X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার কফি হাউজ

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
১২ জানুয়ারি ২০১৭, ১১:১৩আপডেট : ১২ জানুয়ারি ২০১৭, ১৫:৫২

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী কলকাতার কফি হাউজ কলেজ স্ট্রিটে। কলেজ স্ট্রিটের প্রথম কলেজ ছিল হিন্দু কলেজ। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ১৮১৭ সালে। শিবনাথ শাস্ত্রী তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, বাইজী হিরা বুলবুলির ছেলের ভর্তির বিষয় নিয়ে কলকতার বড় বাবুদের মধ্যে বিবাদ লেগে যায়। বিবাদের তোড়ে হিন্দু কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ইংরেজ সরকার হিন্দু কলেজেই প্রেসিডেন্সি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলেজ স্ট্রিটের দ্বিতীয় কলেজ। প্রবেশিকায় ফল ভালো ছিল সে কারণে ইংরেজরা হিরা বুলবুলির ছেলেকে প্রেসিডেন্সি কলেজে এডমিশন দিয়েছিলেন।
হিন্দু কলেজ ছিল সম্ভ্রান্ত হিন্দু সন্তানদের জন্য প্রতিষ্ঠিত কলেজ। এখানে অন্য কোনও সম্প্রদায়ের সন্তানদের পড়ার কোনও সুযোগ ছিল না। হিরা বুলবুলি পতিতা ছিল। তার ছেলের পড়ার তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না। শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন, ‘অথচ এ ছেলেটা বড় বাবুদের কারও না কারও ঔরসজাত সন্তান। কারণ বড় বাবুরা হিরা বুলবুলির শয্যাসঙ্গী হতেন। পতিতার কোনও পুংলিঙ্গ নেই। সুতরাং বড় বাবুদের দোষ হবে কেন! সব দোষ হিরা বুলবুলির।’
যাক, সেটা ছিল ভণ্ডামীর যুগ। ভণ্ডামীতে আঘাত করেছিলো প্রেসিডেন্সি কলেজ। সে কারণে প্রেসিডেন্সি কলেজে সম্ভ্রান্ত হিন্দুরা প্রথম প্রথম ছেলে পড়াতে চায়নি। প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রথম দুই বছর ন্যাটিভ খ্রিস্টান আর মুসলমান ছাত্রই বেশি ছিল। মুসলমানেরা প্রথম কলেজে পড়ার সুযোগ পায় প্রেসিডেন্সি কলেজ হওয়ার পর। হিন্দু কলেজে কোনও মুসলমানের পক্ষে পড়ার সুযোগ ছিল না। পরবর্তী সময়ে মহাবিদ্রোহের আগেই ঢাকা কলেজ, চিটাগাং কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো পূর্ববঙ্গে।

পূর্ববঙ্গে ৮০ শতাংশ ছিল মুসলমান। মহাবিদ্রোহের পর রাজশাহী কলেজ (১৮৭০), সিলেটের এমসি কলেজ (১৮৯২) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। কলকাতার কলেজ স্ট্রিটকে ঘিরে গড়ে ওঠেছিলো কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, সাংস্কৃতিক কলেজ।

সাংস্কৃতিক কলেজের প্রাণপুরুষ ছিলেন বিদ্যাসাগর। ধর্ম কর্মের প্রতি উদাসীন ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। তবে দয়ার সাগর ছিলেন তিনি। পূর্ব বাংলার থেকে পড়তে আসা অনেক ছেলের অভিভাবক ছিলেন তিনি। কলকাতায় শুনেছি বড়লোক, গুণীজন সবাই দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ প্রার্থী হতেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয় কখনও দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ প্রার্থী হননি। কিন্তু রামকৃষ্ণ নাকি চাইতেন বিদ্যাসগার তার আশ্রমে আসুক।

মাঝে মাঝে রামকৃষ্ণ কলকাতার পথে হাঁটতেন এবং দলবল তার সঙ্গে থাকতো। একবার বিদ্যাসাগরকে পথে রামকৃষ্ণ সাক্ষাৎ পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুমি আমার কাছে আসো না কেন?’ তখন নাকি বিদ্যাসাগর মহাশয় বলেছিলেন, ‘আমি কেন তোমার কাছে যাবো তুমিতো সাধু, আমিতো ঈশ্বর।’

প্রকাশনা হাউজগুলোও কলেজ স্ট্রিটে, বাংলার সবচেয়ে বড় পুরনো বইয়ের বাজার ও কলেজ স্ট্রিটে। কলেজ স্ট্রিট সরস্বতীর আশীর্বাদ ধন্য এলাকা। বই প্রেমিকের ভিড় এখানে লেগে থাকে। এখানেই হলো বিখ্যাত কফি হাউজ। এই কফি হাউজের নাম জানে না এমন শিক্ষিত লোক বাংলায় বিরল।

কফি হাউজের আড্ডায় বসেনি কলকাতায় এমন কবি-সাহিত্যিক নেই বললে চলে। কফি হাউজের আড্ডার গল্প শুনেছি কিন্তু কখনও দেখিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন কলকাতা যাই তখন কফি হাউজ দেখার তৃষ্ণা মেটে। নেতাজি সুবাস বসু, সত্যজিৎ রায়, কবি নজরুল সবাইতো এসেছেন এ কফি হাউজে।

বাঙালিরা আড্ডা-প্রিয় মানুষ। আড্ডার মাঝে জন্ম নিয়েছে কত আন্দোলন, কত বিপ্লব। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমরা বাংলাদেশের মানুষেরা মনের সাধ মিটিয়ে আড্ডা জমিয়েছিলাম এই কফি হাউজে।

আমাদের বন্ধু ইলিয়াছ কফি হাউজে অনেক সময় ঝগড়া করতো পশ্চিম বাংলার লোকের সঙ্গে। একবার ইলিয়াছ বঙ্কিম বাবুকে নিয়ে শক্ত শক্ত কথাও বলেছিলো। কিন্তু তখন পশ্চিম বাংলার লোকেরা কিছু মনে করতো না। তারা আদর করে আমাদেরকে ‘জয় বাংলার ভাই’ বলতো।

এত বললাম কলকাতার কলেজ স্ট্রিট আর কফি হাউজের আড্ডার কথা। আজ একটুতে চাই ঢাকার ‘কফি হাউজ’ সম্পর্কে। ঢাকায় কফি হাউজ নেই। কফি হাউজ না থাকলেও আড্ডার তো অভাব ছিল না। ভারত বিভক্তির পর মুসলমান-কবি সাহিত্যিকেরা তো আর কলকাতায় রইলেন না। তারা চলে আসলেন ঢাকায়। ঢাকা বলতে তখন পুরনো ঢাকাই। আজাদ পত্রিকা চলে আসলো ঢাকায়। পলাশীতে বসলো আজাদ-এর অফিস। সংবাদ পত্রিকা বের হতো বংশাল থেকে। সওগাত ও বেগম পত্রিকা বের হতো মুগলটুলি থেকে। সাপ্তাহিক ইত্তেফাক, পরে দৈনিক ইত্তেফাক বের হত রামকৃষ্ণ মিশন রোড থেকে। মোটামুটি এগুলোই তো ছিল গণমাধ্যম।

জগন্নাথ কলেজ, কায়দে আজম কলেজ, আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমান বুয়েট) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়- এইতো ছিল ঢাকা। বড় ছোট প্রকাশনা হাউজগুলো ছিল বাংলা বাজারে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেশের বহু বাংলা বাজার পাকিস্তান বাজার হয়েছে। প্রকাশনা শিল্পের এ বাংলা বাজার কিন্তু আদি-অন্ত বাংলা বাজার। বাংলা বাজার রোডে বিউটি বোডিং বলে একটা বোডিং ছিল, এখনও বোডিংখানা কালের স্বাক্ষী হয়ে টিকে আছে। থাকা খাওয়া সবই সস্তা ছিল।

সারা দেশ থেকে পুস্তক ব্যবসায়ীরা আসতো বাংলা বাজারে। তারা এ বোডিং-এ থাকতো। বোডিংটা কিন্তু বিখ্যাত ছিল কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের আড্ডার জন্য। ১৯৬০ সালের পরে ঢাকা যখন প্রসারিত হওয়া আরম্ভ করলো তখন তোপখানা রোডে প্রেসক্লাব হলো। রাজনৈতিক দলের অফিসগুলো যখন ধীরে ধীরে পল্টনের দিকে আসতে শুরু করল তখন ধীরে ধীরে বিউটি বোডিং-এর আড্ডা ভেঙে গেলো। আড্ডার জায়গা হয়ে উঠলো তোপখানা রোড।

তখন রাজনৈতিক দলের সভা হতো আর্মানিটোলা ময়দানে। এখন সভা হওয়া আরম্ভ করলো পল্টন ময়দানে। তখন দৃশ্যত দল ছিল দুটি- আওয়ামী লীগ আর মুসলিম লীগ। আওয়ামী লীগের পক্ষে আর্মানিটোলায় জনসভা করা কঠিন ছিল। কারণ বাইশ মহল্লা সর্দারের পুরানো ঢাকা। মহল্লা সরদারেরা ছিল নওয়াবদের হাতের মানুষ। নওয়াবেরা করতো মুসলিম লীগ। ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকে নওয়াবদের প্রতিপত্তি লীন হতে আরম্ভ করে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর মুসলিম লীগের প্রতিপত্তি বিধ্বস্ত হয়ে যায়। সেই থেকে আওয়ামী লীগের উত্থান।

আওয়ামী লীগ ছিল যুক্তফ্রন্টের মূখ্য দল। আগে রাজনীতি ছিল ওপর তলার মানুষের হাতে। মওলানা ভাসানী আর শেখ মুজিবই রাজনীতিকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে আসে। বহু পরিশ্রম করে, বহু মোড় ঘুরে, দশ হাত অগ্রসর হলে আবার পাঁচ হাত পিছে ফিরে এসে বহু কৌশলে তারা আওয়ামী লীগকে গণ রাজনীতির প্ল্যাটফর্ম হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন। ৫০ নবাবপুরে ছিল আওয়ামী লীগের অফিস। ১৯৫৭ সাল মাওলানা যখন আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন তিনি তখন তার অফিস স্থাপন করেছিলেন কাপ্তান বাজারে।

১৫০ মুগলটুলিতে ছিল গণতান্ত্রিক কর্মী শিবিরের অফিস। এ সংগঠনটি ছিল আওয়ামী লীগের সূতিকাগৃহ। গণতান্ত্রিক কর্মী শিবিরের নেতারাই ১৯৪৯ সালে ২৩ জুন রোজ গার্ডেনে আওয়ামী লীগ গঠন করেছিলেন।

এখন ঢাকায় আড্ডার জায়গা হচ্ছে তোপখানা। তোপখানা, পিলখানা এগুলো ফার্সি শব্দ। মুঘল-পাঠানেরা দেশ চালানোর সময় বিশেষ সামরিক ছাউনির নাম। তোপখানা হচ্ছে আর্টিলারি সেন্টার। সচিবালয়, প্রেসক্লাবসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ ভবন এখানে। বঙ্গবন্ধুতে আওয়ামী লীগ অফিস, নয়াপল্টনে বিএনপির আর কাকরাইলে জাতীয় পার্টির অফিস, কমিউনিস্ট পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ও সাম্যবাদী দলের অফিসও এ এলাকায়। জাসদ এখন বহুদা বিভক্ত। জাসদ (ইনু), জাসদ (আম্বিয়া), বাসদ (খালেকুজ্জামান), বাসদ (মার্কসবাদী), বাসদ (মাহবুব)। এগুলো টুকরা টুকরা হলেও পরিচিত দল।

এছাড়াও আরও বহু ছোট ছোট দল আছে। সন্ধ্যায় রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের আসর বসে তোপখানায়।

এখানে বহু অভিজাত রেস্তোরা আছে। উচ্চমূল্যের কারণে সবখানে আড্ডাপাতা যায় না। আড্ডার জায়গা হলো ‘আপ্যায়ন’- এটাই তোপখানার কফি হাউজ। হারুন সাহেব মালিক। সদ-আলাপী লোক।

ছোটদলগুলোর মাঝে ভাসানী ন্যাপের কয়েক টুকরার নেতা দেখা যায় এখানে। বেতের টুপি মাথায় কোনও লোক দেখলেই মনে করতে পারেন ভাসানী ন্যাপের কোনও অংশের প্রধান ব্যক্তি।

গণতান্ত্রিক জাতীয় লীগের প্রধান হচ্ছেন জলিল সাহেব। খুবই ভালো লোক। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কামান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন থেকে জর্জ ওয়াশিংটন- সবার মৃত্যু দিবস পালন করা তার কাজ। শামসুদ্দীন বলে এক যুবক হচ্ছেন নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক। ক’দিন আগে ফেলানী দিবস পালন করেছিলেন শিশু একাডেমির হলে। ফেলানীর মা-বাবাকেও এনেছিলেন কুড়িগ্রাম থেকে। নাগরিক পরিষদের বাতিক হচ্ছে, তারা মনে করে বাংলাদেশের সব অমঙ্গলের কারণ হচ্ছে ভারত।

ডা. শামসুল আলম হচ্ছেন সমাজতান্ত্রিক মজদুর পার্টির সাধারণ সম্পাদক। এ পার্টির অফিস হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর হকার মার্কেটের পাঁচ তলায়। রাজনীতি ও মজলুম মানুষের জন্য যথেষ্ট দরদ রয়েছে তার। ড. আলম খুবই চেষ্টা করছেন তার সংগঠন গড়ে তোলার জন্য। তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করা লোক। সব ক্ষুদ্র দলের বিবরণ দিলে লেখা খুবই লম্বা হবে। তবে আরও ১৫/২০ টা ক্ষুদ্র দল বিচরণ করে এখানে। আড্ডা পাতে আপ্যায়নে। রাত ৯টা পর্যন্ত আপ্যায়নে আড্ডা জমজমাট। অনেক সময় শোরগোলে মনে হয় যে আপ্যায়নে বাজার বসেছে।

এ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলগুলো একত্রিত হলে একটা বড় দলের জন্ম দিতে পারে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। কারণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলের প্রধানেরা নিজেদের সিংহসম জ্ঞান করে। কলকাতার কফি হাউজ নিয়ে মান্না দে গান গেয়েছিলেন- ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’। কলকাতার কফি হাউজের আড্ডায় ভাটার টান আসলেও ঢাকার কফি হাউজ ‘আপ্যায়ন’ এর আড্ডাটা কিন্তু ছোট পার্টি বড় নেতাদের দিয়ে জমজমাট।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ