X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

পুরনো আলো নিভেছে, নতুন আলো জ্বলেনি

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১১ জানুয়ারি ২০১৭, ১৩:২৬আপডেট : ১১ জানুয়ারি ২০১৭, ১৬:৪৮

একাত্তর টিভির পরিচালক (বার্তা) সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সমাজে বিষের আনাগোনা কতটা, তা বুঝতে শিখিয়েছে উত্তরার খুন। কিশোর আদনান তারই স্থানীয় বন্ধুদের হাতে খুন হওয়ার পর যেসব খবর আসছে, সেসব খুব উদ্বেগজনক। কিন্তু শুধু উদ্বেগে তো আসলে কিছু হয় না, কোনও অপরাধ কমেও না।
এক ভয়ানক ‘গ্যাং-সংস্কৃতি’র বিকাশ ঘটেছে রাজধানীর উত্তরায়। কোথাও কোথাও আবার তা কমিউনিটি নামে গড়ে উঠছে, কোথাও বা অন্য কোনও নামে। আদনান ছাড়াও এর আগে আরেক কিশোর খুন হয়েছিল উত্তরায় ফুটবল খেলতে গিয়ে। গ্রুপ করে, সামাজিক মাধ্যমে জানান দিয়ে খুন খারাবি করছে কিশোররা।
গণমাধ্যমগুলো বলছে, উত্তরা এলাকায় উঠতি তরুণদের ৫টি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। গ্রুপের বেশির ভাগই নামকরা স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাদের প্রায় সবার বয়সই ১৮ বছরের নিচে। প্রত্যেক গ্রুপের ফেসবুক পেজ আছে। সেখানে পোস্ট করা পরস্পরকে হুমকি দেওয়া, মাদক নেওয়া, নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শন নিত্যদিনের ঘটনা। এমনকি তাদের প্রায় সবার ফেসবুক প্রোফাইলে ডাকনাম আছে। কারও নামের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে নবাব, হিটলার বা বয়রা। আবার কারও নাম ইবলিশ। গ্রুপের ভেতর এসব নাম ধরেই ডাকা হয় তাদের।
কেন এমনটা হয়? এ প্রশ্নের কোনও উত্তর কি জানার চেষ্টা করেছেন তারা, যারা দেশ চালান? সবাই ব্যস্ত কামাই করা নিয়ে। এক অস্থির সময় পার করছি আমরা। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের অভাবে পরিবারের উপার্জনশীল ব্যক্তি বা অভিভাবকদের ওপর অস্বাভাবিক চাপতো আছেই, প্রযুক্তির ধাক্কায় পরিবারের বন্ধন, মূল্যবোধ সব কিছু যেন ভেঙে যাচ্ছে। তাই পরিবারে সন্তানদের এখন আর কোনও গাইডেন্স নেই। সামাজিক মাধ্যম আছে, কিন্তু আমাদের সন্তানদের সামাজিকীকরণ বন্ধ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা চার কোটি ছাড়িয়েছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। প্রতি ১২ সেকেন্ডে একটি করে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলা হচ্ছে, যা বাংলাদেশের মানুষের জন্মহারের চেয়েও বেশি। অপ্রাপ্তবয়স্ক ও নৈতিক জ্ঞানহীন মানুষের হাতে তথ্য প্রযুক্তি গিয়ে এক চরম বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অপরাধের একটি বড় অংশ এই সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়। মূল্যবোধ বিবর্জিত মানুষের হাতে এমন একটি ক্ষমতা দিশেহারা করে তুলছে সমাজকে, যার শিকার হচ্ছে কিশোর-তরুণরাও। তথ্য বিকৃতি, ব্যক্তিগতভাবে সমাজের কোনও মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করা, প্রতিকৃতির ব্যঙ্গাত্মক উপস্থাপন, ঘৃণা, বিদ্বেষ, হিংসা ও সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানো স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠানের তথ্য ও ছবি চুরি করে ব্ল্যাকমেইল করার মতো ঘটনাতো আছেই।
উত্তরা কিংবা রাজধানীর যেকোনও এলাকা বা দেশের অন্য কোনও শহরের চিত্র আজ এমন করেই পাল্টে যাচ্ছে। যারা এরকম ভয়ঙ্কর খেলায় লিপ্ত, তাদের বেশির ভাগের বয়সই কুড়ির নিচে। সমাজের ছেলেমেয়েদের সামনে আধুনিক শিক্ষার ব্যাপক সুযোগ। তবু লেখাপড়া কতটা হয় সে প্রশ্ন করছি প্রতিদিন। পুরনো দিনে যেভাবে শৈশব থেকে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে তারা প্রশিক্ষিত হতো, নিজেদের একটা স্বীকৃত সামাজিক মূল্যবোধের শরিক করে নিত, সেটাও ক্রমবিলীয়মান। ছেলেমেয়েরা শিক্ষাহীন, মূল্যবোধহীন এক অক্ষমতা নিয়ে স্কুলে যায়, কলেজে যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় আর ফিরে। আমরা পুরনো আলো নিভিয়ে দিয়েছি সেকেলে বলে, কিন্তু নতুন প্রদীপ জ্বালাতে পারিনি। নতুন এক জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির মধ্যে পড়েছি আমরা, যার জন্য আমরা হয়তো তৈরি ছিলাম না। বয়স্ক, অভিজ্ঞ ও মুরুব্বিরা যেন নব প্রজন্মের সংস্কৃতির কাছে বড় অসহায়। নতুন আর পুরনোর মাঝে যে শিক্ষা, সেটা আমরা দিতে পারিনি।
নৈতিকতা ও মূল্যবোধের যে ঘাটতি নিয়ে আমাদের সন্তানরা সমাজে বড় হচ্ছে এবং যেভাবে তাদের চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণগুলো চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে এর দায় যেমন রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবারের রয়েছে, ঠিক তেমনি প্রতিটি নাগরিকের উচিত নিজ নিজ উদ্যোগে মাদকসহ নানাবিধ সামাজিক অবক্ষয় রোধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা। প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া নানাবিধ সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধে আমরা নিজ নিজ জায়গা থেকে কতটুকু ভূমিকা পালন করছি? আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে সামাজিক অবক্ষয়কে সমাজ থেকে চিরবিদায় দিতে হবে। কেবল একে অন্যকে দোষারোপ না করে সমাজের একজন নাগরিক হিসেবে আমি নিজে এই সমাজকে কতটুকু দিতে পারছি, সেই কথাটাও ভাবতে হবে, যা অধিক জরুরি।
উত্তরা ঘটনা আমাদের কয়েকটি প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। কেন আজ এই উগ্র চেতনার জন্ম নিচ্ছে পাড়ায়-পাড়ায়, ঘরে-ঘরে? সমাজের ভেতর-বাইরের আর্থিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নানা কারণ কতটুকু প্রভাব রাখছে?
প্রযুক্তি বা অন্য কোনও বিকাশকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না। সমাজব্যবস্থায় নানা অবশ্যম্ভাবী প্রভাব পড়ছে, মিশ্রণ ঘটছে, সন্দেহ নেই। এই সব প্রভাবের মধ্যে ভালোর চেয়ে মন্দের ভাগ অনেক বেশি; কিন্তু তাই বলে এগুলোকে আটকানো যাচ্ছে না। আধুনিক সমাজের আদিম অত্যাচারগুলো পুরনো আদিমতার সঙ্গে মিলেমিশে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যা আমাদের সবার জন্য দুঃস্বপ্নের। এ দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ নেই, তা হয়তো নয়। কিন্তু সে পথ বড় কঠিন। আইন, আদালত, পুলিশ অভিজ্ঞতায় শুধু না দেখে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে সমাজকেই এবং নানা স্তরে। মূল্যবোধের বিকৃতি রোধে মানুষের নতুন মূল্যবোধ গড়ে তুলতে হবে, যে বোধ তাকে তার সামগ্রিক কুশলতা বাড়ানোর লড়াইয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে চীনের দাবি ‘অযৌক্তিক’: ভারত
অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে চীনের দাবি ‘অযৌক্তিক’: ভারত
‘বিএনপি নির্বাচন বানচাল করতে চেয়েছিল, আ.লীগ তা ব্যর্থ করে দিয়েছে’
‘বিএনপি নির্বাচন বানচাল করতে চেয়েছিল, আ.লীগ তা ব্যর্থ করে দিয়েছে’
রাজধানীতে মুষলধারে বৃষ্টি, কমেছে তাপমাত্রা
রাজধানীতে মুষলধারে বৃষ্টি, কমেছে তাপমাত্রা
‘এখন দেখছি মরে গেলে লাশেরও নিরাপত্তা নেই’
কঙ্কাল চুরির পর বিক্ষুব্ধ স্বজন বললেন‘এখন দেখছি মরে গেলে লাশেরও নিরাপত্তা নেই’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ