X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন ও প্রধানমন্ত্রীর ‘এক হাত’ নেওয়া

চিররঞ্জন সরকার
০৬ জানুয়ারি ২০১৭, ১৪:০৮আপডেট : ০৬ জানুয়ারি ২০১৭, ১৪:১০

চিররঞ্জন শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনকারীদের একহাত নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সমালোচনাকারীদের উদ্দেশে বলেন, ‘যারা শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তাদের উদ্দেশে আমি বলতে চাই—কোনও কিছুই রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব নয়। আগে আপনারা ভলান্টিয়ার সার্ভিস দিন, সুবিধা বঞ্চিতদের জন্য কিছু করুন, শিক্ষা দিন। তারপর কথা বলুন।’ সমালোচকদের কাছে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রাখেন, ‘শিক্ষার মানের মাত্রাটা আসলে কী?’
আমি খুশি হতাম প্রধানমন্ত্রী যদি 'একহাত' নেওয়ার মতো উত্তর না দিয়ে কথাগুলো বলতেন। শুধু বিনামূল্যে বই বিতরণ করলেই শিক্ষার মান ভালো হয়ে যায় না, ওই বইয়ের শিক্ষাগুলো সহজবোধ্য, বয়স ও যুগোপযোগী কিনা সেটাও দেখা উচিত। তাছাড়া পিইসি জেএসসি দিলেই শিশুরা সাহসী হয়ে উঠবে এটিও ঠিক না। উল্টো এসব পরীক্ষার চাপে শিশুদের শৈশব আজ হারাতে বসেছে, শিশুরা হয়ে উঠছে আরও ভীতু, স্বার্থপর ও ঘরকুনে । উন্নত বিশ্বগুলোতে হাইস্কুলের আগে কোন পরীক্ষা নেওয়া হয় না শুধু এসব কারণেই।
ম্যাজিকের মতো কিছু করা যাবে না, রাতারাতি কিছু বদলাবে না-এটা সবাই জানে। কিন্তু তাই বলে কী শিক্ষার মান নিয়ে কথাই বলা যাবে না? কথা বলার আগে ‘নিজে করে’ দেখাতে হবে? সরকার যা করছে, যেভাবে করছে-তার সবই কি ভালো?
একথা ঠিক যে, দেশে শিক্ষার হার বাড়ছে। ছেলেমেয়েদের জিপিএ ফাইভ পাওয়া বা পাসের হার বাড়ছে। একই সঙ্গে শিক্ষার মান নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও বাড়ছে। শিক্ষার গুণগত মান বলতে ঠিক কী বোঝায়, ঠিক কী ভাবে তাকে মাপা যেতে পারে, এই নিয়ে সমাজে বিভিন্ন অবস্থান আছে, যার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কিত ধারণা। শিক্ষা মানুষ হওয়ার জন্য, নাকি নম্বর পেয়ে চাকরি পাওয়ার জন্য-এ বিতর্ক থাকবে। কিন্তু ন্যূনতম একটি মান নিশ্চিত হওয়া দরকার। সে সম্পর্কে কোনও তর্ক নেই। যা হলো, পড়তে লিখতে ও সাধারণ অংক করতে শেখা। দেখা যাচ্ছে, সেই মূল জায়গাতেই ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।
সম্প্রতি বেসরকারি সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযানের এক গবেষণা জরিপে বলা হয়েছে, দেশে এখন ১১ বছরের বেশি বয়সীদের সাক্ষরতার হার ৫১ দশমিক ৩ শতাংশ। পঞ্চম শ্রেণি সম্পন্ন করা ১১ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সাক্ষরতার হার ৬৭ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্থাৎ ৩২ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ পঞ্চম শ্রেণি শেষ করেও সাক্ষরতা অর্জন করতে পারছে না। তারপরও কী আমরা শিক্ষার মান নিয়ে কথা বলবো না? মুখে কুলুপ এঁটে থাকবো? শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় অংশগ্রহণ ও পাসের হার বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক ঘটনা। কিন্তু শুধু এটুকুতেই কী আমরা সন্তুষ্ট হব? শুধু শিক্ষার্থীদের নম্বর, রেজাল্ট নিয়ে আমাদের মাথা ঘামালেই হবে? নাকি সে কতটা কী পারছে- সেটা ভাবাটাও সমান জরুরি?

পাবলিক পরীক্ষাগুলোর ফলাফলে ‘গ্রেড বিস্ফোরণ’ গত কয়েক বছরে অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু তাতে পরিস্থিতি খুব একটা পাল্টেছে বলে মনে হয় না। শিক্ষা দিনকে দিন জ্ঞানমুখী হওয়ার পরিবর্তে ফলমুখী হচ্ছে। এই সুযোগে বেশকিছু কোচিং সেন্টার অবাধে শিক্ষা-বাণিজ্যে লিপ্ত রয়েছে এবং শিক্ষার্থীর অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদের দিকে তাকিয়ে অবাধে অর্থ খরচ করছে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ফলাফলে দেখা গেছে যে ইংরেজি বিভাগে মাত্র একজন উত্তীর্ণ হয়েছে এবং অন্যান্য বিভাগেও কোটা পূরণ হয়নি অর্থাৎ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়ার পরও এই পরিস্থিতি অনেককে হতাশ করেছে। এই ধরনের ফলাফল পাওয়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা নিতান্তই কম নয় এবং সরকারি পর্যায়েও একটি অঘোষিত নীতি রয়েছে পাসের হার বাড়ানো সেখানে মানের প্রশ্নটি অবহেলিত। আবার এই প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতিতে মনে হয় শিক্ষার্থীর চেয়ে অভিভাবকরাই বেশি উদ্বিগ্ন বিশেষত সন্তানদের ফলাফল নিয়ে। আবার সিলেবাস নিয়ে কিংবা পদ্ধতি নিয়ে যত পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে তার সঙ্গে শিক্ষক-অভিভাবক-শিক্ষার্থীরা ধাতস্থ হতে পারছে না। এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ-খাওয়াতে না পেরে অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকরাই অন্ধকারে হাবুডুবু খান। এসব ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা ও উদ্যোগ কোনও পরিবর্তন আনতে পারছে বলে মনে হয় না।

আমাদের শিক্ষার মূল দর্শনের সঙ্গে পাঠ্যসূচির তেমন কোনও মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তারপর আবার শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের অসহযোগিতা বিশেষত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে। যেমন বর্তমানে একটা রেওয়াজ হয়েছে প্রাইভেট পড়ানো অর্থাৎ শিক্ষকরা বিশেষত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ক্লাসে তেমন মনোযোগী থাকেন না এবং শিক্ষার্থীদের বাসায় প্রাইভেট কোচিং-এ বাধ্য করানো হয়। যারা এতে সাড়া দেয় তারা বিশেষ সুবিধা পায় যেমন পরীক্ষা প্রশ্ন বলে দেওয়া, বেশি নম্বর পাইয়ে দেওয়া। আর এই প্রক্রিয়ায় যারা সাড়া না দেয় তাদের ভাগ্যে জোটে উল্টোটা। আর উচ্চ শিক্ষায় বিষয়টি আরও জটিল। শিক্ষকরা সময়মতো ক্লাসে আসেন না এবং এলেও নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ক্লাস ত্যাগ করেন। যদি কোন শিক্ষার্থী প্রশ্ন করেন তাতে শিক্ষক রাগান্বিত হন। শিক্ষার এই ঘাটতি পূরণে ছাত্রছাত্রীরা সমান্তরালভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্লাসের পাশাপাশি প্রাইভেট কোচিং চালিয়ে যায়, যা অভিভাবকদের ঘাড়ে এক বাড়তি খরচের বোঝা। এই ধরনের অনুশীলন শিক্ষকদের নৈতিক ভিত্তির জায়গাটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে আর শিক্ষাকে করেছে বাণিজ্যকরণ, যা উদার কিংবা বাজার অর্থনীতির কুফল। শিক্ষা প্রশাসন বিশেষ করে সরকারি পর্যায়ে একেবারেই ভেঙে পড়েছে কারণ প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষ কিংবা উপাচার্য কারও শিক্ষকদের ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই এবং কে কখন ক্লাসে আসা-যাওয়া করে, সঠিকভাবে ক্লাস পরিচালিত হচ্ছে কিনা তার কোন পর্যবেক্ষণ নেই।

শিক্ষার একটা উদ্দেশ্য জীবনকে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করার দক্ষতা অর্জন করা। সক্রেটিস যাকে বলেছেন ‘এগজামিনড লাইফ’। পাশ-ফেল প্রথার মাত্রাছাড়া জয়গানের ফলে সেটা যদি হয়ে দাঁড়ায় পরীক্ষা-ক্লিষ্ট জীবন, তা কিন্তু হবে ছাত্রদের প্রতি বিরাট অবিচার।

আমাদের উচ্চ শিক্ষায়ও আজ হতাশায় ভরা। আমাদের দেশে শিক্ষরাও প্রশ্ন করে না, ছাত্ররাও প্রশ্ন করতে শেখে না। এমনকি এসব নিয়ে সমাজের অন্য কেউ-ও কোনো প্রশ্ন করে না। প্রশ্ন করা যায় না। দেশে এখন চালু হয়েছে প্রশ্নহীন শিক্ষা, প্রশ্নহীন সমাজ-রাজনীতি। অথচ আমাদের প্রাচীন সমাজে 'অধ্যয়ন'-কে উৎসাহিত করা হয়েছিল। তাদের মোটেই বাক্হীন, প্রশ্নহীন থাকার কথা বলা হয়নি। ধর্মীয় উপকাহিনিতে আছে, নচিকেতার বাবা যজ্ঞে গরু দান করছিলেন, সেই গরুগুলো আর ঘাসও খাবে না দুধও দেবে না। এমন গরু দানের অর্থ নেই। অথচ বাবা দাতা হিসেবে নাম কিনছেন। এ অনৈতিক কাজ। নচিকেতা বাবার বিরক্তি উৎপাদন করেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। এ কাহিনি ভারতবর্ষের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ কঠোপনিষদের।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিকল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুটি নীতি পড়ুয়াদের জন্য আজীবন অনুসরণ করেছেন। ছাত্রদের সরব চিন্তাশীল প্রশ্নপরায়ণ করে তুলতে হবে, আর শিক্ষক-প্রশাসন তাঁদের বাইরে থেকে শাসন করবেন না, পড়ুয়ারা নিজেরাই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করবেন মতামত ও পরামর্শ বিনিময়ের মাধ্যমে। এতে গণতন্ত্রের প্রাথমিক অনুশীলন সম্ভব। রবীন্দ্রনাথ এই গণতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় গণতন্ত্র বলে ভাবতে নারাজ। নেশন তাঁর মতে কিছু লোকের অর্থনৈতিক স্বার্থ পরিপূরণকারী নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমাবিশিষ্ট দানবীয় সংগঠন। তিনি নেশনের বিপরীতে ব্যক্তিমানুষের সঙ্গে ব্যক্তিমানুষের সহযোগে নির্মিত মতবিনিময়ের মাধ্যমে পোক্ত কল্যাণকামী স্বতঃস্ফূর্ত এক সংগঠনে বিশ্বাসী। সে সংগঠনের নাম সমাজ। তিনি মনে করেন পড়ুয়ারা এই সমাজের জন্য শিক্ষিত হবে, এই সমাজকে সম্প্রসারণে সহায়তা করবে। শিক্ষার পাঠক্রমকে সমাজের সব বৃত্তির সঙ্গে যুক্ত করতে হবে, বৃত্তির বাইরে স্বাধীন দার্শনিক চিন্তার আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অধিকারও থাকবে।

প্রশ্ন হলো, আমাদের বর্তমান শিক্ষা এই লক্ষ্য পূরণে কতটুকু কী করতে পারছে?

শিক্ষা স্বপ্ন দেখতে শেখায়, সাহস জোগায় স্বপ্নকে সাকার করার। তাই শিক্ষা নিয়ে নিরন্তর ভাবনা-চিন্তা প্রয়োজন। গোটা শিক্ষাঙ্গন পরিসরকেই কী ভাবে শিক্ষা-সহায়ক করে তোলা যায় সে ভাবনাও ভাবতে হবে। শিক্ষা নিয়ে আলাপ-আলোচনা-গবেষণা আরও বাড়ানো দরকার। সবচেয়ে বেশি দরকার তথাকথিত পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীকে কী ভাবে সামনে, মূল স্তরে আনা যায়, তার পথপদ্ধতি অনুসন্ধান।

আমরা চাই শিক্ষার উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট সুচিন্তিত নীতিমালা। শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য আমরা চাই না। শিক্ষা নিয়ে কথা বললেই ‘ফোঁস’ করে ওঠা-এটাও চাই না।

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আজ থেকে শুরু প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী
আজ থেকে শুরু প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী
আমার কোনও অনুশোচনা নেই: গার্দিওলা
আমার কোনও অনুশোচনা নেই: গার্দিওলা
আত্মরক্ষার সিদ্ধান্ত আমরা নিজেরাই নেব: নেতানিয়াহু
আত্মরক্ষার সিদ্ধান্ত আমরা নিজেরাই নেব: নেতানিয়াহু
হেলমেটের মান নির্ধারণ হবে কবে?
হেলমেটের মান নির্ধারণ হবে কবে?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ