয় একটি দৈনিক পত্রিকায় ৩০ ডিসেম্বর। সেটি করেছেন ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ার পিএইচডি গবেষক ম্যাট হুসেইন। এটি বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গবেষণা তার। গবেষণার ফল হলো, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মানসম্মত শিক্ষা দিতে পারছে না। বহুবিধ কারণের একটা হলো, তারা ‘রিকশা-ফ্যাকাল্টি’ অর্থাৎ রিকশা-চেপে এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটতে থাকা শিক্ষকদের মাধ্যমে ‘জম্বি’ শিক্ষার্থী তৈরি করছে। ম্যাট হুসেনের পরিভাষায়, জম্বি শিক্ষার্থী মানে সেসব শিক্ষার্থী যাদের ‘বিশ্লেষণী ক্ষমতা’ নেই এবং ‘দর্শনের বা দার্শনিকতার দৈন্য’ আছে।
অন্য গবেষণাটি করেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ। বাংলাদেশের শিক্ষার সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকে সামনে রেখে এই গবেষণা। ম্যাট হোসেনের লেখা প্রবন্ধটি পড়েছি, কিন্তু মনজুর আহমেদের লেখাটি পড়ার সুযোগ হয়নি। কিন্তু একটি অনলাইনের খবর অনুযায়ী এই প্রবন্ধ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার হাল নিয়ে। প্রবন্ধ উপস্থাপন অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন (পাবলিক) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান (কলেজের) ডিগ্রির চেয়ে খারাপ। সেখানে ব্যয়ের কিংবা শিক্ষক নিয়োগের স্বচ্ছতা নেই। হোসেন জিল্লুর পটুয়াখালীর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগের কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। পত্রিকার খবর অনুযায়ী, ড. মনজুর তার প্রবন্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিকে গুণগত শিক্ষার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখেছেন।
ম্যাট হুসেইনের গবেষণাটি অদ্ভূত। তিনি আসলে তার পঠিত তত্ত্বের আদলে একখানা ফিকশন রচনা করতে চেয়েছেন বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে। পদ্ধতিগত ত্রুটিও আছে প্রচুর। নব্য-উদারবাদী ব্যবস্থায় যেভাবে সরকারি ভর্তুকি কমানোর জন্য চাপ দেওয়া হয়, সেটাকেই তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল প্রণোদনা হিসেবে দেখছেন। ফলে নানারকমের ভুল তথ্যের সন্নিবেশ ঘটেছে লেখাটিতে। যেমন, অন্য কারও লেখার বরাত দিয়ে তিনি দাবি করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নাকি আগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, ২০০৫ সালে বেসরকারি হয়ে গেছে! অন্যত্র লিখেছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণকালীন শিক্ষক শতকরা ১০ ভাগ মাত্র! কোথায় পেলেন এই তথ্য? না, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন নয়, এই তথ্য দিয়েছে শিক্ষার্থীরা; যাদের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। তো, গেলো শতকরা দশভাগ ফুলটাইম ফ্যাকাল্টি,  বাকিরা কারা? ম্যাট তাদেরই  নাম দিয়েছেন ‘রিকশা ফ্যাকাল্টি’। খণ্ডকালীন,  রিকশায় চেপে তারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোটাছুটি করেন। অল্প মজুরি আর রিকশাযোগে ব্যাপক ছোটাছুটির কারণে নাকি তারা মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারছেন না। ফলে ‘জম্বি’ শিক্ষার্থী তৈরি হচ্ছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে! 

ম্যাটের গবেষণায় পদ্ধতিগত ত্রুটির কথা বলছিলাম। তিনি এথনোগ্রাফি বা জাতিতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ করেছেন বলে দাবি করেছেন। এটি একটি সাংঘাতিক সময়সাপেক্ষ পদ্ধতি, যেখানে গবেষকেরা তথ্য সংগ্রহের জন্য মাসের পর মাস কিংবা বছরের পর বছর মাঠপর্যায়ে পড়ে থাকেন, সেখানে ম্যাট হুসেইন সময় নিয়েছেন অত্যন্ত কম, কিন্তু ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলেছেন, তিনি ১০০ ঘণ্টা এথনোগ্রাফি করেছেন। ঘণ্টায় বললে বেশি শোনায় বটে! এরকম একটি গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি কিংবা কোনও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে আলাপের প্রয়োজনটুকু বোধ করেননি। সেটা করলে হয়তো তিনি জানতে পারতেন, একদার জগন্নাথ কলেজ এখন বেসরকারি নয়, বরং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে; জানতে পারতেন ঠিক কত শতাংশ পূর্ণকালীন শিক্ষক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেন। সেগুলো জানার জন্য তিনি নির্ভর করেছেন শিক্ষার্থীদের সাক্ষাৎকারের ওপর। ফলে এমন হাস্যকর ধরনের তথ্যবিভ্রাট তিনি এড়াতে পারেননি।

‘জম্বি’ শিক্ষার্থী আর ‘রিকশা ফ্যাকাল্টি’ নামে যে দু’টি পরিভাষা ম্যাট হুসেইন উৎপাদন করেছেন, তা নিয়ে পাশ্চাত্যে সস্তা সেনসেশনালিজম তৈরি করা হয়তো সম্ভব। কিন্তু গবেষণা অন্য জিনিস। পাশ্চাত্য সিনেমার ‘জম্বি’ চরিত্রের ধারণাটি নানান ডিসিপ্লিনে ব্যবহৃত হয়েছে অতীতে: রাজনৈতিক অর্থনীতি, জনস্বাস্থ্য কিংবা সাংস্কৃতিক অধ্যয়নের বিভিন্ন আলোচনায় এমনটা দেখা যায়। সেসব আলাপে ‘জম্বি’ হচ্ছে সেই দশা যা বিবেচনাহীনভাবে অন্যের রক্ত খেয়ে বাঁচে, কারণ এ ছাড়া তার বিকল্প রাস্তা নেই। যেমন ‘জম্বি পুঁজিবাদ’ বলে একটা ধারণা তৈরি করেন ক্রিস হারম্যান, যে পুঁজিবাদ সস্তাশ্রমনির্ভর, ফলত অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরে কাজ করা  শ্রমিকের রক্ত খেয়ে বাঁচে, এ রকম। আর ম্যাট হুসেইন তার এই গবেষণায় বিশ্লেষণী চিন্তা নেই এবং দার্শনিক দারিদ্র্য আছে, এমন শিক্ষার্থীমাত্রকেই ‘জম্বি’ আখ্যা দিয়ে ছেড়েছেন। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেল। তার যে মাপের গবেষণা দেখলাম, তাতে তিনি নিজে এই অভিধার বাইরে কিভাবে থেকে যাবেন, তা নিশ্চয়ই আমাদের ভেবে বের করতে হবে! কারণ ‘রিকশা ফ্যাকাল্টি’ বলে আরেকটি পরিভাষা তিনি যে প্রণয়ন করলেন, তাতেই তার প্রেজুডিস নিদারুণভাবে ধরা পড়ে। পর্যবেক্ষণে আরেকটু তীক্ষ্ণ থাকলে এবং বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে আরেকটু সময় নিলে তিনি হয়তো ধরতে পারতেন, বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোটাছুটি করা অধিকাংশ খণ্ডকালীন ফ্যাকাল্টিই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য পেশার সঙ্গে যুক্ত। তারা ক্ষেত্রবিশেষে রিকশা ব্যবহার করেন বটে, তবে বেশিরভাগেরই ব্যক্তিগত যন্ত্রশকট আছে। ম্যাটের ফর্মুলা অনুযায়ী, যন্ত্রশকট থাকায় তারা নিশ্চয়ই ‘রিকশা ফ্যাকাল্টি’র চেয়ে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে সক্ষম! ফলে, সমস্যাটা শেষপর্যন্ত রিকশার!

মনজুর আহমেদের গবেষণাপত্রটি যেহেতু পড়া হয়নি, ফলে সেটি নিয়ে বিস্তারিত বলার অবকাশ নেই। কিন্তু তাকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট সামনে আসতে পারে। পত্রিকার খবর অনুযায়ী, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে নানা ধরনের অরাজকতা চলে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত আছে এই গবেষণায়। সেসব আজকাল কারও অজানা নয়।   

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে শুরু হয়েছে দুই যুগ আগে। তবু আজও আমাদের কারও কারও এমন ধারণা আছে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মাত্রই ভালো এবং মেধাবীদের জায়গা আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মানেই শহুরে উচ্চবিত্ত পরিবারের বিনোদন কেন্দ্র। ম্যাট হুসেইনও সেই কাতারের লোক। ফলে তার পুরো গবেষণায় একবারও টের পাওয়া গেল না ঢাকা শহরের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শহরের বাইরে থেকে আসা কত শিক্ষার্থী পড়াশুনা করছে। একই ভাবে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মান বা গবেষণার ধরন সম্পর্কে যখন তিনি মন্তব্য করেছেন, সেগুলো নেহাত আলটপকা মন্তব্য হয়েই থেকেছে, পেছনে তথ্যের বরাত না থাকায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি-বেসরকারি ঠিকুজি করেন আমলারা, তাদের কাজের সুবিধার জন্য। এটা মূলত প্রশাসনিক ক্যাটাগরি। বুদ্ধিবৃত্তিমূলক আলোচনার ক্যাটাগরি এমন হতে পারে না। কারণ প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ই আলাদা। সরকারি হোক কিংবা বেসরকারি। প্রত্যেকের নিজ নিজ চারিত্র আছে, সম্ভাবনা আছে, সীমাবদ্ধতা আছে। দু’দশটা ‘খারাপ’ প্রতিষ্ঠানের দায় যেমন সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না, তেমনি দু’চারটা ‘ভালো’ প্রতিষ্ঠান আছে বলে সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পার পেয়ে যায় না। বেসরকারি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা হার্ভার্ড হিসেবেই চিনি, সরকারি কি বেসরকারি সে আলাপে যাই না। শিক্ষা-গবেষণায় শ্রেণিকরণ যদি করতে হয়, তবে সরকারি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বরং ভালো এবং খারাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকরণ করুন। গবেষণার সুযোগ থাকা বা না থাকা নিয়ে আলাপ করুন। প্রকাশনা নিয়ে আলাপ করুন। ভালো ও খারাপ একাডেমিক বিভাগের শ্রেণিকরণ করুন। নব্য উদারনীতির আগ্রাসন থেকে জাতির শিক্ষাব্যবস্থাকে রক্ষা করতে চান ভালো কথা, কিন্তু তার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের এইসব সরকারি-বেসরকারি তথা আমলাতান্ত্রিক বিভাজনের হেজিমনি থেকে নিজের বুদ্ধিবৃত্তিকে রক্ষা করুন।

লেখক: কবি, গল্পকার, গবেষক। শিক্ষক, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ